চুনারুঘাটের এই অরণ্যে তাঁবুবাস করতে চাইলে লেখাটি পড়ে রাখুন

হ্যামকে শুয়ে–বসে কাটল অনেকটা সময়
ছবি: লেখক

নির্জন অরণ্যে তারাভরা আকাশের নিচে রাত কাটানোর ইচ্ছা নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। গাড়িতে তাঁবুসহ ক্যাম্পিংয়ের অন্যান্য সরঞ্জাম। আমাদের গন্তব্য হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে কুনি মোচড়া। জায়গাটা কালেঙ্গা রেঞ্জ অফিস থেকে তিন কিলোমিটার।

আগেরবার এই পথ ধরে হুগলিছড়া চা-বাগান হয়ে শ্রীমঙ্গল গিয়েছিলাম। শুরুতে খানিকটা ধানখেতের মাঝ দিয়ে গিয়ে তারপর বনে ঢুকে গেছে পথ। মোটামুটি প্রশস্ত রাস্তা। গাড়ি অনায়াসে চলাচল করতে পারবে। আমরা অবশ্য হেঁটেই যাচ্ছি। দুই ধারে সুউচ্চ বৃক্ষ আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা করছে, মাঝেমধ্যে ফুটে আছে দাঁতরাঙা ফুল। তেজপাতার সঙ্গে মিল থাকায় পাতাগুলোকে বুনো তেজপাতা নামেও ডাকা হয়। জঙ্গলের গভীরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নির্জনতা। একটা জায়গায় এসে হঠাৎ করে শীতলতার পরশ টের পেলাম। পাশ থেকে শাহাদাৎ ভাই জানালেন, জায়গাটার নামই ঠান্ডার মোড়। নামকরণের সার্থকতা পেয়ে গেলাম। যাহোক, আরও কিছু দূর হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম কুনি মোচড়া। আমাদের ক্যাম্পসাইট।

অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাঁবু পাতার জায়গা পাওয়া গেল

ছোট একটা টিলার ওপরে বন বিভাগের চৌকি, ছোট একখানা ঘরও আছে। একজন বনরক্ষীর আস্তানা। সারা দিন বন পাহারা দিয়ে রাতে এখানে এসে ঘুমান তিনি। সামনে দিয়ে গেছে হুগলিছড়া চা-বাগান যাওয়ার পথ। চারপাশটা ঘন অরণ্য। বড় বড় গাছ, বেতবাগান, এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে বাঁশঝাড়—অন্য রকম এক পরিবেশ। টিলার ওপরের দিকটায় অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁবু পাতার উপযুক্ত স্থান পাওয়া গেল না। টিলার সামনে দিয়ে চলে যাওয়া পথটা একটা মোচড় নিয়েছে, সেখানে মধ্যবয়সী বাঙালির ভুঁড়িসদৃশ একটা জায়গা বের হয়েছে। এক পাশে টিলা অন্য দিকটায় শুকিয়ে যাওয়া ঝিরি। সিদ্ধান্ত হলো ওই পেটমোটা জায়গাটায় একটু পরিষ্কার করে তাঁবু চারটা খাটানো হবে।

সাশ্রয়ী ও রোমাঞ্চকর—এই দুই কারণে দেশেও জনপ্রিয় হচ্ছে ক্যাম্পিং বা তাঁবুবাস। একা ও দলবদ্ধ দুই ধরনের তাঁবুবাসই হচ্ছে। একসময় দুর্গম জায়গায় ক্যাম্পিংয়ের চল থাকলেও এখন শহরতলিতেও তাঁবু পাতছেন অনেকে। নদী, পাহাড় কিংবা সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে ক্যাম্পিংকেই বেছে নিচ্ছেন রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষেরা। ঢাকা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ভোলা, রাঙামাটিসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিক ক্যাম্প সাইটও তৈরি হয়েছে। এসব জায়গায় ক্যাম্পিংয়ের যাবতীয় সরঞ্জাম ভাড়া পাওয়া যায়। তবে অপরিচিত জায়গায় ক্যাম্পিং করার আগে নিরাপত্তার দিকটাও দেখতে হবে।

প্রথমে টানানো হলো হ্যামক। তাঁবু খাটানোর পর প্রথম শুরু করা হলো আগুন ধরানোর কাজ। রাতের খাবার এখানেই রান্না করা হবে। তবে তার আগে পেনি স্টোভ দিয়ে চা বানানো শুরু হয়ে গেল। সময় হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি অন্ধকার নেমে এল। জঙ্গলে সন্ধ্যা নামার আগেই চারদিক দখল করে নেয় অন্ধকার। এদিকটায় মানুষের চলাচল থাকায় বন্য প্রাণীর আনাগোনা কম।

গভীর অরণ্যে যখন রাত নামল

পূর্ণ চাঁদ আকাশের দখল নিতে শুরু করেছে। সবকিছু ছাপিয়ে নিবিড় নৈঃশব্দ্য এসে ভর করল চারদিকে। ঝিঁঝি পোকারা মহা উৎসাহে ক্লান্তিহীন ডাকতে শুরু করেছে। কিন্তু সে শব্দ বনের পরিবেশের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে আলাদা করে কানে বাজছে না। কোথায় যেন পড়েছিলাম, বন দেখতে হয় রাতে। রাতের গভীরতার সঙ্গে তার পরিবেশ ও সৌন্দর্য পরিবর্তিত হতে থাকে। চাঁদ উঠলে কী হবে, সুউচ্চ বৃক্ষের ভিড় ঠেলে দৃশ্যমান হচ্ছে যৎসামান্য। চন্দ্রাহত হওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা নির্জন পথ ধরে সামনে এগোতে থাকলাম। ভয়ডরের বালাই নেই। নেশাগ্রস্তের মতো হাঁটতে হাঁটতে এমন একটা জায়গায় থামলাম, যেখানে ফাঁকা একটা জায়গা থেকে চাঁদ দৃষ্টিসীমায় চলে এল। অবর্ণনীয় জ্যোৎস্নার সম্মোহনী সৌন্দর্যে সবকিছু ভুলে গিয়ে আমি, তৌফিক, জুয়েল আর টুসি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।