উজবেকিস্তান পর্ব ২

খাওয়াদাওয়ার জন্য হলেও উজবেকিস্তানে আরেকবার যেতে চাই

উজবেকিস্তানের রেলব্যবস্থা চমৎকার
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তাসখন্দ থেকে বুখারা, বুখারা থেকে সমরখন্দ। প্রতিবারই বুলেট ট্রেনে যাওয়া–আসা করেছি আমরা। উজবেকিস্তানে এত চমৎকার রেলব্যবস্থা, সময়ানুবর্তী, পরিষ্কার প্ল্যাটফর্ম আমাকে ভেতরে-ভেতরে মুগ্ধ করে যাচ্ছিল। ট্রেনে বসে পাশের সারি সারি পাহাড়, বাড়ি, কারখানা দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ১৯৯১-এ সোভিয়েত থেকে আলাদা হওয়ার পর এরা ভালোই এগিয়েছে, সবকিছুতে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষজনও বেশ শিক্ষিত, ছিমছাম, নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত যার যার মতো।

ট্রেন থেকে বুখারা নামার পরের সময়টা আমার পাগল পাগল লাগছিল। এখন লিখতে গিয়ে হাসি পাচ্ছে, কিন্তু ভেবে দেখলাম আসলেই অমন লাগছিল। এত সুন্দর নীল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ কবে শেষ মন ভরে দেখেছি জানি না। তুলি ছাড়া বাস্তবেও যে এত চমৎকার নীল সম্ভব, ওই দিনের আকাশ না দেখলে বিশ্বাস হতো না। নীল আকাশের ছবি তুলতে মোবাইল নিয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিলাম। রেলস্টেশন থেকে বের হতেই দেখি বখতিয়ার সাহেব দাঁড়ানো, পঞ্চাশের আশপাশে বয়স, বুখারাতে আমাদের ট্যুর গাইড। প্রত্যেক শহরেই ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, এমন একজন গাইড নিয়েছি। এতে অনেক দিকে অনেক সুবিধা হয়েছে। যাতায়াতের চেয়েও কখন কোথায় যেতে হবে আর যাওয়ার পর দর্শনীয় কোন স্থাপনা দেখতে হবে, সব ব্যাপারে আগেভাগে পরিকল্পনা থাকায় সময় বাঁচানো গেছে বেশ। এ ছাড়া বেশির ভাগ সময় আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে ঘুরেছি।

গাইড বখতিয়ারের সঙ্গে লেখকের স্বামী মহিউদ্দিন আহমেদ

উজবেকিস্তান নেমেই এয়ারপোর্ট থেকে স্থানীয় সিম নেওয়ার সুবাদে সব সময় ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা, আমাদের যাতায়াত, কোথায় কী স্থাপনা আছে, কোন রেস্তোরাঁ কত দূরে, রিভিউ-রেটিং কেমন, নিজেদের ঘোরাঘুরি সব সহজে হচ্ছিল। গাইড বখতিয়ার প্রচণ্ড প্রাণশক্তিতে ভরপুর, হাসিখুশি অনর্গল কথা বলেন। তাঁর মূল পেশা শিক্ষকতা, ইংরেজির শিক্ষক। পাশাপাশি গাড়ি চালান আর ট্যুর গাইড হিসেবে সেবা দেন। তাঁর জন্য বুখারার সময়গুলো বেশি প্রাণবন্ত ছিল।

বুখারার ওল্ড সিটি ঘিরেই আধুনিক, পুরোনো হোটেল-রেস্তোরাঁ। মধ্য এশিয়ার সিল্ক রোডের পুরোনো শহর বুখারা। এই যুগেও শহরটি এত সুন্দরভাবে সংরক্ষিত থাকাটা দেখার মতো। ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশ আর সোনালি সূর্যের বিপরীতে পুরোনো বুখারার স্থাপনাগুলো দেখতে অদ্ভুত লাগছিল, একেই বুঝি বলে ছবির মতো সুন্দর।

বুখারার ওল্ড সিটির একজন বিক্রেতা

লাবি খউজ কমপ্লেক্স দিয়ে শুরু হলো বুখারা সফর। এটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ১৬ কি ১৭ শতকের একটা পুল। গাইড বলছিল, সোভিয়েত আমলেও এ রকম অনেক পুল ছিল, বিভিন্ন কারণে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এটা রয়ে গেছে। এর চারপাশেই জনপ্রিয় কুকেলদেশ মাদ্রাসা, ডেভন বেগির ধর্মীয় স্থাপনাসহ অনেক স্থাপনা। এই কমপ্লেক্স ঘিরে হোটেল, ছোট ছোট দোকান, স্থানীয় লোকজন আর পর্যটকদের আনাগোনা। সব মিলে পুরো জায়গাটাই ভীষণ প্রাণবন্ত। রৌদ্রোজ্জ্বল হলেও তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রির মতো, সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস, কিন্তু এরপরও অসুবিধা হচ্ছিল না। হয়তো এত কিছু সুন্দর একসঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যাওয়ার আনন্দে ঠান্ডাকেও আর ঠান্ডা লাগছিল না। হাঁটতে হাঁটতে কত কিছু চোখে পড়ল। ছোট ছোট শিশুরা কী সুন্দর ইংরেজিতে কত–কী জিজ্ঞেস করছে। নাম, কোথা থেকে এসেছি, বাংলাদেশ কোথায়—এটা–ওটা কত কথা।

রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খাচ্ছেন সবাই

বুখারার প্রথম দিনে আমরা দ্বিতীয়বারের মতো পোলাও খেলাম। তারা বলে ‘পিলাফ’ বা ‘প্লোভ’। এটা তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা খাবার। প্রথমবার খেয়েছিলাম তাসখন্দে, আমাদের ওখানকার গাইড আদিল নিয়ে গিয়েছিল ‘বেশ কুজন’ নামের এক রেস্টুরেন্টে। বিশাল বিশাল পটে রান্না হয় এই পোলাও। তুলাবীজের তেলে গাজর, কিশমিশ, ছোলা দিয়ে রান্না করা হয় আর পরিবেশন করা হয় গরু, ভেড়া, ঘোড়ার মাংস, কোয়েলের ডিম দিয়ে, সঙ্গে থাকে সালাদ আর নান। এই নান এদের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার, একধরনের বানরুটির মতো। প্রায় সব বেলাতেই দেখলাম এই রুটি পরিবেশন করা হয়, আবার বিক্রিও করা হয় যত্রতত্র। সবাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই রুটি খাচ্ছে। উজবেকিস্তান মরুভূমির দেশ, এখানে সাগর নেই, তাই মাছের বেশ অভাব। কিন্তু তাদের মাংসের এই পোলাও আর বিভিন্ন ধরনের কাবাব বোধ হয় দেশে ফেরার পর সবচেয়ে বেশি মনে পড়বে। অন্তত এই দেশে এসে বাঙালিদের বাঙালি রেস্তোরাঁ খুঁজতে হবে না, অসাধারণ স্বাদ আর কম মসলার রান্না খেয়ে আরাম পাওয়া যাবে নিশ্চিত। অবশ্য নিরামিষভোজী হলে একটু খুঁজে নিতে হবে। খাওয়ার প্রসঙ্গে যখন বলছিই, আরেকটু বলি, এখানে ‘মোমো’কে বলে ‘মানতি’। আমি বোধ করি মানতি খাওয়ার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করিনি। মহি খুব একটা পছন্দ করে না, তাই মোটামুটি পুরো প্লেটই আমার। খাওয়াদাওয়ার জন্য হলেও অন্তত আরেকবার এখানে আসতে চাই ।

(চলবে)