দানিয়ুবতীরে কেন এত জুতার সারি?

দানিয়ুব ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। বয়ে গেছে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের বুক চিরে। দানিয়ুবতীরে হেঁটে এসেছেন শাখাওয়াত হোসেন

হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট ভবন

আক্ষরিক অর্থেই বুদাপেস্ট শহরটাকে দুই ভাগ করে রেখেছে দানিয়ুব। পশ্চিম তীরের অংশটার নাম বুদা এবং পূর্ব তীর পেস্ট, দুইয়ে মিলে বুদাপেস্ট। বুদা অংশে ছিল আমাদের হোটেল। এই হোটেলের লবিতে বড়সড় একটা বিশ্বমানচিত্র ঝোলানো আছে। এই মানচিত্রে হোটেলে আসা অতিথিরা নিজ দেশের ওপর ছোট্ট এক টুকরা কাগজে নাম লিখে পিন দিয়ে আটকে দেন। গিজগিজ করা ট্যাগের ভিড়ে ছোট্ট বাংলাদেশটা খুঁজে নিলাম। ফাঁকা অংশটায় আমাদের নাম লেখা কাগজটা যখন লাগালাম, তখনকার অনুভূতিটা সত্যিই অতুলনীয়!

হোটেলে পৌঁছেই বিকেলে বের হয়ে গেলাম। ওদের বিখ্যাত পার্লামেন্ট ভবনের কাছের মেট্রোস্টেশনে নামলাম। অল্প একটু হেঁটেই পার্লামেন্ট ভবন। বিশাল তার স্কেল এবং ডিটেইলিং। এই ভবনকে বুদাপেস্টের প্রতীকই বলা যায়। পোস্টকার্ড, ফ্রিজ ম্যাগনেট, মগ—সবকিছুতেই এর প্রতিরূপ। হাঁটতে হাঁটতে দানিয়ুবের তীরে চলে এলাম, দক্ষিণ দিক বরাবর হাঁটছিলাম আমরা। নদীর পশ্চিম তীরের দৃশ্য অসাধারণ, তার মধ্যে অস্তায়মান সূর্যের লালচে আভা। এপার থেকে আরেকটা আইকনিক স্থাপত্য দেখা যায়—পাহাড়চূড়ায় ছবির মতো সুন্দর বুদা ক্যাসল। সামনে বেশ দূরে দেখা যাচ্ছে লিবার্টি ব্রিজ। প্রায় ১২০ বছর পুরোনো সবুজ রঙের ব্রিজ। যুগের পর যুগ ধরে নদীর দুই তীরকে যুক্ত করে রেখেছে। নির্মল বাতাস, শেষ বিকেলের রোদ আর স্রোতস্বিনী দানিয়ুব, তার পাশের সুন্দর বাঁধানো পাড় দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা।

জুতাগুলো লোহার তৈরি

হঠাৎ সামনে চোখে পড়ল অদ্ভুত এক দৃশ্য। পাথরবাঁধানো পাড়ে এলোমেলো করে রাখা অনেকগুলো জুতা। চট করে দেখলে মনে হবে অনেক মানুষ এখানে ছিল, হঠাৎ কিছু একটা ঘটায় জুতা ফেলেই হুড়োহুড়ি করে চলে গেছে সবাই। দেখলে মনের ভেতর অজানা আশঙ্কার গভীর এক শূন্যতা তৈরি হলো। একটু কাছে যেতেই বোঝা গেল, জুতাগুলো লোহার তৈরি। মরচে ধরে আছে, কিছু কিছু জুতার ভেতর ঘাসও জন্মেছে। আশপাশে আমাদের মতো আরও কিছু মানুষ। একই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সব দেখে, পরে বুঝলাম আসলে এটা একটা ভাস্কর্য—এক ভয়াবহ স্মৃতির স্মারক।

২০০৫ সালে ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়

১৯৪৪-৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধে ‘অ্যারো ক্রস’ নামক মিলিশিয়া বাহিনী বর্বর এক হত্যাযজ্ঞ চালায় বুদাপেস্টের বুকে। এ সময় প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষকে হত্যা করে নৃশংস বাহিনী। এদের প্রায় সবাইকেই গুলি করে হত্যা করা হয় দানিয়ুবের তীরে দাঁড় করিয়ে। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে জানা যায়, মৃতদেহ যেন সহজে পানিতে ভেসে যেতে পারে, সে জন্য সবার জুতা খুলে হত্যা করা হয়।

২০০৫ সালে সেই দুঃসহ স্মৃতির স্মরণে ভাস্কর্যটি তৈরি করেন ক্যান টোগে ও গলা পয়ার নামক দুজন শিল্পী। ৬০ জোড়া লোহার জুতা, একটা লম্বা পাথরের বেঞ্চি এবং কয়েকটা কাস্ট আয়রনের ফলক ব্যবহার করে ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছে। পাথরে বাঁধানো পাড়ে জুতাগুলো এমনভাবে স্থাপন করা, দেখলেই মনের ভেতর অজানা আশঙ্কায় এক ভয়াবহ শূন্যতা তৈরি হয়।