ভিনদেশি পর্যটকদের ঢাকা ও আশপাশের ঐতিহ্য, প্রকৃতি, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ঘুরিয়ে দেখান মেহেদী হাসান। কাছের মানুষদের কাছে যিনি রকি নামেই পরিচিত বেশি। অতিথি চাইলে সিলেট, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী বা অন্য জেলাতেও নিয়ে যান। গাইডের কাজটা তিনি নিজে নিজেই শুরু করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষে সেটাই হয়ে উঠেছে ক্যারিয়ার। সজীব মিয়াকে নিজের ট্যুর গাইড জীবনের গল্প বললেন মেহেদী হাসান
ই-মেইলটা পড়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। পাঁচ বছরে অনেক বিদেশির মেইলই পেয়েছি, জবাব দিতে কখনো দ্বিধা হয়নি। কিন্তু জেফ্রি ক্লাইন নামে যে আমেরিকান মেইল করেছেন, তাঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটু চ্যালেঞ্জিং, তাই এই খটকা।
সত্তরোর্ধ্ব মানুষটা তারুণ্যে কোনো এক রোগে আক্রান্ত হয়ে হুইলচেয়ার সঙ্গী করে নিয়েছেন। এখন ১০-২০ কদমের বেশি হাঁটতে পারেন না। বিশ্বের শতাধিক দেশ ঘুরেছেন, বাংলাদেশেও আসতে চান, দেখতে চান ঢাকার আশপাশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরের কাছে মেইল করে তেমন সাড়া পাননি। আমি দুই মিনিট ভেবে উত্তর দিলাম—শ্রদ্ধেয় জেফ্রি, নির্ভয়ে চলে আসুন, আমি আপনাকে বাংলাদেশ ঘুরিয়ে দেখাব।
প্রায় চার মাস আগে বুকিং করে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা আসেন জেফ্রি। বিমানবন্দর থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁকে জিজ্ঞেস করি, এই বয়স, এই ভঙ্গুর শরীর নিয়েও কেন ভ্রমণ করেন?
জেফ্রির কণ্ঠে কৌতুক, ‘ঘরে বসে বসে সিলিং দেখার চেয়ে ঘুরে বেড়ানোই বেশি ভালো না!’
ব্যক্তিগত বিষয়ে আর কথা বাড়াই না।
পরদিন সকালে আমরা পানামনগর ঘুরে দেখতে যাই। এরপর বড় সরদারবাড়ি। অনেক জায়গাতেই অসুবিধায় পড়তে হলো। আসলে আমাদের পর্যটনস্থানগুলো হুইলচেয়ারে ঘুরে দেখার উপযোগী নয়। অনেক জায়গায় সহযোগী মিলে হুইলচেয়ারসহ জেফ্রিকে তুলে নিয়ে যেতে হলো।
দেখতে দেখতে চার দিনের ট্যুর শেষ হয়ে যায়। জেফ্রিকে বিদায় জানিয়ে মনে হলো, তাঁর মতো মানুষের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
২০১৯ সাল থেকে বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে কাজ করছি। তাঁদের ঢাকা ও আশপাশের গ্রাম, ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি, দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখাই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চেক প্রজাতন্ত্র, বেলজিয়াম, আয়ারল্যান্ড, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অতিথি হিসেবে পেয়েছি। নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে জেফ্রির মতো মানুষের কথা আলাদা করে মনে থাকে। যেমন মার্তে ভাদলা ও এলিসিয়া গার্সিয়ার কথা অনেক দিন মনে থাকবে। নরওয়ে থেকে এসেছিলেন তাঁরা। সেখানে তাঁরা একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও এলিসিয়ার বাড়ি স্পেন।
বুকিংয়ের সময়ই বলে দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের মতো ঘুরতে চান। কথামতো কখনো সিএনজি, কখনো রিকশা, অনেক সময় হেঁটেও ঢাকা-কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়েছি। কিন্তু তাঁদের আগ্রহ ছিল মেঘনার ওপারের কুমিল্লার একটি চর। আমিই এই গ্রামের কথা তাঁদের বলেছিলাম। সঙ্গে এ–ও বলেছিলাম, আবহাওয়া ভালো না থাকলে যাব না।
সেদিন ঘাটে গিয়ে দেখি আবহাওয়া সুবিধার নয়। কিন্তু দুজন নাছোড়। দুরুদুরু বুকে নৌকায় উঠি। সাধারণত বিদেশি পর্যটক নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না। কিন্তু তাঁদের অনুরোধও ফেলতে পারিনি। ঝুঁকি নিয়েই চরে পৌঁছাই। বিকেলটা গ্রামে ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে ফুটবল খেলে দারুণ মজা করেন তাঁরা। তবে চর থেকে ফেরার সময় ঘটে বিপত্তি। নদীর মাঝ বরাবর আসার পর শুরু হয় ঝড়। আতঙ্কে আমার গা হিম হয়ে আসে। এর মধ্যেই এগোতে থাকে নৌকা। দুলতে দুলতে কোনোমতে জেটির কাছে পৌঁছায় নৌকা। সেখানেই বসে থাকি ঝড় থামা পর্যন্ত।
প্রত্যেক পর্যটকের সঙ্গেই কোনো না কোনো স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরি। মাঝেমধ্যে ছবিগুলো দেখলে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।
২০১৮ সাল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে পড়ি। সরস্বতী পূজার সময় আলোকোজ্জ্বল ক্যাম্পাসে একদিন দেখি দুজন বিদেশি পর্যটক। সঙ্গে একজন বাংলাদেশি। বিদেশি পর্যটকদের নানা বিষয়ে বলছেন তিনি, ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। মনে হলো, কাজটা তো আমিও করতে পারি! আমিও তো বিদেশিদের এভাবে দেশ দেখাতে পারি!
এরপর সেই গাইডের কথা ভুলে যাই। আবার নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই আহসান মঞ্জিল ঘুরতে গেছি। সেখানে কিছু বিদেশি পর্যটক দেখতে পাই। তাঁদের সঙ্গেও দেখি একজন গাইড। সেদিনও গাইডের কাজটি নিয়ে খুব আগ্রহ জাগে। বাড়ি ফিরে ইন্টারনেটে খুঁজতে থাকি কীভাবে বিদেশি পর্যটকদের গাইড হওয়া যায় অথবা তাঁদের সঙ্গে কাজ করা যায়। কিন্তু তেমন কোনো সূত্রই পাই না। তবে বিদেশি পর্যটক নিয়ে কাজ করে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম খুঁজে পাই। তাদের কাছে সিভি পাঠাই। কিন্তু কোনো সাড়া মেলে না।
সিদ্ধান্ত নিই নিজেই নিজেকে গাইড হিসেবে গড়ে তুলব। ঢাকা থেকেই শুরু করি। এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার কিছু জনপ্রিয় পর্যটন স্থান ঘুরে আসি। ইন্টারনেট ও বই পড়ে সেসব জায়গার ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। বিদেশি গাইডেরা কীভাবে কাজ করেন জানার চেষ্টা করি। এরপর ‘চলো বাংলাদেশ ট্যুরস’ নামে ফেসবুক পেজ, গ্রুপ আর ওয়েবসাইট বানিয়ে শুরু করি কাজ। দুই হাজার টাকায় শুরু করা সেই প্রতিষ্ঠানই এখন আমার ধ্যানজ্ঞান–স্বপ্ন।
অনেক দিন কেটে যায়। বিদেশি কোনো পর্যটকের সাড়া নেই। তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকি। একদিন ভারতের এক পর্যটক যোগাযোগ করেন। সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, কিন্তু বাংলাদেশে আসার আগে তাঁর মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ভ্রমণ বাতিল করেন। এরপর মালয়েশিয়া থেকে দুই পর্যটক বুকিং করেন। সেটাও অজানা কারণে বাতিল হয়ে যায়। একের পর এক বুকিং বাতিল হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ি। একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিই। বিদেশি পর্যটকের আশা ছেড়ে তখন ছুটির দিনগুলোতে দেশের মানুষ নিয়েই সাজেক, রাঙামাটি, সেন্ট মার্টিনসহ নানা জায়গায় ঘুরতে শুরু করি।
কয়েক মাস এভাবে চলার পর নেপাল থেকে নেত্র নামের একজন যোগাযোগ করেন। তিনি নিজেও তাঁর দেশে ট্যুর গাইড। বাংলাদেশের কিছু জায়গা ভ্রমণ করতে চান। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকা আসেন নেত্র। আমার প্রথম বিদেশি পর্যটক। সাত দিনের ভ্রমণে তাঁকে নিয়ে ঢাকা, সোনারগাঁ, রাজশাহী, নওগাঁ এবং বগুড়া ঘুরে বেড়াই। সেই ট্যুরে ৮৫০ ডলার পাই। সেই এপ্রিলেই নেত্রর মাধ্যমে অস্ট্রেলীয় এক পর্যটককে পেয়ে যাই। আস্তে আস্তে ব্যস্ততা বাড়ে। মাঝে নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে আসে করোনা। তবে সবকিছু সামলে এগিয়ে চলছে আমার স্বপ্নযাত্রা।
চলো বাংলাদেশ ট্যুরসের মাধ্যমে প্রতি মাসেই এখন ১০-১৫ জন অতিথি পাই। ভ্রমণ মৌসুমে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। আমার সঙ্গে চারজন খণ্ডকালীন গাইড আছে। পড়াশোনার ফাঁকে তাঁরা সময় দেন।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের চাকরিটা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। সেখানে যা বেতন পেতাম, তার চেয়ে গাইড হিসেবে আয় এখন কয়েক গুণ বেশি। কাজের স্বাধীনতা, নিজের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর আনন্দ তো আছেই। সেই আনন্দ নিয়েই এগিয়ে নিতে চাই।