আমাদের বয়স ৬৩ থেকে ৬৭, আমরা এসেছি এভারেস্টে

যে বয়সে বাড়ির কাছের পার্কটাকেও অনেকের মনে হয় দূরের গন্তব্য, সেই বয়সে হিমালয় অভিযানে গিয়েছিলেন তিন বাংলাদেশি। পার্বত্য পথে দুই সপ্তাহ হেঁটে হেঁটে শেষ করেছেন এভারেস্ট বেজক্যাম্প অভিযান। ষাটোর্ধ্ব বয়সে হিমালয়ে গিয়ে কেমন অভিজ্ঞতা হলো, তা–ই লিখলেন অভিযাত্রীদের একজন ইফতেখারুল ইসলাম

এভারেস্ট বেজক্যাম্পের পথে লেখক

দ্বিতীয়বার এভারেস্ট বেজক্যাম্পে (ইবিসি) যাচ্ছি—এই ভাবনা অন্যদের জানাতে দ্বিধা হয়, সবাই পাগল বলবে। বয়স ৬৭ পেরিয়েছে। তবু এবার ইবিসি ট্রেকের সঙ্গে অমা দবলাম বেজক্যাম্প যোগ করেছি। একটা নতুন গন্তব্যের কথা বললে যাওয়ার যুক্তি জোরদার হয়। ফাঁক দিয়ে টুক করে ইবিসিটাও আরেকবার ঘুরে আসতে পারব। 

এবার যোগ দিয়েছেন জালাল আহমেদ ও এনাম চৌধুরী। এভারেস্ট-দর্শন তাঁদের স্বপ্ন। দুজনেই নিজ নিজ কাজে খ্যাতিমান, প্রতিষ্ঠিত। দুজনেরই বয়স আমার চেয়ে কম। ৬৩ থেকে ৬৪ বছর। আমিও তো ঠিক ওই বয়সেই প্রথমবার ইবিসিতে গিয়েছিলাম। তাহলে এঁরাও পারবেন। কয়েক মাস খাওয়া কমিয়ে, অতিরিক্ত হেঁটে ওজন কমিয়ে তাঁরা তৈরি। ট্রেকিং বুটস, পোশাক ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছেন। 

ইবিসি মাঝারি ধরনের কষ্টকর ট্রেক। তা-ও তিন বয়োজ্যেষ্ঠর পক্ষে ১৫ থেকে ১৬ দিনের ট্রেকে সুস্থ থেকে ৫ হাজার ৩৬৪ মিটার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারা সহজ কাজ না। এই ট্রেকে কয়েকটা দীর্ঘ আরোহণের দিন আছে। কাঠমান্ডু থেকে ১৭ এপ্রিল ভোরে সীতা এয়ারের ছোট্ট বিমানে লুকলা পৌঁছাই। এখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন হরি, আমাদের গাইড। সঙ্গে পোর্টার।

লুকলা থেকে ফাকদিং ট্রেক তুলনামূলকভাবে সহজ। সকালে পথে নেমে দেখি চমত্কার রোদ, দূরে ঝলমল করছে চেনা পর্বতশিখর। গত কয়েক বছরে দুবার এ পথে ট্রেক করেছি বলে এটা আমার চেনা। 

কিছুক্ষণ ট্রেক করে চলার পর দুধকোশি নদীর কলস্বর শুনতে পাই। মাঝেমধ্যে দেখি পার্বত্য নদীর দুধসাদা স্রোত কীভাবে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে। 

পরের দুদিন পথে বেশ কটা ঝুলন্ত সেতু পার হতে হয়। অনেকটা চড়াই ধরে ওপরে উঠে হিলারি ব্রিজ পার হই। এবারের ট্রেকে প্রতিদিন আবহাওয়া ভালো বলে নিচের নদী, চারপাশের পাইনবন আর দূরের পর্বতশিখর দেখা গেছে সারাক্ষণ। এমনকি নামচেবাজার পৌঁছানোর আগেই দুটো জায়গা থেকে আমরা এভারেস্ট দেখতে পাই। অনেক দূরে সে শিখর। ছোট কিন্তু স্পষ্ট। নামচেবাজারে সাগরমাথা মিউজিয়ামের বাইরে ৩ হাজার ৪৪০ মিটার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে বিশ্বাস হয়, আমরা তিন প্রবীণ সত্যিই এভারেস্টের পথে ট্রেক করে চলেছি। 

ট্রেকিংয়ে তিন অভিযাত্রী

যার যার গতিতে চলি

সকালে তিন অভিযাত্রী একসঙ্গে ট্রেকিং শুরু করলেও যার যার গতিতে চলি আমরা। কখনো পাথর ডিঙিয়ে চড়াই ধরে উঠি, কখনো পাইনবনের ভেতর হাঁটি। নীল আকাশের গায়ে খানতেগা, কুসুমখ্যাং, থামশেরকু, অমা দবলাম, লোৎসে ও এভারেস্ট দেখে ছবি তোলার জন্য দাঁড়াই। কোনো লজে হানি জিঞ্জার লেমন চায়ের জন্য বিরতি নিই। তিনজন একত্র হই। ছবি তুলি। আবার ট্রেক শুরু করি। উচ্চতার কারণে বাতাসে অক্সিজেন কমে আসছে। ওপরে ওঠার সময় আমরা অল্পেই হাঁপিয়ে উঠি। বিরতি নিই। ওপরে-নিচে তাকিয়ে দেখি সঙ্গীরা কে কোথায় আছেন।

নামচে থেকে ট্যাংবোচে হয়ে দেবুচে। সেখানে সূর্যাস্তে স্বর্ণকেশী অমা দবলাম দেখি। পরের দিন সকালে তিন ঘণ্টা ট্রেক করে আমরা পৌঁছাই ৪ হাজার মিটারে প্যাংবোচে। ইবিসিতে যেতে এখানে থামার দরকার নেই। আমরা থামছি, কারণ আমার প্রথম লক্ষ্য অমা দবলাম বেজক্যাম্প এখান থেকে কাছে। জালাল ভাই ও এনাম ভাইয়ের লক্ষ্য শুধু ইবিসি। ২৩ এপ্রিল তাঁরা অ্যাক্লাইমেটাইজেশন হাইক করে উঁচুতে একটা গ্রাম দেখে এলেন। আমি গেলাম অমা দবলাম বেজক্যাম্পে। 

তাপমাত্রা সেদিন হিমাঙ্কের নিচে। কোথাও চড়াই। কোথাও প্রবল বাতাস। প্যাংবোচে থেকে উঠে আসার পর বেজক্যাম্প পর্যন্ত কোনো টি-হাউস নেই। তিন ঘণ্টার ট্রেক শেষে ৪ হাজার ৬০০ মিটার উঁচুতে বেজক্যাম্প। বাতাসে ক্যাম্পের পতাকা ও প্রেয়ার ফ্ল্যাগ পতপত করে উড়ছে। এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে তক্ষুনি ফিরতে ইচ্ছা করে না। একটা তাঁবুতে বসে মাতা-কন্যার যুগল শিখরের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। অমা দবলাম অর্থ মায়ের গলার হার। 

পরদিন থেকে আবার আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে মন দিই। দিনে দুবার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ও পালস মেপে দেখা হয়। জালাল ভাই ও এনাম ভাইয়ের শরীর ভালো আছে। কারোরই উচ্চতাজনিত অসুস্থতা, মাথাব্যথা, বুকে ব্যথা, বমি এসব লক্ষণ নেই। ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হলেও দুজনেই দারুণ উত্সাহের সঙ্গে নিজের গতিতে চড়াই–উতরাই পার হয়ে চলেছেন প্যাংবোচে থেকে ডিংবোচে। সেখানে অ্যাক্লাইমেটাইজেশন সেরে পরদিন লোবুচে। 

পার্বত্য পথে এগিয়ে চলা

পাথরে লেখা নাম

মাঝেমধ্যে জালাল ভাই আমার চেয়ে দ্রুত ট্রেক করেন। বিচিত্র বিষয়ে অসংখ্য বই পড়ে সেসব মনে রাখা ও যথাসময়ে তথ্য তুলে ধরার ক্ষমতা তাঁর অসামান্য। দিনের ট্রেক শেষে বিকেলে ফ্লাস্ক ভর্তি মিন্ট টি নিয়ে আমরা ডাইনিং রুমে বসি। পাঁচটা বাজলে ফায়ারপ্লেসে ইয়াক-ডাং বা কাঠের টুকরা ঢুকিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। সে উষ্ণতায় আমাদের গল্প জমে ওঠে। 

লোবুচের ট্রেকে অনেকখানি খাড়া চড়াই। দুপুরের পর থুকলা পাসে পর্বতারোহীদের স্মরণস্তম্ভগুলোর কাছে পৌঁছে জালাল ভাই খুঁজে বের করলেন সজল খালেদের স্মৃতিফলক। এভারেস্টজয়ী এই পর্বতারোহী শিখর থেকে নেমে আসার সময় এভারেস্টেই হারিয়ে যান। স্মৃতিফলকটি ছোট। পাথর থেকে নাম মুছে গেছে। কিন্তু আমাদের হৃদয়জুড়ে আছেন তিনি। 

৫ হাজার ৩০ মিটারে লোবুচের রাত ছিল তীব্র ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো। বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ১২ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লজের পাথরের দেয়াল বাইরের বাতাস কিছুটা ঠেকিয়ে রাখে। তবু স্লিপিং ব্যাগের ভেতরটা যথেষ্ট উষ্ণ হয় না। আমাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কয়েক দিন ধরেই কমছে। বিকেলে লোবুচে পৌঁছানোর পর আমার অক্সিজেন ৮১ শতাংশ আর নাড়ির স্পন্দন ৮৯। জালাল ভাই ও এনাম ভাইয়ের অবস্থা সামান্য ভালো। হরি বলছে, ভোর সাড়ে ছটায় ব্রেকফাস্ট। সাতটায় ট্রেক শুরু করব আমরা। যেভাবেই হোক কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে হবে। 

এভারেস্ট বেজক্যাম্পে অভিযাত্রীরা

আজই এভারেস্ট বেজক্যাম্প

২৭ এপ্রিল ভোর সাতটায় আমরা প্রতিদিনের মতো পথে নামি। লজের সামনে ছবি তুলে ট্রেকিং শুরু। আজ গোরাকশেপ। আজই এভারেস্ট বেজক্যাম্প। ট্রেকের প্রথম অংশটা নেপালি সমতল। পুমোরি নামে দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ের সামনে দিয়ে যাই। পাথরের ওপর দিয়ে ট্রেক করি। হিমবাহের মোরেন বা গ্রাবরেখা ধরে চলি। ট্রেকটা খুব কঠিন না হলেও উচ্চতা ও অক্সিজেন-স্বল্পতার কারণে হাঁপিয়ে যাই আমরা। গোরাকশেপ পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। পরিশ্রান্ত হলেও আজই আমরা ইবিসি সেরে আসব। 

গোরাকশেপ থেকে ইবিসি পর্যন্ত পাথুরে পথ। তুষার নেই। চলার পথ চেনা যায় না। কোনো কোনো জায়গায় হিমবাহের ওপর দিয়ে ট্রেক। ডান দিকে বিস্তীর্ণ খুমবু হিমবাহ। অপর পাড়ে তুষারঢাকা পর্বতশিখর। আরও দূরে লোৎসে। সবার ওপরে এভারেস্ট। সেদিক থেকে প্রায়ই ভেসে আসে বরফধসের গর্জন। পায়ের নিচে পাথরের তলদেশে হিমবাহের বরফ গলার শব্দ। মাঝেমধ্যে আমাদের ট্রেকের পথের অংশ বিকট শব্দ করে ধসে পড়ে। চারদিক ভয়ংকর সুন্দর। ছবি তোলার মতো সময় নেই, তবু একটু থেমে এই অপরূপ প্রকৃতি দেখতে ইচ্ছা করে। 

একটু দূরে খুমবু হিমবাহের গা ঘেঁষে ছোট ছোট হলদে তাঁবু। কাছে গেলে তাঁবুগুলো বড় হয়। প্রেয়ার ফ্ল্যাগ ও ক্যাম্পের পতাকা উড়ছে। এভারেস্ট বেজক্যাম্প লেখা পাথরটির সামনে বেমানান রঙিন সাইনবোর্ড। পাথরের স্তূপ পেরিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। জালাল ভাই আগে পৌঁছেছেন। একটু পরে এলেন এনাম ভাই। তিন বয়স্ক বালক সজল চোখে একে অপরকে জড়িয়ে ধরি। আমরা এসেছি—হিমালয়ের হিমবাহে, যেখানে এভারেস্ট।

চারদিকের পর্বতশিখর ও নিস্তব্ধতা আমাদের স্বাগত জানায়।