নদীর জলে পাথরের খুনসুটি দেখতে দেখতে ওকোনালুফটি দ্বীপে কাটিয়ে এলাম বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ একটি দিন। নর্থ ক্যারোলাইনার পশ্চিমে পার্বত্য এলাকা চেরোকির অঞ্চলটি ডালপালাবিস্তারী গাছের ছাউনি দিয়ে ঢাকা। নিচে ঘাস বিছানো প্রান্তর। পাশেই আকাশছোঁয়া নিবিড় বাঁশবন। ঘাসবিছানায় শুয়ে শুয়ে জলের সংগীত শুনতে শুনতে দেখেছি পাহাড়ি প্রজাপতির ওড়াউড়ি। ওকোনালুফটি নদীর জলে ভাসমান হাঁসগুলো তাদের শান্তি আমাদের হৃদয়েও সংক্রমিত করছে। আর জলছোঁয়া বাতাস প্রাণে ছড়িয়ে দিয়েছে আনন্দ।
নর্থ ক্যারোলাইনার বেলমন্ট থেকে চেরোকি ১৫৮ মাইল, তিন ঘণ্টার পথ। ১৯ মে ছিল রোববার, ছুটির দিন। ৬ লেনের প্রশস্ত মহাসড়ক ধরে যেতে যেতে কখনো পাহাড়ের খাঁজে, কখনো চূড়ায়, কখনো পাদদেশে দেখেছি প্রকৃতির বিচিত্র রূপ। পাহাড়ি চড়াই-উতরাইয়ে নিবিড় বনাঞ্চল। পাহাড়ের অন্তহীন তরঙ্গ। বাঁকে বাঁকে বুনো হরিণের অবাক তাকিয়ে থাকা। পাহাড়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চলার সময় মনে হয়েছে মেঘ বিছানো আকাশপথে উড়ে চলেছি। কখনো কখনো মেঘ হাতের নাগালে এসে আমাদের আড়াল করে দিয়েছে। কখনো বৃষ্টি ঝাপসা করে দিয়েছে দৃষ্টিপথ। আর বেশির ভাগ সময় কোমল রোদ্দুরে ঝলমল করছিল প্রকৃতি।
চেরোকির একটি পাহাড়ি নদীর নাম ওকোনালুফটি। এ নদীর গর্ভে জন্ম নিয়েছে ওকোনালুফটি দ্বীপ। নদীকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে দ্বীপটির মাটি। এখান থেকেই নদীর দুটি ধারা দুই দিকে চলে গেছে। মাঝখানে সবুজ, আর তাতে রাজ্য বিস্তার করেছে পাখি, কাঠবিড়ালি, প্রজাপতিরা। উজানের দিকে নদীটির এক প্রবাহ। পাহাড়ি ঝরনার মতো। তুকাসেগি নামের আরেকটি নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে এটি চেরোকির বিভিন্ন পাহাড়ি পথকে সজল করে রেখেছে। আমরা যেখানে এসেছি, সেখানেই এটি দুই ভাগ হয়েছে। একটি মুখের দুটি চোখ থেকে যেন জলের ধারা নেমে চলেছে।
ওকোনালুফটির তীরে নির্দিষ্ট জায়গায় যখন গাড়ি পার্ক করলাম, তখন দুপুর। যুক্তরাষ্ট্রের পথেঘাটে, রাস্তায় এমনকি আবাসিক এলাকাগুলোয় সব সময় মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। সারি সারি গাড়ি দেখি, সুন্দর সাজানো-গোছানো বাড়ি দেখি, সবুজ গাছপালা দেখি। কিন্তু মানুষ দেখি না। কিন্তু এখানে এসে মানুষ দেখলাম। নদীর ধারা যেখানে দুই ভাগ হয়েছে, তার স্বচ্ছ অগভীর জলে নেমে শিশুরা খেলছে। সঙ্গে অভিভাবকেরা রয়েছেন। কেউ কেউ সাঁতার কাটছে। বড়শি দিয়ে কেউ মাছ ধরছে। পানির স্বচ্ছতা মাছগুলোর বিচরণকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। মনে হচ্ছে যেন প্রাকৃতিক অ্যাকুরিয়াম দেখছি। অনেকে এখানে মাছের জন্য খাবার নিয়ে আসে। কেউ কেউ ভাসমান হাঁসগুলোকে খাবার দিচ্ছে। নদীর তলায় সব ছোট-বড় পাথর। সেখানে সাবধানে পা ফেলে কেউ হাঁটু, কেউ কোমর পর্যন্ত শরীর ডুবিয়ে মজা করছে। তীরের সবুজ প্রান্তরে মানুষের বসার জন্য চেয়ার-টেবিল। ছাউনি দেওয়া একটা জায়গায় দেখলাম একদল তুর্কি। পিৎজা দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারছে। দল বেঁধে পিকনিক করতে এসেছে তারা।
এত মানুষ, কিন্তু কোলাহল নেই। নীরবে সবাই যে যার আনন্দ করছে। এত বড় একটা পিকনিক স্পটে এসে মাইক বাজতে না দেখে বাঙালি হিসেবে একটু অবাক হলাম। বড় একটা ওকগাছের তলায় সাজানো আসনে বসে খাবার সেরে নিলাম। এখানে আসব বলে মেয়ে খুব ভোরে উঠে ছাগলের মাংসের বিরিয়ানি বানিয়েছে। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘাসের বিছানায় বসে নদীর অবিরাম কলকল শুনছিলাম। চোখ বন্ধ করে ফেলে আসা পথের নানা দৃশ্য আর পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা ওকোনালুফটির পথচলা প্রত্যক্ষ করছিলাম। প্রকৃতির লীলাভূমি চেরোকির রহস্যময় ধূমায়িত পাহাড়গুলো যেন ইশারায় ডাকছে। গাছগুলো তাদের বহুবর্ণী পাতা নেড়ে নেড়ে আমায় তাদের ঘ্রাণ নিতে বলছে। আমি কান পেতে রইলাম। যেন শুনতে পেলাম পর্বতের চূড়ার বাসিন্দা নুন্নেই জাতিগোষ্ঠীর কোনো প্রবীণের প্রার্থনাসংগীত।
রেড ইন্ডিয়ান এক শিশুর হর্ষধ্বনিতে আমার ঘোর কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্নতা কেটে গেল। স্বচ্ছ পানির ওপর পাথর ছুড়ে দিয়ে সে মজা নিচ্ছিল। পাথরের আঘাতে পানি লাফিয়ে উঠে কয়েক ফোঁটা আমার মুখও ছুয়ে গেল। শিশুটির দিকে হাসি মুখে তাকালাম। এখানেই কোথাও রয়েছে রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রাম। তার মা আমার দিকে মিষ্টি হেসে শিশুর এমন আচরণে লজ্জা প্রকাশ করলেন। শিশুটি ততক্ষণে পানিতে নেমে গেছে। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম। শীতল পানি। হাঁটু পর্যন্ত নেমে আঁজলা ভরে নিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললাম।
মনপ্রাণজুড়ানো একটা অনুভূতি নিয়ে পানি থেকে উঠে হাঁটতে লাগলাম। বিভক্ত হয়ে যাওয়া নদীর একটি ধারার পাশে নিবিড় বাঁশবন। বাঁশের উচ্চতা ৪০ ফুটের ওপর। বাঁশঝাড়ে বাতাস এসে লাগলে শোনা যায় শর শর ধ্বনি। পানির সুরের সঙ্গে সেই ধ্বনি মিশে এক মিলিত কোরাস সংগীতের সৃষ্টি করে। আমরা বাঁশবনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে দেখি পর্যটকদের আনাগোনা। এখানে পথ চলতে হয় সাবধানে। মাটি ফুঁড়ে কাঁটার মতো উঠে আসছে বাঁশের শিশু। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার জনপ্রিয় সবজি বাঁশকোঁড়ল। এখানেও চল আছে কি না ভাবতে ভাবতেই দেখি একটি পরিবার বাঁশকোঁড়ল সংগ্রহ করছে। বাইরের আবরণটা ফেলে ভেতরের সাদা শাঁসটুকু বের করে তার ছেলেমেয়েদের খেতে দিচ্ছে। আমরা তো রান্না করে খাই। এরা তো দেখি কাঁচাই খেয়ে ফেলছে। ওদের খেতে দেখে শুভ (মেয়ের বর) জানতে চাইল, স্বাদ কেমন?
নারী উত্তর দিলেন, কোনো স্বাদ নেই। মিষ্টি, তিতা, টক, নোনতা কিছুই না।
তবে খাচ্ছ যে? এর কি কোনো খাদ্যগুণ আছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ এর ভেতরে ভিটামিন ডি, সি আছে, এটা রুচি বাড়ায়।
বললাম, আমাদের দেশে এটা একটা জনপ্রিয় সবজি। আমরা রান্না করে খাই।
তিনি খুশিতে ওয়াও বলে আমাদের কয়েক টুকরো খেতে দিলেন। সাগ্রহে মুখে নিলাম। নরম অথচ কোনো স্বাদ নেই। উল্টা গলা চুলকাতে লাগল। মহিলাটি তাকিয়ে আছে কি না দেখলাম। তারপর বাঁশবনের দিকে ছুড়ে মারলাম।
একটি নদী, তার দুটি ধারা। যমজ বোনের মতো অবিরাম মানুষকে গান শুনিয়ে চলেছে। গ্রীষ্মে আমাদের দেশে সন্ধ্যা হয় সাতটার দিকে। আর এখানে সাড়ে আটটার পর। এ রকম একটা পরিবেশে বিকেল যতই প্রলম্বিত হয়, ততই ভালো লাগে।