সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন অষ্টম পর্ব
চোখ মেলে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জাহাজের ডাক্তার আর তিন ক্রু। আর আমি আমার কেবিনের বিছানায় শুয়ে আছি।
‘রেস্তোরাঁর সামনে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলে তুমি। আমরা কেবিনে এনে শুইয়ে দিয়েছি,’ ডাক্তার বললেন।
চোখ বন্ধ করে ভাবছি, কিন্তু আমি আবার রেস্তোরাঁয় গেলাম কখন?
মনে পড়েছে। ল্যাপটপ নিয়ে লিখতে বসব ভাবছিলাম, কিন্তু জাহাজ এমন উন্মাদের মতো দুলছিল যে কোনোভাবেই ল্যাপটপ ঠিক রাখতে পারছিলাম না। এরই ফাঁকে কয়েক দফা বমিও করেছি। শেষমেশ মেজাজ খারাপ করে ল্যাপটপ রেখে দিই। কয়েকবার বমি করার পর ভাবলাম একটা সি-সিকনেস পিল খাই। কিন্তু খালি পেটে তো আর পিল খাওয়া যাবে না। তাই কুকিজ আনতে গিয়েছিলাম জাহাজের রেস্তোরাঁয়। তারপর আর কিছু মনে নেই।
ডাক্তার আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমরা এখন ড্রেক প্যাসেজ পার হচ্ছি। এটাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে রুক্ষ সমুদ্র। আর্জেন্টিনা থেকে অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার এই প্যাসেজের একটি উপাধি আছে, ‘কুখ্যাত ড্রেক প্যাসেজ’। অসুস্থতার কারণে যে দুটি ওরিয়েন্টেশনে অংশ নিতে পারোনি, তোমার জন্য পরে আবার তার ব্যবস্থা করব। একজন ক্রু সর্বক্ষণ তোমার রুমের আশপাশেই থাকবে। আর একটা বিষয়। বমি হলেও খেতে হবে। খেলে তোমার পাকস্থলী ব্যস্ত থাকবে। আর পাকস্থলী ব্যস্ত থাকলে মস্তিষ্ক সচল থাকবে।’
আসলে সব নষ্টের গোড়া ওই ড্রেক প্যাসেজ। এটি মূলত দক্ষিণ আমেরিকার কেপ হর্ন, চিলি, আর্জেন্টিনা এবং অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণ শ্যাটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের মধ্যবর্তী পানির অংশ। এটি আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে এবং বয়ে গেছে দক্ষিণ মহাসাগর পর্যন্ত। ইংরেজ অভিযাত্রী স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক একবার এক অভিযানে জাহাজ নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করেন। একপর্যায়ে শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। ঝড়ের তোড়ে জাহাজ ভেসে গেল বেশ দক্ষিণে। তিনি ভাবলেন এ আমি কোথায় এলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের তরঙ্গ তো এমন উঁচুতে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে না! সেদিন ড্রেকের জাহাজ যে অজানা পথে প্রবেশ করে সেটিরই নাম হয়ে যায় ‘ড্রেক প্যাসেজ’। এই ঘটনা ইংরেজ অভিযাত্রীদের কাছে এটাই প্রমাণ করল যে দক্ষিণ আমেরিকার আরও দক্ষিণে উন্মুক্ত জলরাশি আছে।
‘ড্রেক প্যাসেজ’ নামটি ইংরেজদের দেওয়া। স্পেনীয়রা একে বলে ‘মার দে ওসেস’। কারণ, তারা মনে করে ইংরেজদের আগেই স্পেনীয় অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো দে ওসেস এটি আবিষ্কার করেছেন। তবে আমার মতো অভিযাত্রীরা এর আরেক নাম দিয়েছে ‘বিশ্বাসঘাতক’। কেউ কেউ রসিকতা করে একে বলে ‘সমুদ্রের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিসার’। সমুদ্রের এ অংশে ঢেউ হয় ৪০ ফুট পর্যন্ত উঁচু।
প্রতিদিন নিয়ম করে দুবার আমাকে দেখতে আসে ডাক্তার। আমিও তাঁকে নিয়ম করে দুবার মিথ্যা বলি। আমি বলি আমি তাঁর দেওয়া সবুজ আপেল খেয়েছি। আমার মতো এক দুর্বল মানুষকেও তিনি হাত উঁচিয়ে বলেন, ‘ইউ আর আ স্ট্রং লেডি, অ্যান্টার্কটিকা ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।’
জাহাজ খুব বেশি দুলছে। শরীরের ওপরের অংশ বিছানা থেকে ওঠানো মুশকিল। উঠতে গেলেই বমি হওয়ার আশঙ্কা প্রকট হয়। বিছানা থেকে ওয়াশরুমের দূরত্ব বড়জোর পাঁচ হাত। সেটুকু যেতে গিয়েও মাতালের মতো মেঝেতে পড়ে যাই। হামাগুড়ি দিয়ে ওয়াশরুমে যাই।
আমাদের গাইড মারিয়া আমার কক্ষে আসে। আমার যে জিনিসপত্র অপারেশনে ব্যবহৃত হবে, সেগুলো নিজ হাতে সেনিটাইজ করবে। অ্যান্টার্কটিকায় অভিযাত্রীরা পাহাড়ে হাইকিং করে, সাগরের ঠান্ডা পানিতে ঝাঁপ দেয়, কায়াকিং করে, ক্যাম্পিং করে। অভিযাত্রার ভাষায় এগুলোর এক একটিকে বলে অপারেশন। অসুস্থতার কারণে আমি কিছু প্রশিক্ষণ নিতে পারিনি, তাই শেখাতে আমার কক্ষে এসেছে মারিয়া। আমরা দুজন মেঝেতে বসেছি। অপারেশনে যাওয়ার সময় যে ব্যাগটা আমার পিঠে থাকবে, মারিয়া প্রথমে সে ব্যাগটা দুমড়েমুচড়ে উল্টেপাল্টে ভেতরে-বাইরে সম্পূর্ণ সেনিটাইজ করল। আমাদের কাপড়ে এবং জিনিসপত্রে ধুলাবালি ছাড়াও একধরনের র্যাশ পড়ে। আমার ব্যাগের ভেতরেও ছিল। মারিয়া আমার কেবিনের মেঝেতে বসে সব পরিষ্কার করল। আমার ব্যাগের ওপরে কিছু অংশ সাদা দাগ ছিল। সে বলল, দাগ কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু র্যাশ এখানকার প্রাণিজগতের জন্য খুব ক্ষতিকর।
মারিয়া বলতে শুরু করল, মহুয়া, কীভাবে জোডিয়াকে (ছোট নৌকা) উঠতে হয়, তাই এবার তোমাকে শেখাব। এ জন্য একটি সূত্র আছে। ধরে নিতে পারো এর নাম ‘তিন কদম সূত্র’। ঠিক ঠিক তিন কদম ফেলেই জাহাজ থেকে জাহাজে লাগোয়া জোডিয়াকে উঠতে হবে। এর বেশিও নয়, কমও নয়।
কীভাবে? আমি জানতে চাইলাম।
জাহাজের তিনতলায় বেশ কিছু জোডিয়াক রাখা আছে। একটি বিশেষ ক্রেনের সাহায্যে তার একটি প্রথমে অ্যান্টার্কটিকার পানিতে ফেলা হবে এবং দ্রুত সেটি জাহাজের সঙ্গে বেঁধেও ফেলা হবে। ক্রুদের সহযোগিতায় অভিযাত্রীরা ১০ জন করে জোডিয়াকে উঠবে। জোডিয়াকে উঠার সময় ক্রুর হাত ধরে উঠতে হবে। করমর্দনের মতো করে নয়। তোমার ডান হাতের বাহু দিয়ে ক্রুর বাম হাতের বাহু পেঁচিয়ে ধরতে হবে।
প্রশিক্ষণ শেষ হলো। আবার বিছানায় ঠাঁই নিলাম। কেবিনে আমি একা, নাশতার দেখা নাই। হয়তো লাউঞ্জে আছে, দলের সঙ্গে। অভ্যর্থনা কক্ষ হতে ঘোষণা এল, ডিনারের আমন্ত্রণ। আমার পেটে একটা দানাও নেই। তবু ঠিক করলাম রাতে খাব না। একটু ঘুমের আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু আমি যদি দক্ষিণে তার খোঁজ করি, সে উত্তরে যায়। এই অসময়ে দরজায় শব্দ! নাহ্, আর কোনো প্রশিক্ষণ মিস করেছি বলে তো মনে পড়ছে না। দরজা খুলেই চমকে উঠলাম।
আমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে হাজির আমার তিন বন্ধু।
‘তোমাকে ছাড়া ডিনার করতে খুব কষ্ট হয়েছে, মহুয়া। তোমাকে ভীষণ মিস করেছি,’ ওরা বলল।
আমার চোখে পানি চলে এল। সে পানি আমি আড়াল করেছি। এই বিদেশ–বিভুঁইয়ে কয়েক দিনের পরিচয়েই এমন ভালোবাসা!
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা
৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’
৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি
৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি