কুড়িয়ানার হাটটা ছোট। বড় কোনো দোকানও নেই। সাপ্তাহিক বাজার বসে দুই দিন—শুক্র ও সোমবার। তবে শুক্রবার বসে বড় বাজার। এই দিনই বেশি লোক হাটে আসেন, বিক্রিবাট্টাও বেশি। কুড়িয়ানা খালের পাড়ে এই হাটের ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে গেলে অন্য জায়গার থেকে পুরোই আলাদা। আসলে কুড়িয়ানা খালকে কেন্দ্র করেই সচল এই এলাকার অর্থনীতি। এখানকার মানুষের জীবিকাও খাল এবং প্রকৃতিনির্ভর। খালটির শাখা-প্রশাখা গিয়ে মিশেছে সন্ধ্যা, ঝালকাঠির বাসণ্ডা এমনকি বরিশালের কীর্তনখোলায়। কীর্তনখোলায় গিয়ে পড়া সেই নবগ্রাম খাল এখন ইতিহাসের অংশ হলেও অন্যগুলো সচল আছে। সবুজ প্রকৃতি, শিরার মতো প্রবহমান খাল, বাগানের ভেতরে প্রবেশের অসংখ্য পরিখা এবং এসব জলাধার ঘিরে মানুষের কর্মব্যস্ত জীবন—সব মিলিয়ে অপরূপ এক প্রকৃতি।
এই এলাকার মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন নৌকা। প্রতিটি পরিবারেই এক বা একাধিক কোষা আছে। এই নৌকায় পেয়ারা বা খেতে উৎপাদিত অন্য কোনো কৃষিপণ্য নিয়ে অথবা পরিবারের কোনো প্রয়োজনে বাজারে আসেন তাঁরা। সব নৌকার নকশা ও আকার প্রায় একই। দীর্ঘ এই খালের দুই পাড়জুড়ে পেয়ারা, আমড়াসহ নানা সবজির বাগান। খাল থেকে যাতে বাগানে পানি ঢুকতে ও নামতে পারে, এ জন্য পরিখার মতো খনন করা হয়েছে। এসব ছোট নৌকায় করে এসব পরিখায় ঢুকে গাছের পরিচর্যা, পেয়ারা পাড়েন চাষিরা।
কুড়িয়ানা থেকে প্রায় ৪০ মিনিটের দূরত্ব ভীমরুলি। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে যাওয়া যায়। স্থানটি আরও মোহনীয়। এই ভীমরুলিতেই দেশ-বিদেশে সুপরিচিত ভাসমান পেয়ারার হাট। ছোট্ট কোষায় করে চাষিরা পেয়ারা নিয়ে আসেন। জলে ভেসে ভেসে খালেই চলে বিক্রি। এই বাজার ঘিরে প্রতিদিন অনেক পর্যটক আসছেন। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ভীমরুলির কঠুরাকাঠি গ্রামে ১০ একর পেয়ারাবাগানে গড়ে উঠেছে ন্যাচারাল ট্যুরিজম অ্যান্ড পিকনিক স্পট। পাশের আদমকাঠি গ্রামেও রয়েছে দুটি বিনোদনকেন্দ্র। এই গ্রামে তিন একর জমিতে যাত্রা শুরু করেছে রিয়ান পেয়ারা পার্ক।
আষাঢ়ের শেষ শুক্রবার ছিল গত ১৪ জুলাই। সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আটঘর-কুড়িয়ানা হাটে পৌঁছে দেখা গেল হাটের পাশে সারি সারি নৌকা। দেখতে সুন্দর পাতলা ছোট কোষাগুলোর খোলে ঠাসা পেয়ারা, কচু, চিচিঙ্গা, লেবু, ঝিঙা, আমড়া, কলাসহ নানা কৃষিপণ্য। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকাররা নৌকা থেকেই সেগুলো কিনে নিচ্ছেন। তবে এলাকাটি দেশজুড়ে মূলত পেয়ারার জন্যই বিখ্যাত।
এই বর্ষাকে ঘিরে আটঘর-কুড়িয়ানার খালের পাশেই বসে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কোষা নৌকার হাট। তৈরি করেন পিরোজপুরের নাজিরপুর ও স্বরূপকাঠি কারিগরেরা। বিক্রির জন্য তাঁরাই এখানে নিয়ে আসেন এসব নৌকা। খালে ভাসানো আর পাড়ে সার বেঁধে তুলে রাখা কোষা। বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকা কিনতে হাটে এসেছেন ক্রেতারা।
স্থানীয় নৌকার কারিগরেরা বলেন, কোষা মূলত নৌকার ক্ষুদ্র সংস্করণ। অন্যান্য নৌকার মতো এর গলুইয়ের কাঠ বড় থাকে না। অঞ্চলবিশেষে এর আকারে কম-বেশি দেখা যায়। এর আদর্শ দৈর্ঘ্য ৯ মিটার। কখনো কখনো ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের কোষাও দেখা যায়।
কোষা মূলত পারিবারিক নৌকা। হাট, বাজার, স্বল্প দূরত্বে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়। কোষা বইঠা দিয়ে চালানো হয়। এ অঞ্চলের কোষাগুলোতে সর্বোচ্চ চারজন পরিবহন করা যায়। তবে বেশির ভাগ কোষায় এক বা দুজন দুই মাথায় বসে বইঠা বেয়ে পণ্য আনা-নেওয়া করেন।
নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটার আল আমিন খালের মধ্যে সারবাঁধা নৌকায় দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে দাম-দর নিয়ে ব্যস্ত। নৌকার দাম কত? প্রশ্ন শুনে তাকালেন এবং পাল্টা জানতে চাইলেন, ‘নেবেন কয় পিস? একদাম বাইশ শ টাকা।’
বিক্রির জন্য শুক্রবারের হাটে ৪৮টি নৌকা এনেছিলেন আল আমিন। বেলা ১টার মধ্যে ৪০টিই বিক্রি হয়ে গেছে। তাঁর আশা, বাকি নৌকাগুলোও বিক্রি হয়ে যাবে।
চাম্বল কাঠের নৌকাগুলো দেখতে সুন্দর। নৌকার খোলে পণ্য পরিবহনের জন্য দুটি বাক্স আকারের আলাদা ডেক রয়েছে। মাঝখানটায় পানি জমার জন্য ফাঁকা। পানি সেচের সুবিধার্থে নৌকাগুলোর এমন ডিজাইন করা হয়েছে।
আল আমিন বলেন, এই হাটে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা দামের নৌকা পাওয়া যায়। কাঠের মান, আকার অনুযায়ী দাম। বাবা-দাদার আমল থেকে এই নৌকা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। আগে লাভ ভালো ছিল। কিন্তু এখন কাঠ, নির্মাণসামগ্রী, শ্রমিক মজুরি, মিস্ত্রি মজুরি বেড়ে যাওয়ায় খুব একটা লাভ থাকে না।
নৌকার হাটের ইজারাদার আবদুর রহিম হাটের পাশেই টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসেছেন। চারজন মিলে খাজনার রসিদ কাটছেন, চারজনই ব্যস্ত। কথা বলার ফুরসত নেই। আবদুর রহিম বলেন, আগে এই সিজনে প্রতি হাটে হাজার-বারো শ নৌকা বিক্রি হতো। এখন কিছু কম হয়।
তাঁদের সঙ্গে গল্প করতে করতে সূর্য পশ্চিমাকাশে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে।
এবার ফেরার পালা।