দেশের সীমান্তঘেঁষা নদীগুলোকে সুন্দর বললে অন্যায় হবে, বলতে হবে নীলাভ সুন্দর। আবার নীলাভ সুন্দর বললেও কেমন অসম্পূর্ণ থেকে যায়, নদীগুলোর মধ্যে সবুজের সারল্য আছে, আছে সোনালি স্নিগ্ধতা আর ঝকঝকে টলটলে মুগ্ধতা। এমন নদী দেখার জন্য যখনই সুযোগ পাই, ছোট্ট একটা ব্যাগ কাঁধে ছুটে যাই। এবারও গুগল ম্যাপে উত্তরাঞ্চল ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখ আটকাল মাঝবরাবর নীল একটা অংশে। জুম করতে করতে একসময় নীল দাগটার নিজস্ব একটা নাম ফুটে উঠল—গণেশ্বরী নদী। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের নদীটি মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে এসে প্রবাহিত হচ্ছে।
নদীর আশপাশ দেখতে গিয়েই আরেক জায়গায় চোখ আটকাল, এই নদীর একেবারে পারে সাত শহীদের সমাধিস্থল রয়েছে! একটু থমকালাম, মনে পড়ল বছর দুয়েক আগেও ঠিক এই জায়গাতেই তো আটকে গিয়েছিলাম! তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম, একদিন এই সমাধিস্থলে যাব। ‘ঘুরপাগল’ মনটা তড়াক করে উঠল, বুকের মাঝ টোকা দিয়ে বলল, ‘চল মামা’!
বন্ধ করলাম ম্যাপ দেখা। কল করলাম লালমনিরহাটের বন্ধু নাসিরুল আলম মণ্ডলকে। তাঁকে জানালাম লেঙ্গুরাতে সাত শহীদের সমাধিস্থল রয়েছে, আর আছে সুন্দর একটা পাহাড়ি নদী। মণ্ডল ভাই অন্য পাশ থেকে বলল, তাহলে আমরা বাসায় বসে
আছি কেন!
লালমনিরহাট থেকে সুনামগঞ্জের পথে
আমাদের এবারের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল মণ্ডল ভাইয়ের এলাকা লালমনিরহাট থেকেই। তারপর সীমান্ত সড়ক ধরে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা হয়ে একেবারে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সে গল্প অন্য সময় করব, আপাতত লেঙ্গুরার মাটিতে দেশের বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর পর্বটুকু বলি।
নেত্রকোনার কলমাকান্দা থেকে নাজিরপুরের রাস্তা ধরে মণ্ডল ভাইয়ের মোটরসাইকেলে করে খুব সকালে আমরা চলে গিয়েছিলাম লেঙ্গুরা বাজারে। সেখানেই মূলত পিচঢালা রাস্তা শেষ। এরপর বালু আর ঘাসের রাস্তা ডিঙিয়ে সীমান্তের দিকে যেতেই চোখে পড়ে মেঘালয়ের আকাশ আগলানো উঁচু পাহাড়সারি। সবুজের এই প্রহরীরা আমাদের পুরো উত্তর দিকে আগলে রেখেছে শত শত বছর। তাদের কোল বেয়ে কত না নদী এসে ঢুকেছে আমাদের সীমানায়, তারই একটি গণেশ্বরী। এই নদীর একেবারে পাশ ঘেঁষে আমরা চলে গেলাম সীমান্তে অবস্থিত সাত শহীদের সমাধিস্থলে।
এখানে অনেক গাছ রোপণ করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন একটি বাগানে পরিণতা হয়েছে রীতিমতো। বাগানের একদম শেষ মাথায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) লাল সাইনবোর্ড। সেখানে বড় করে লেখা, ‘বাংলাদেশের সীমানা শেষ, সীমান্ত অতিক্রম করবেন না’! ঠিক পাশের খোলা জায়গাতেই সীমান্তখুঁটি—এর ওপাশে ভারত। সীমান্ত পার না হয়েও গণেশ্বরী নদীর ঠিক ওপারেই ভারতের মানুষজন দেখা যায়, সেতু পেরিয়ে চলে যাচ্ছে ভারতের গাড়ি।
এই নদীর মূল সৌন্দর্য দেখা যায় পাশের একটা টিলায় উঠলে। এই টিলার নাম মমিনের টিলা। টিলাটা লেঙ্গুরা বাজারের সঙ্গেই। পুরো গণেশ্বরী ছবির মতো ফুটে উঠে সেখান থেকে। মন প্রফুল্ল করে দেওয়া এই নদী বর্ষায় কী অসাধারণ হয়, সেটা ভাবতেই আরেকবার আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে হাঁটুপানি। কক্সবাজার সৈকতের বালুর মতো চকচক করছে সাদাটে বালু, তার মধ্যে টলটলে ঝকঝকে পরিষ্কার পানি। একটু দূরেই গারো সম্প্রদায়ের মানুষেরা নদীতে গোসল করছে, পানি নিয়ে যাচ্ছে, শিশুরা পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে এর-ওর গায়ে। সব মিলিয়ে দারুণ একটা সুখের পরিবেশ চারপাশে।
সীমান্তের সাত শহীদ
নদী থেকে অন্য পাশে চোখ ফেরাতেই সুখের পরিবেশটা গুমোট হয়ে যায়। গণেশ্বরী নদীর পাড়ের সীমান্তখুঁটির একেবারে লাগোয়া শত গাছের ছায়ায় শুয়ে আছেন সাতজন শহীদ। ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই নেত্রকোনার নাজিরপুর তিন রাস্তার মোড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে বীর যোদ্ধারা শহীদ হন। তাঁদের সমাহিত করা হয় গণেশ্বরী নদীর পারে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চারজন ময়মনসিংহের, দুজন নেত্রকোনোর আর একজন জামালপুরের। এর মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী পাঁচজনের সিমেন্টে বাঁধানো কবর একসঙ্গে আর ঠিক পাশেই হিন্দুধর্মাবলম্বী দুজন সমাহিত আছেন।
একটু আগেই নদী দেখা উড়ু উড়ু মনটা ফুস করে চুপসে গেল, যাঁদের জন্য এই স্বাধীন দেশে আমরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারছি, তাঁরা এতটা কাছে, এতটা বছর ধরে শুয়ে আছেন; ঠিক কতটুকু শ্রদ্ধা করলে, কতটুকু ভালোবাসা দিলে বা কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞতা জানালে তাঁদের সঠিক সম্মান জানানো হবে, আমাদের জানা নেই। সমাধিস্থলের পাশে টানা এক ঘণ্টা চুপচাপ হাঁটলাম। শহীদদের সমাধি দেখার ইচ্ছা ছিল অনেক দিন থেকেই, আজ সেই ইচ্ছা পূর্ণ হলো। বারবার মনের ভেতর থেকে একটা কথাই ভেসে এল—যাঁদের জীবনের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি, লেঙ্গুরায় সেই সাতজন অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধার একদম কাছে আজ আমরা।