পৃথিবীর নানা প্রান্তের দুঃসাহসী অভিযাত্রীর দল সর্বোচ্চ শিখর এভারেস্টের অহম জয় করতে চেয়েছে
পৃথিবীর নানা প্রান্তের দুঃসাহসী অভিযাত্রীর দল সর্বোচ্চ শিখর এভারেস্টের অহম জয় করতে চেয়েছে

এভারেস্টে হারিয়ে যাওয়া ৯ বিখ্যাত অভিযাত্রীর গল্প

মাউন্ট এভারেস্ট—হিমালয় পর্বতমালা তথা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। উচ্চতা ২৯ হাজার ৩২ ফুট। শত বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তের দুঃসাহসী অভিযাত্রীর দল সর্বোচ্চ এই শিখরের অহম জয় করতে চেয়েছে। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি ও নেপালের তেনজিং নোরগের বদৌলতে গোটা মানবজাতিই জয় করে ‘অজেয়’ এই শৃঙ্গ। কিন্তু এত সহজেই কি পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে পেরেছে মানুষ? প্রতি পদে যেখানে মৃত্যুর হাতছানি, সেখানে হাজার হাজার অভিযাত্রীর মধ্যে ২০২২ সাল পর্যন্ত ভাগ্যবান ৬ হাজার ৯৮ জন এভারেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়েছেন। অনেকেই আবার হারিয়ে গেছেন এভারেস্টের সাদা বরফের চাদরে। এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে আর কখনোই ফিরে আসেননি, এমন ৯ বিখ্যাত অভিযাত্রী সম্পর্কে জানুন। তার আগে বলে রাখি, এভারেস্ট থেকে না-ফেরাদের দলে একজন বাংলাদেশিও আছেন—মোহাম্মদ খালেদ হোসেন (১৯৭৯-২০১৩), সজল খালেদ নামেই যিনি বেশি পরিচিত। ২০১৩ সালে এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে ৮ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতায় তিনি প্রাণ হারান অজানা কারণে।

১. জর্জ ম্যালোরি

জর্জ ম্যালোরি

১৯২১ ও ১৯২২ পরপর দুবছর এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করেন ইংরেজ পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি। দুবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয় তাঁকে। সবকিছু গুছিয়ে ১৯২৪ সালে আবার নতুন করে অভিযানে নামেন তিনি। পর্বতারোহী অ্যান্ড্রু আরভিনকে সঙ্গে নিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছিলেন জর্জ ম্যালোরি। কিন্তু ফেরার পথে ৮ জুন দুজনই নিখোঁজ হন। নিখোঁজ হওয়ার ৭৫ বছর পর, ১৯৯৯ সালে আরেক দল অভিযাত্রী ম্যালোরির দেহাবশেষ দেখতে পায়। এভারেস্টের শুভ্র চাদরে ম্যালোরির চিরতরুণ দেহটি পাওয়া গেলেও এখনো পাওয়া যায়নি আরভিনকে। সফলভাবে সমতলে ফিরে এলে ম্যালোরি এবং আরভিনই হতেন এভারেস্ট জয় করা প্রথম মানুষ।

২. হানালুহা শ্মাৎজ

হানালুহা শ্মাৎজ

১৯৭৯ সালে স্বামী জেরার্ড শ্মাৎজের সঙ্গে এভারেস্ট অভিযানে নেমেছিলেন হানালুহা। ভিন্ন দুটি দলের হয়ে দুজনই এভারেস্ট জয় করেছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে বাধে বিপত্তি। নামতে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবে অত্যধিক ক্লান্ত হয়ে পড়েন হানালুহা। ক্যাম্প-৪ থেকে কিছুটা দূরে বিশ্রামের জন্য থামেন তিনি। নিজের ব্যাকপ্যাকে হেলান দিয়ে বসে মাথাটা ঝুঁকে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বিশ্রামরত অবস্থায় ফ্রস্টবাইটে আক্রান্ত হয়ে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ৩৯ বছর বয়সী এই জার্মান পর্বতারোহী। ওদিকে তাঁর স্বামী জেরার্ড ভিন্ন আরেকটি দলের সঙ্গে নেমে পড়েন এভারেস্ট থেকে। কয়েক বছর পর যখন হানালুহার দেহ এভারেস্টে আবিষ্কৃত হয়, তখনো তিনি নিজের ব্যাকপ্যাকে হেলান দিয়েই বসে ছিলেন। বাতাসে তাঁর সোনালি চুলগুলো উড়ছিল এলোমেলো; শুধু চোখের দৃষ্টি ছিল নিথর।

৩. গ্রিন বুট (সেওয়াং পালজর)

গ্রিন বুট (সেওয়াং পালজর)

১৯৯৬ সালের মে মাসে ভারতের ইন্দো-তিব্বতীয় সীমান্ত পুলিশের ৬ সদস্যের একটি অভিযাত্রী দল এভারেস্টে ওঠে। স্বাভাবিক গতিতেই চূড়ার কাছে পৌঁছে যায় দলটি। ১০ মে দলটি চূড়া থেকে একটু দূরে মারাত্মক তুষারঝড়ের কবলে পড়ে। ৬ জনের মধ্যে ৩ জন চূড়ায় না উঠে ফিরে আসেন। সুবেদার সেওয়াং স্মানলা, ল্যান্স নায়েক দর্জি মরুপ ও হাবিলদার সেওয়াং পালজর—এই তিনজন চূড়ায় ওঠার জন্য এগিয়ে যান। সেদিন বিকেলে রেডিওতে তাঁরা এভারেস্ট জয়ের খবর বেজক্যাম্পে জানান। চূড়ায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে তাঁরা নেমে আসতে শুরু করেন। কিন্তু এরপর ওই ৩ জনের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সপ্তাহখানেক পর ১৬ মে আরেকটি অভিযাত্রী দল শৃঙ্গের কাছেই নর্থ রিজ এলাকায় সবুজ রঙের বুট পরা এক পর্বতারোহীর নিথর দেহ দেখতে পায়। ধারণা করা হয়, সবুজ বুট পরা ওই মৃতদেহটি হারিয়ে যাওয়া ভারতীয় পর্বতারোহী সেওয়াং পালজরের।

৪. রব হল

রব হল

রব হল ছিলেন তাঁর সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্বতারোহীদের মধ্যে অন্যতম। নিউজিল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অসীম সাহসী এই অভিযাত্রী একে একে পৃথিবীর সাত মহাদেশের সাতটি উঁচু শৃঙ্গ জয় করার পর ১৯৯৬ সালের মে মাসে আবারও এভারেস্ট জয়ের অভিযানে নামেন। ১১ মে তীব্র তুষারঝড়ে আক্রান্ত হন। আরও অনেক অভিযাত্রীর সঙ্গে সেদিন তিনিও প্রাণ হারান।

৫. স্কট ফিশার

স্কট ফিশার

১৯৯৬ সালের মে মাসে মাউন্ট এভারেস্টে বয়ে যাওয়া তীব্র তুষারঝড়ে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানো আরেক জনপ্রিয় অভিযাত্রী হলেন স্কট ফিশার। ‘মাউন্টেন ম্যাডনেস’ নামের এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তুষারঝড় শুরু হলে দলের অন্য সবার চেয়ে বেশিই ক্লান্ত হয়ে পড়েন স্কট। দলের বাকিদের বাঁচাতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক সাহসী সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাঁকে ফেলে রেখে দলের বাকিদের সামনে এগিয়ে যেতে বলেন। এরপরই ধীরে ধীরে ঠান্ডায় জমে যেতে শুরু করেন এই মার্কিন পর্বতারোহী। মৃত্যুর আগে পরার্থে নিজেকে বলি দেওয়ার নায়কোচিত এক আখ্যান লিখে গেছেন স্কট।

৬. ফ্রান্সিস আর্সেন্তিয়েভ (স্লিপিং বিউটি)

ফ্রান্সিস আর্সেন্তিয়েভ

অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া এভারেস্টজয়ী প্রথম মার্কিন নারী হয়ে রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন ছিল ফ্রান্সিসের। স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যেই ১৯৯৮ সালের মে মাসে স্বামী সের্গেই আর্সেন্তিয়েভকে সঙ্গে নিয়ে এভারেস্ট অভিযানে নামেন ৪০ বছর বয়সী এই নারী। প্রথম মার্কিন নারী হিসেবে অক্সিজেনের সিলিন্ডার ছাড়াই এভারেস্ট জয় করার রেকর্ড গড়েন ফ্রান্সিস। জয়ের গৌরব নিয়ে স্বামী সের্গেইসহ চূড়া থেকে নামতেও শুরু করেন। হঠাৎই ফ্রান্সিসের গতি কমে যায়, স্বামীর থেকে পিছিয়ে পড়েন। অনেকক্ষণ ফ্রান্সিসের দেখা না পেয়ে সের্গেই তাঁকে খুঁজতে শুরু করেন। অনেক চেষ্টা করেও ফ্রান্সিসের সন্ধান পেতে ব্যর্থ হন তিনি। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে সের্গেই দিশাহারা হয়ে পড়েন। নিজেও বিরূপ আবহাওয়ায় একসময় বরফের চাদরে নিথর হয়ে যান। চূড়ার কাছে ফ্রান্সিসের দেহ দৃশ্যমান হলেও তখন শুধু সের্গেইয়ের কুড়ালটি পাওয়া যায়। এর প্রায় বছরখানেক পর সের্গেইকেও পাওয়া যায় নিথর অবস্থায়। ফ্রান্সিসের স্নিগ্ধ নিথর দেহটি পর্বতারোহীদের কাছে রূপকথার ‘স্লিপিং বিউটি’ হিসেবে পরিচিত।

৭. বাবু চিরি শেরপা

বাবু চিরি শেরপা

এভারেস্টে ওঠাটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন বাবু চিরি। ১০ বার এভারেস্ট জয় করেও তিনি ক্ষান্ত হননি। সবচেয়ে দ্রুত সময়ে আরোহণ আর অক্সিজেনের সিলিন্ডার ছাড়া সবচেয়ে দীর্ঘ সময় চূড়ায় অবস্থান করার দুঃসাহসী রেকর্ডটিও তাঁর দখলে ছিল। ২০০১ সালে যখন ১১তম বারের মতো এভারেস্ট জয়ের উদ্দেশ্যে বের হন, ক্যাম্প-২-এর কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে হুট করে পিছলে খাদে পড়ে যান। অকালে প্রাণ হারান নেপালের ইতিহাসের অন্যতম সাহসী এই অভিযাত্রী।

৮. ডেভিড শার্প

ডেভিড শার্প

২০০৬ সালে এভারেস্ট জয়ের উদ্দেশ্যে বের হন ইংরেজ পর্বতারোহী ডেভিড শার্প। কোনোরকম সাহায্য ছাড়াই পুরোপুরি নিজের চেষ্টায় চূড়ায় উঠে পড়েছিলেন। ফেরার পথে চূড়া থেকে কিছুটা নিচে সেওয়াং পালজরের মৃতদেহের পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বিশ্রামরত অবস্থায় হঠাৎ করে ঠান্ডায় জমে যেতে শুরু করেন ডেভিড। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাঁর পাশ দিয়ে কমপক্ষে ৪০ জন আরোহী নেমে যান। কিন্তু কেউই মুমূর্ষু ডেভিডের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেননি। পরে একসময় বিখ্যাত পর্বতারোহী সেওয়াং পালজরের মৃতদেহের পাশেই নিথর হয়ে যান ডেভিড।

৯. শ্রিয়া শাহ-ক্লোরফিন

শ্রিয়া শাহ-ক্লোরফিন

২০১২ সালে মাউন্ট এভারেস্টে যে ১২ জন অভিযাত্রী প্রাণ হারান, তাঁদের মধ্যে শ্রিয়া অন্যতম। নেপালি বংশোদ্ভূত এই কানাডীয় নাগরিক ২০১২ সালের মে মাসে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন। চূড়ায় উঠে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি শ্রিয়া। বেশি সময় নিয়ে ফেলেছিলেন সেখানে। ক্যামেরায় এভারেস্টের অপার্থিব ছবি বন্দী করছিলেন। অতিরিক্ত সময় নেওয়ার কারণে তাঁর সিলিন্ডারের অক্সিজেন একসময় ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। চূড়া থেকে নেমে আসার পথে ২৬ হাজার ফুট উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন শ্রিয়া। পরে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। সহযাত্রীরা তাঁর দেহাবশেষ পরে বেস ক্যাম্পের কাছে এনে রাখেন।

তথ্যসূত্র: হেডেনরু ও উইকিপিডিয়া