ইস্তাম্বুলে এসে যদি টপকাপি প্রাসাদ না দেখি, তাহলে ইস্তাম্বুল ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়। তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। ইস্তাম্বুলের সব জাদুঘর দেখার জন্য একটি বিশেষ মিউজিয়াম পাস পাওয়া যায়। ইস্তাম্বুলের সব জাদুঘর দেখার পরিকল্পনা যদি কারও থাকে, তাহলে এটা কেনা লাভজনক। আগে থেকে টিকিট থাকায় সরাসরি গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
১৪৫৯ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেতের নির্দেশে এই প্যালেসের নির্মাণকাজ শুরু হয়। টপকাপি প্যালেস মূলত কয়েকটি আঙিনা আর প্যাভেলিয়ন, যা ওসমানীয় সুলতানদের আবাসিক ও প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই প্যালেসের ভেতর ও বাইরের শৈলীতে ওসমানীয় ইসলামিক ও রোমান বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের অনন্য মিশ্রণ লক্ষ করা যায়।
গেট দিয়ে ঢুকেই বিশাল এক আঙিনা। নাম দিবান-ই হুমায়ুন। আঙিনাটি প্রাসাদের প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করা হতো। সুলতানের যাবতীয় সভা, নির্দেশনা ও সাম্রাজ্যের বিচারিক কাজকর্ম এখান থেকেই সঞ্চালিত হতো।
একটু হেঁটে সামনে পড়ল হারেম। হারেমে ঢোকার জন্য আলাদা টিকিট লাগে। পরিবার ও মাকে নিয়ে হারেমে থাকতেন সুলতান। এর বাইরের কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না। হারেমে বিভিন্ন কামরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর করে সাজানো ছিল ইম্পেরিয়াল হল। এই হল ব্যবহার করা হতো বিশেষ অনুঠানের জন্য।
সুলতানের মা ছিলেন হারেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি হারেমের নিয়মকানুন ঠিক করতেন, যা সুলতানও অমান্য করতে পারতেন না। তাঁর কামরাটি হারেমের অন্যান্য কামরা থেকে আলাদা আর বিলাসবহুল। আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, সেই প্রায় ৫০০ বছর আগের গোসলখানাতেও ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যবস্থা ছিল।
হারেম থেকে বের হয়ে শুরু করলাম জাদুঘর অঞ্চল দেখা। প্রথমে গেলাম ওসমানীয় সম্রাজ্যের কোষাগারে। ওসমানীয় সম্রাজ্যের রত্নভান্ডারের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেল। এখানে বিভন্ন সময় বিভিন্ন সুলতান ও তাঁদের স্ত্রীদের ব্যবহৃত গয়না, রাজকীয় অলংকার, হীরা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে। অস্ত্রাগারে ওসমানীয় যোদ্ধাদের অস্ত্র দেখলাম। এর ধর্মীয় সংগ্রহশালাটিও বেশ আকর্ষণীয়।
সেখান থেকে চলে গেলাম মর্মর বা মার্বেল প্যাভিলিয়নে। অসামান্য স্থাপত্যকৌশল ও সৌন্দর্যের জন্য প্যাভিলিয়নটি বিখ্যাত। মার্বেল প্যাভিলিয়ন থেকে ইস্তাম্বুলের বসফরাস প্রণালি দেখতে পেলাম। এখানে কেন সুলতানরা বিশ্রাম করতেন, তা এই দৃশ্য দেখলে সহজেই বোঝা যায়।
টপকাপি প্রাসাদের রান্নাঘর থেকেই সুলতান, তাঁর আত্মীয়স্বজন, প্রাসাদে বসবাসরত ব্যক্তি, রাজদরবারের সদস্য ও বিশেষ অতিথিদের জন্য খাবার রান্না হতো। মাংস, মিষ্টি, রুটি ও অন্যান্য খাবারের জন্য আলাদা ঘর। সে সময়ের অত্যাধুনিক রান্নার সরঞ্জাম সাজানো ছিল। রান্নাঘরের অংশটি বর্তমানে সংগ্রহশালা। এখানে বিভিন্ন ধরনের চীনামাটির বাটি, সোনার তৈরি খাবারের পাত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষিত আছে। এর মাধ্যমে ভ্রমণকারীরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের খাবারের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
টপকাপি থেকে বের হতে হতে খাবারের সময় হয়ে গেল। বাসস্টপের উল্টা দিকে খেয়াল করলাম একটি গেট আর বেশ উঁচু দেয়াল। এটি ‘ওয়াল অব কনস্টান্টিনোপল’–এর অংশ। প্রাচীন কনস্টান্টিনোপল শহরকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য চতুর্থ শতাব্দীতে এই প্রাচীরের প্রথম অংশ তৈরি করা হয়েছিল। তবে এর বেশির ভাগ অংশ পঞ্চম শতাব্দীতে পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করা হয়। প্রায় হাজার বছর ধরে শত্রুদের হাত থেকে কনস্টান্টিনোপলকে রক্ষা করে এসেছে এই দেয়াল।
আমরা যে গেট দিয়ে ঢুকলাম, তার নাম ‘রসু গেট’ বা লাল গেট। লাল ইট দিয়ে তৈরি বলে এই নাম। ভেতরে ঢুকে চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। দেয়ালটির মূলত তিনটি প্রধান অংশ। বাইরের প্রাচীর, মাঝের প্রাচীর ও ভেতরের প্রাচীর। এই তিন স্তর পার করে শহরের ভেতরে ঢোকা যে প্রায় অসম্ভব সেটা দেখেই বোঝা গেল। বাইরের প্রাচীরের সামনে একসময় খাল ছিল, এখন শুকনা। এই খাল শত্রুদের প্রবেশের পথেই বাধা দিত। মাঝের প্রাচীরটি ছিল আরও উঁচু আর শক্তিশালী, যা শহরের প্রধান রক্ষণাবেক্ষণের অংশ ছিল। ভেতরের প্রাচীর শেষ প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হতো।
মেইডেন টাওয়ার
স্থানীয় দোকানের শর্মা দিয়ে পেটের ক্ষুধা মিটালাম। তারপর ইস্তাম্বুলের মেইডেন টাওয়ার দেখতে চললাম। পৌঁছাতে একটু সময় লাগল। বিকেলবেলা সাগরপাড়ে বসে এই টাওয়ার দেখতে ভালোই লাগল। টাওয়ারের ভেতরের অংশ এখন রেস্টুরেন্ট। এই টাওয়ার নিয়ে একটি গল্প চালু আছে।
কোনো এক রোমান সম্রাটের শাসনকালে তাঁর ভবিষদ্বক্তা ঘোষণা দিল, সাপের কামড়ে সম্রাটের সবচেয়ে প্রিয় কন্যার মৃত্যু হবে। ১৪ বছর বয়সে। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য সাগরের মাঝে ছোট্ট এই দ্বীপে একটি টাওয়ার তৈরি করেন সম্রাট। ১৪তম জন্মদিনের আগেই মেয়েকে সেই টাওয়ারে পাঠানো হলো। জন্মদিনের মেয়ের জন্য ফুলের তোড়া পাঠালেন সম্রাট। আর সেই তোড়ায় লুকিয়ে থাকা সাপের কামড়ে মেয়ের মৃত্যু হয়।
সূর্য ডুবু ডুবু। বসফরাস প্রণালির পানিতে সূর্যের সোনালি আলো চিকচিক করছে। সময় জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকলে সেই সময়টাকে সেখানেই জমিয়ে সংরক্ষণ করতাম!