সেপ্টেম্বরের প্রথমভাগের এক সকালে সাতজন মিলে ঘরছাড়া হলাম। গন্তব্য হাওর পরিবেষ্টিত কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা। ভ্রমণসঙ্গীরা সবাই আমার সহকর্মী।
সকাল সাড়ে ছয়টায় কমলাপুর থেকে ট্রেনে চেপে আটটায় ভৈরব পৌঁছালাম। ভ্রমণসঙ্গী মঞ্জুর-ই ইলাহী প্রস্তাব দিলেন, ভৈরব শহরে তাঁর নানাবাড়িতে নাশতা করার। প্রস্তাবটা তাঁর মুখ থেকে মাটিতে পড়ার আগেই আমরা লুফে নিলাম। তাঁর নানাবাড়ি গিয়ে সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। ডাইনিংয়ে ঢুকে দেখি রীতিমতো এলাহি কারবার। তিনি যে আগে থেকেই তাঁর মামাকে বলে রেখেছেন, জানতাম না।
নাশতা শেষে রওনা দিলাম কুলিয়ারচর উপজেলার উদ্দেশে। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ঠিক সাতজনের সিট। আমরা উঠে পড়লাম। জনপ্রতি ৬০ টাকা ভাড়া দিয়ে ঠিক ৪৫ মিনিটে চলে গেলাম কুলিয়ারচর স্পিডবোট ঘাটে।
স্পিডবোট প্রস্তুত ছিল। উঠে বসতেই তুমুল গতিতে ছুটে চলল। কী যে অসামান্য এক অনুভূতির সঞ্চার হলো দেহ-মনে, বোঝাতে পারব না। সেই কবে একবার বা দুবার এই বাহনে উঠেছি। তা–ও ক্ষণিক সময়ের জন্য। কিন্তু আজ, হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি ভেদ করে যেন টর্পেডোর গতিতে ছুটে চলেছে।
কিছু দূর পরপর দেখছি একেকটা গ্রাম, পানিতে ভেসে আছে। গাছগাছালিতে পূর্ণ গ্রামগুলোতে টিনের ঘর, উঁচু দালান, গবাদিপশুর বিচরণ, মানুষের আনাগোনা। গ্রামগুলো কার্যত একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। প্রতিটি বাড়ির পেছনে বিশেষ কায়দায় বানানো সিঁড়ি হাওরের সঙ্গে মিশেছে। ঘাটে বাঁধা নৌকা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নৌকায় চড়ে মানুষের পারাপার হওয়ার দৃশ্য দেখছি। ব্যাপারগুলো দেখে আমাদের যতটা ভালো লাগছে, বাসিন্দাদের কাছে মোটেই ততটা সুখকর নয় বলে জানা গেল স্পিডবোটচালকের কাছে। লড়াই-সংগ্রামেই কেটে যায় তাদের জীবন।
টানা ৫০ মিনিটের স্পিডবোট ভ্রমণ যেন চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেল। চলে এলাম অষ্টগ্রাম স্পিডবোট ঘাটে। সেখানে আগে থেকেই অষ্টগ্রামের ইউএনও হারুণ-অর রশিদের পাঠানো জিপ ছিল। জিপে উঠে দেখি সাতজনের বসার আয়োজন। মাত্র পাঁচ মিনিটের ভ্রমণ শেষে পৌঁছালাম অষ্টগ্রাম উপজেলা পরিষদের ডাকবাংলোয়। সুন্দর ছিমছাম তিনটি রুম আমাদের জন্য বরাদ্দ।
ফ্রেশ হয়ে আবার জিপে চড়ে গেলাম অষ্টগ্রাম থানা সদরে অবস্থিত পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট কুতুবশাহী মসজিদ পরিদর্শনে। বাংলার সুলতানি ও মোগল স্থাপত্যে নির্মিত মসজিদটি ষোড়শ মতান্তরে সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে। বিখ্যাত দরবেশ কুতুবশাহের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদের অসামান্য স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করল।
কুতুবশাহী মসজিদ থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে। তাঁর বাড়ির পেছন দিকে একটু গেলেই ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক’ নামে সুন্দর এক পর্যটন স্পট আছে। সেই স্পটের গেট বানানো হয়েছে বাঁশের তৈরি বিশালাকৃতির এক পোলো দিয়ে। তলাবিহীন কলসির আদলে বাঁশের সরু লম্বা ফালি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফাঁকা রেখে সুনিপুণভাবে তৈরি করা হয় মাছ ধরার এই বিশেষ ফাঁদ। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় আমরা বলতাম ‘পলাই’। একেক অঞ্চলে এর একেক নাম।
প্রেসিডেন্ট পার্ক থেকে চলে গেলাম রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সেতু। দিগন্তবিস্তৃত বিপুল জলরাশির বুক চিরে তৈরি করা সেতুটি মুগ্ধ করার মতোই। পাশেই বিশালাকৃতির দুটো বজরা দেখতে পেয়ে সবাই ছুট দিলাম ছবি তুলতে। আমাদের ছবি তোলার বহর দেখে হন্তদন্ত হয়ে বজরার আড়াল থেকে একজন বেরিয়ে এলেন। তিনি এর মালিক। জানতে চাইলাম, বজরায় কী আছে। বললেন, ধান কিনে রাখা হয়েছে, অন্যখানে নিয়ে বিক্রি করা হবে।
আমাদের মাইক্রোবাস ছুটছে তো ছুটছেই। সড়কের দুই পাশে থই থই পানি আর নীল আকাশজুড়ে সাদা মেঘের ভেলা। যত দূর চোখ যায়, চারদিকে শুধুই জলরাশি। নীল আকাশ যেন মিলে গেছে সেই জলরাশিতে।
২০১৬ সালে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে তৈরি করা হয় প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক সড়ক। আকাশ, মেঘ আর জলের মনোরম মিতালি অবাক বিস্ময়ে দেখতে দেখতে চলে এলাম ইটনা জিরো পয়েন্টে। সেখানে মিনিট দশেক কাটানোর পর ফিরে এলাম ইটনা–অষ্টগ্রাম–মিঠামইনের তিন মাথায়। সেখানে ছবি তোলা হলো অনেক। সেখান থেকে মিঠামইন জিরো পয়েন্ট। ছবি তোলা চলছে। যেদিকেই তাকাই, কেবলই মুগ্ধতা। এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে হাওরজুড়ে। সূর্যের লাল আভা জলরাশিকে করে তুলেছে আরও মোহনীয়। রাস্তার ধারে বসে আলো-আঁধারির খেলায় বুঁদ হয়ে গেলাম সবাই। সূর্য চলে গেল অস্তাচলে।
চারদিকে লাল লাভা ছড়িয়ে অষ্টগ্রামে রাত নামে। সেই আভা থেকে একটু হলেও রং নিয়ে নিজেকে রাঙানোর আকুলতায় পর্যটকেরা ছুটে আসেন ‘আই লাভ অষ্টগ্রাম’ পয়েন্টে। হাওরের সৌন্দর্যে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে জায়গাটা। পাশেই একটি রেস্তোরাঁয় আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন। পেটপূজা শেষে ডাকবাংলোয় ফিরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।
বেলা ১১টার মধ্যেই কায়াকিংয়ের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। ‘আই লাভ অষ্টগ্রাম’ পয়েন্টে এসে কায়াকিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হলো। লাইফ জ্যাকেট পরে বইঠা হাতে নিয়ে সবাই উঠে গেল কায়াকে। বাঁ হাতে ব্যথা থাকার কারণে আমি তীরে বসে রইলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা কায়াকিংয়ে মেতে রইলেন সহকর্মীরা। আমি তীরে নরম রোদে বসেই রোমাঞ্চিত হলাম।
কায়াকিং পর্ব শেষ করে ডাকবাংলোর পুকুরে এসে মিনিট বিশেক ঝাঁপাঝাঁপি করলেন তাঁরা। তারপর রুমে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে দুপুরের আগেই ঢাকার পথে রওনা দিলাম। আবারও সেই স্পিডবোটে চড়ে ৫০ মিনিটের ভ্রমণ শুরু। কিন্তু এবার ভ্রমণের শুরু থেকেই আকাশ ভারী হয়ে আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। স্পিডবোটে থাকা ছোট্ট একটা পলিথিনের নিচে সবাই গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লাম। কুলিয়ারচর ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমরা ভিজে একাকার।
কুলিয়ারচর থেকে ঢাকার বাসে চেপে বসলাম সবাই। সবাই ক্লান্ত। বাস ছুটছে। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে ফেলে আসা ৩৬ ঘণ্টার মধুর স্মৃতি আমাদের সঙ্গী।