পদ্মার চরে ছোট পানচিল
পদ্মার চরে ছোট পানচিল

ছবির গল্প

ছোট পানচিলের প্রেম-উপাখ্যান

তিন বছর ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বালুচরে কাটিয়ে ছোট পানচিলদের জীবন ফ্রেমবন্দী করেছেন রাজশাহীর নাইমুল হাসান। শৌখিন এই আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় ধরা পড়েছে ছোট এই পাখিদের প্রেম ও দাম্পত্য জীবন। মনুষ্য সমাজের মতোই সেই প্রেমে আছে ভালো লাগা, প্রত্যাখ্যান আর পরকীয়া। নাইমুলের কাছে গল্প শুনেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

রাজশাহী নগরীর দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা। পদ্মার বালুচরে হাজারো পাখির বাসা। প্রায়ই সেখানে ছবি তুলতে যান নাইমুল হাসান। ছোট পানচিলদেরও দেখা পান তিনি। একদিন ঠিক করলেন, তাদের প্রজননপর্বের ছবি তুলবেন।

২০২০ সালের ১৭ মার্চ চরে ছোট্ট একটি তাঁবু খাটান নাইমুল হাসান। তাঁর সঙ্গী হন আফসারউদ্দিন খান পাঠান। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো সকাল থেকে সন্ধ্যা সেখানেই কাটাতে থাকেন তাঁরা। তাঁবুতে তাঁরা এমনভাবে থাকেন, যেন পাখিরা বুঝতে না পারে ভেতরে মানুষ আছে। একসময় তাঁবুর কাছাকাছি চলে আসে পাখিরা। নাইমুল হাসানের ক্যামেরায় একের পর এক ধরা পড়তে থাকে তাদের নানা কর্মকাণ্ড।

১.

১. প্রথম দিনই ক্যামেরায় ধরা পড়ে ২৫-৩০টি পানচিল। তাদের চোখের টান মখমল-কালো হয়ে উঠেছে। দেখা যায়, একদল পানচিল শুধু বসেই রয়েছে। আরেক দল মাছ শিকার করে নিয়ে এসে বসে থাকা পাখিদের সাধছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা বসে আছে, তারা কিন্তু সবাইকেই পাত্তা দিচ্ছে না; মাছ নিয়ে এসেও কোনো কোনো পাখিকে ফিরে যেতে হচ্ছে। বোঝাই যায়, এ হচ্ছে প্রেম প্রত্যাখ্যান। বসে থাকা পাখিটা যার মাছটা গ্রহণ করছে, তারই সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। এ যেন একটি মেয়েকে গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব।

২.

২. প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কখনো কখনো যুবক যেমন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে, পানচিলের সমাজেও তেমন ঘটনার দেখা পাওয়া গেল। যে পাখিটির কেউ সঙ্গী হয়নি, সে সুযোগ খুঁজেছে কখন নারী পাখিটির পুরুষ সঙ্গীটি বাসার বাইরে যায়। সুযোগ পেলেই সে অন্যের সঙ্গীর মন ভুলাতে চেষ্টা করে। এরই মধ্যে এসে পড়ে কর্তা। আর যায় কোথায়, একেবারে ফ্লাইং কিক। আক্রমণে নাজেহাল পরপুরুষ পাখিটি পালিয়ে বাঁচে।

৩.

৩. এখন তাদের সংসারে কোনো ঝামেলা নেই। দুজনে ভাগাভাগি করে তপ্ত বালুর বাসায় ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে তুলছে। বাসায় ছোট ছানা আছে, তা যেন শত্রুপাখি কাক ও চিল বুঝতে না পারে, তার জন্য বাচ্চা ফোটার পরপরই ডিমের খোসাটি ঠোঁটে করে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসে বাবা পাখি। ডিম ফুটে বের হওয়ার এক দিন পরেই ওরা বাসা ছেড়ে দেয়। পাশেই অন্য কোথাও আশ্রয় নেয় তারা। বাবা খাবার নিয়ে এলেই বাচ্চারা বেরিয়ে আসে। মূলত বাবাই খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করে। শুধু তা-ই নয়, উড়তে শেখায়, হাতেখড়িও হয় বাবার কাছেই।

ছোট পানচিল

ছোট পানচিল বা লিটল টার্ন সামুদ্রিক পাখি। নামের মতোই ছোট তারা। দুর্লভ আবাসিক পাখি। প্রজননের ঋতুতে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির টুপি ও চোখের টান মখমল-কালো ও কপাল সাদা। বাইরে কালো প্রান্ত পালক ছাড়া ডানা ফিকে ধূসর ও সামান্য চেরা। খাটো লেজটি ফিকে ধূসর। হলুদ ঠোঁটের আগা বাদামি। পা ও পায়ের পাতা উজ্জ্বল হলুদ।

প্রজননকাল ছাড়া ছোট পানচিলের কালো টুপিতে সাদা তিলা থাকে

প্রজননকাল ছাড়া এর কালো টুপিতে সাদা তিলা থাকে। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারায় পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ ধূসরাভ অথবা হলদে ও দেহতল সাদাটে হয়।

ছোট পানচিল উপকূল, নদী, মিঠাপানির হ্রদ, লবণ চাষের জমি ও জলাধারে বিচরণ করে। সচরাচর ছোট বিচ্ছিন্ন দলে কিংবা ঝাঁকে থাকে। অগভীর পানির সামান্য ওপরে উড়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে শিকার ধরে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে ছোট মাছ, চিংড়ি ও পানির পোকা। সচরাচর একটিমাত্র কিরিক শব্দে এরা পুনঃপুন ডাকে।

বাচ্চা ফোটার পরপরই ডিমের খোসাটি ঠোঁটে করে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসে বাবা পাখি

মে থেকে জুন তাদের প্রজনন মৌসুম। তবে সঙ্গী খোঁজা শুরু করে মার্চের মাঝামাঝি। বালুকাবেলায় হালকা গর্ত করে এরা ডিম পাড়ে। বালুরঙের ডিমের ওপরে হলদে, ধূসরাভ বা সবুজে আমেজ এবং দু-তিনটি কালচে বাদামি বা লালচে বাদামি ফুসকুড়ি, তিল বা ছোট দাগ থাকে।

বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে নদী ও উপকূলে এদের দেখা যায়।