ঢাকা থেকে কয়েকটি পথে অষ্টগ্রামে যাওয়া যায়। আমি গিয়েছি ভৈরব ঘুরে।
সকাল সাতটায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে সোহাগ পরিবহনের প্রথম বাস ছেড়ে যায়। সেই বাসে চেপে ভৈরবে পৌঁছাই। সেখানে সকালের নাশতা সেরে সিএনজি নিয়ে চলে যাই কুলিয়ারচর। অষ্টগ্রাম যাওয়ার জন্য কুলিয়ারচর লঞ্চঘাটে নৌকা, ট্রলার লঞ্চ ও স্পিডবোট রয়েছে। সময় বাঁচাতে উঠে পড়লাম স্পিডবোটে।
আগস্টের সকালে অষ্টগ্রামের উদ্দেশে ছুটল স্পিডবোট। চারদিকে বিপুল জলরাশি। চালককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা, পানির গভীরতা কেমন?’
বললেন, ‘দেড় খান মানুষ হইব।’ একটু থেমে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘কেন ডরাইতেছেন?’
কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে গল্প করলাম। গল্প বলতে নানা জিজ্ঞাসা—এই নদীর নাম কী, এই হাওরের নাম কী ইত্যাদি। স্পিডবোটে স্থানীয় লোকজন ছিলেন, তাঁরা আমাদের কথোপকথন বেশ উপভোগ করছেন বলে মনে হলো।
স্পিডবোট এগিয়ে চলেছে। বসে বসে দেখছি দ্বীপের মতো গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি, প্রতিটি বাড়ির সামনে নৌকা বাঁধা। আর চারদিকে মাছ ধরার ছোট–বড় নৌকা। শুষ্ক মৌসুমে এখানে আসা হয়নি, কিন্তু হবিগঞ্জ–সুনামগঞ্জে গেছি। তখন এই রূপ থাকে না, মাটি জেগে উঠলে সেটা আরেক রূপ। এখানেও এ রকমই হওয়ার কথা।
দ্বীপগ্রামগুলো দেখতে দেখতে অষ্টগ্রাম স্পিডবোট ঘাটে এসে পৌঁছালাম। থানার সামনেই ঘাট। সেখান থেকে ইজিবাইকে করে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে গেলাম। রুমে ব্যাগপ্যাক রেখে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। শহর ঘুরে বেড়ানোর একটিই বাহন—ইজিবাইক। আমার প্রথম গন্তব্য কুতুবশাহ মসজিদ।
মোগল আমলের স্থাপনা। মসজিদটি কুতুবশাহ নির্মাণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। মসজিদের সামনে যেতেই বেশ শোরগোল, কয়েকজন মিলে বাগ্বিতণ্ডা করছে। তাঁদের কথাবার্তায় বুঝলাম, কোনো নারী মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন, সেই নিয়ে তর্ক। আমি দাঁড়িয়ে ভাবছি, ঠিক এ সময় ঢুকব না অপেক্ষা করব। তাঁদের তর্ক উপেক্ষা করে আমি প্রবেশ করলাম। সামনে থেকে মসজিদের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সামনের চত্বর পুরো টাইলস করা, বাঁশ আর চাঁদোয়া টাঙিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার ফলে মোগল মসজিদ ঢেকে গেছে। হেঁটে হেঁটে পেছনের এক কোনায় গেলাম। সেখান থেকে মসজিদ দেখা যাচ্ছে। পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি খুব যত্নে নেই। যদিও এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে।
মসজিদের বাঁ পাশে পাঁচটি সমাধি আছে। প্রতিটি সমাধিতে টেরাকোটার কাজ। সমাধিগুলোতে কোনো নামফলক নেই। অনেকে এটিকে পাঁচ পীরের মাজার বলেন।
মসজিদ থেকে কিছুটা দূরে একটি জায়গায় আছে কুতুবশাহর সমাধি। গিলাফ দিয়ে ঢাকা। প্রতিবছর এখানে ওরস হয়। প্রতিটি সমাধির সামনে মোমবাতি রাখার জায়গা। হয়তো ভক্তরা মানত করেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার বইতে পড়েছিলাম, এই মসজিদ ও সমাধিগুলো ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হতে পারে।
পনিরের অষ্টগ্রাম নাকি অষ্টগ্রামের পনির? সে যাহোক, এখন বিষয়টি সমার্থক। এ অঞ্চলে পনির তৈরির ইতিহাস ৩০০ বছরের পুরোনো। দত্তপাড়া নামের এক এলাকায় শুরু হয় পনির তৈরির কাজ। তারপর ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক প্রসার লাভ করে। এখন প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে পনির।
দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর বাড়ির সামনে, দোকানে পনিরের পসরা বসে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে একজন পনির বিক্রেতার সঙ্গে দেখা হলো। নাম আকবর আলী। পনির তৈরি ও বিক্রির ব্যবসায় এসেছেন বাবার হাত ধরে। মসজিদ থেকে অল্প কিছু দূরেই তাঁর কারখানা। সেখানে গিয়ে পনির তৈরির পদ্ধতি দেখার সুযোগ হলো।
তখনো দুপুরের খাবার খাইনি। তাই বাজারের উদ্দেশে রওনা করলাম। অষ্টগ্রাম বাজারে ভাতের দুটি হোটেল। দুপুরের খাবার যেটিতে খেলাম, তার নাম মিনহাজ খাবার হোটেল। খাবারের মান ও স্বাদ মোটামুটি। খেয়ে রওনা করলাম ‘ব্যাটল অব কাস্তুল’ দেখতে।
অষ্টগ্রামে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল কাস্তুল অঞ্চলে পা রাখা। এই অঞ্চলে এখন বাজার, লোকালয় গড়ে উঠেছে। তাই হয়তো ইতিহাসটা স্থানীয় বাসিন্দারাই বলতে পারবেন না বা জানেন না। তারপরও আমার ইচ্ছা, সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খাওয়া।
১৫৭৫-৭৬ সালে ঈশা খাঁ এখানে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ঈশা খাঁ আর মোগল সেনাপতি মানসিংহের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাসে এই যুদ্ধকে ‘ব্যাটল অব কাস্তুল’ বলা হয়।
কাস্তুল এখন অবশ্য বিখ্যাত রসমালাইয়ের জন্য। স্থানীয় একজন বয়োজ্যেষ্ঠের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলছিলেন, ৭০-৮০ বছর আগে এখানে জঙ্গল ছিল। কাস্তুলে ঈশা খাঁর সঙ্গে মোগলদের যুদ্ধের কথা তিনি জানেন।
কাস্তুলের গরম রসমালাই খেতে হলে আপনাকে বিকেলে আকাশ সুইটমিটে যেতে হবে। ছোট এক প্লেট রসমালাইয়ের দাম ৫০ টাকা। দোকানির সঙ্গে গল্প করতে করতে একপর্যায়ে বললেন, ‘বাজারে আমাদের কারখানা রয়েছে, চলেন কারখানা দেখে আসি।’ গিয়ে দেখলাম ২২–২৩ বছরের উজ্জ্বল এক তরুণ বিশাল কড়াইয়ে মিষ্টি জ্বাল দিচ্ছেন। তাঁর নামই আকাশ। তিনিই দোকানের মালিক। বাবার ব্যবসায় হাত দিয়েছেন। নিজেই বানান রসমালাই। সাহায্যকারী রয়েছেন বেশ কয়েকজন। ডিজিটাল সময়ে এ রকম কর্মঠ ও পরিশ্রমী তরুণকে দেখে ভালো লাগল।
প্রথম দেখায় মসজিদটিকে খুব সাধারণ মনে হবে। একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে প্রাক্-মোগল নির্মাণশৈলী। কাস্তুল বাজারের খুব কাছেই এই মসজিদ।
একটি ফলকে দেখতে পেলাম মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা উলুঘ খান। প্রতিষ্ঠাকাল ১৪৫৬ সাল। মসজিদ চত্বরে দুটি কালো পাথরখণ্ডও চোখে পড়ল। মসজিদের চার ধারের মেঝেতে চিনি টিকরির কারুকাজ বিদ্যমান।
এটি অষ্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিরো পয়েন্টে পর্যটকের ভিড় লেগে যায়। আর ছুটির দিনগুলোতে তো তিল ধারণের জায়গা থাকে না। পথের চারপাশজুড়ে কয়েকটি খাবার হোটেল হয়েছে। হাওরের পাশে ইংরেজিতে বেশ সুন্দর করে লেখা ‘আমি অষ্টগ্রাম ভালোবাসি’। সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের স্মৃতি ধরে রাখে সবাই। জিরো পয়েন্টে বসানো হয়েছে একটি জাহাজ। এটি টর্পেডোবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘টি–৮২২৩’। চীনের তৈরি জাহাজটি ৩৪ বছর ব্যবহারের পর এখানে স্থাপন করা হয়েছে।
অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনা সংযোগ সড়ক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ। দুই ধারে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি আর মাঝের পথটিকে আমার কাছে মনে হচ্ছিল প্রথম বিশ্বের মেরিন ড্রাইভের পথ।
আহা! আমার দেশ কত সুন্দর। এই পথকে উত্তরের মেরিন ড্রাইভ বললেও অত্ত্যুক্তি হবে না।
স্পিডবোটে অষ্টগ্রাম আসার সময় এর আধা রূপও দেখতে পাইনি। দ্বীপগ্রামগুলোকে কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে বাড়ির লোকজন শহরে আসছে, নৌকা চালিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাচ্ছে। কেউ মাছ ধরছে, কিছু কিছু বাড়িতে হাঁসের খামার। শত শত হাঁস পানিতে খেলছে। খুব সহজ সরল দৃশ্য, তারপরও দারুণ প্রাণবন্ত ও মনকাড়া।
অটোরিকশা আমাদের নিয়ে গেল তিন শহরের জিরো পয়েন্টে। আজ যাত্রা এ পর্যন্তই। সূর্য অস্ত যাচ্ছে।