‘থ্যাংক ইউ, আমি তোমাকে বালোবাসি’

৬৩ বছর বয়সে এসে হিমালয়ের প্রেমে পড়েন ইফতেখারুল ইসলাম। এভারেস্ট বেসক্যাম্প ভ্রমণ নিয়ে ২০২১ সালে লিখেছেন বই—‘যেখানে এভারেস্ট’। হিমালয়ের ডাকে এ বছরও গিয়েছেন গোকিও। গোকিও রির শীর্ষ থেকে দেখেছেন এভারেস্টসহ বিখ্যাত সব পর্বতশিখর। সে অভিযাত্রার পঞ্চম পর্ব পড়ুন আজ।

মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয় অমা ধবলাম

ভোরবেলা নামচেবাজার থেকে ডোলের পথে বেরিয়ে পড়ি। শুরুতেই ৩০ মিনিটের খাড়া চড়াই। সকালের সজীব-সতেজ পা ফেলে এই জায়গাটুকু উঠতে খুব বেশি কষ্ট হয় না। পরের দেড় ঘণ্টা খানিকটা সমতল, খানিকটা ধীর চড়াই। স্থানীয় এক প্রবীণ ট্রেকারদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এই রাস্তার অনেকখানি অংশে উন্নয়নকাজ করে চলেছেন। আজও তিনি পথের ধারে বসে আছেন চেয়ার পেতে। এই পথের সব ট্রেকারই তাঁকে কিছু কিছু টাকা দিয়ে যান। তাঁর কাজের ফলে পাহাড়ি পথটি আগের চেয়ে সমতল ও সহজ হয়েছে। সেসব অংশ পার হয়ে খুংজুম পৌঁছে কফি–বিরতি নিই। আকাশে মেঘ উড়ে বেড়ায়, ঢেকে যায় অমা ধবলামের অনিন্দ্যসুন্দর শিখর দুটি।

বিরতি শেষ করে একটু এগিয়ে এভারেস্ট বেজক্যাম্পের (ইবিসি) পথ ডানে রেখে গোকিওর দিকে যাত্রা করব। ওইখানে ইবিসি আর গোকিওর পথ আলাদা হয়ে গেছে। আগেরবারই দেখেছি, একটা বোর্ডে দুই দিকের পথনির্দেশ দেওয়া আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে এবারও একটা ছবি তুলতে চাই। ঠিক এ সময় দেখি ইবিসির দিক থেকে তরুণদের একটা দল এদিকে আসছে। এঁরা সব গোকিওর যাত্রী নাকি? বাহ, তাহলে গোকিও যাওয়ার জন্যও বেশ কজন ট্রেকার সঙ্গী পাব।

গোকিওর অভিযাত্রী বেন, মাইকেল ও তাঁদের সঙ্গীরা

তাঁদের মধ্যে যিনি আমার সবচেয়ে কাছে, তাঁর সঙ্গে কথা বলি। তাঁর নাম বেন। লন্ডন থেকে এসেছেন। গোকিও যাচ্ছি শুনে খুবই উষ্ণতার সঙ্গে আমাকে বলেন, ‘ওয়েলকাম টু আওয়ার গ্রুপ।’ অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই খুব সজীব ও উচ্ছল, কেউ কেউ অনেক কথা বলেন।

পার্বত্য পথে হাঁটার সময় কাছাকাছি কাউকে পেলে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে না। একটু আগে যেখানটায় দাঁড়িয়ে আমি ছবি তুললাম, সেখানেই সবাই মিলে দাঁড়িয়ে আরও ছবি তোলা হয়। ইংরেজিতে আপনি-তুমি পার্থক্য নেই। তবু কিছুক্ষণের মধ্যে বেনের সঙ্গে সম্পর্কটা তুমিতে পৌঁছে গেল বলে মনে হয়। ওদের জানাই যে আমি খুব ধীরে হাঁটব। বেন বলে, তারাও ধীরে হাঁটবে। বারবার থামবে। অতএব আমরা যে যার গতিতে ট্রেক করতে থাকি। আমাদের বয়স, ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা হলেও চেষ্টা করি ওদের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে। গালভরা দাড়ি আর নাকের মাঝখানটায় বড়সড় একটা নোলক পরা মাইকেলের সঙ্গে কথা বলার সময় বারবার ওর নাকের দিকে না তাকানোর চেষ্টা করি।

উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ

পঁচিশে বৈশাখে

আগের দিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ। নামচেতে রডোডেনড্রন ফুলে ঢেকে থাকা অল্প কয়েকটা গাছ দেখেছি। তখন রবীন্দ্রনাথ আর ‘শেষের কবিতা’র কথা মনে পড়েছে বারবার। আজ দেখি পথের দুপাশে অনেক গোলাপি ও বেগুনি রডোডেনড্রন। গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফুটিয়ে পুরো পথটিকে তারা অপরূপ রঙিন করে রেখেছে। সে পথ আমাদের মতো হিমালয় যাত্রীদের বন্ধনহীন গ্রন্থিতে বেঁধে দেয়। ‘প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে অরুণকিরণে তুচ্ছ, উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ।’

ছবি তুলতে গিয়ে একটু থামি। ঠিক ওই সময়ে লাল টুকটুকে জ্যাকেট পরা এক ভারতীয় বালিকার দেখা পাই। নাম জোহরা। সে আর তার বন্ধু শিবা চলেছে গোকিওর পথে। সেখান থেকে চোলা পাস হয়ে ইবিসিতে যাবে তারা। তাদের অন্য দুজন বন্ধু ইবিসিতে যাচ্ছে সরাসরি। সেখানে গিয়ে সবাই একত্র হবে।

হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। ওরা দুজনেই কেরালার মেয়ে এবং মোটেই বালিকা নয়। দুজনেই সাবালিকা, পেশাজীবী, থাকে বেঙ্গালুরু। একজন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করে আর অন্যজন ওষুধশিল্পের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে। ওদের দুজনেরই পরিবার রয়েছে। অর্থাৎ স্বামী ও সন্তান আছে। সেই রুটিন জীবন থেকে মাঝেমধ্যে তারা শুধু নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করে নেয়। এই মেয়েরা কেমন স্বাধীন ও সাবলীলভাবে হিমালয়ের পথে–প্রান্তরে যার যার মতো ট্রেক করে চলছে, দেখে মোহিত হই। জোহরাকে বলি, ‘তোমরা এগিয়ে যেতে পারো। আজকের ট্রেক দীর্ঘ। বয়সের কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমাকে একটু ধীরগতিতে হাঁটতে হয়।’

সে আশ্চর্য সুন্দরভাবে হেসে বলে, ‘লুকিং অ্যাট ইউ আই থিঙ্ক এইজ ইজ জাস্ট আ নম্বর।’ হয়তো ঠিক। মনের ইচ্ছে ও মানসিক শক্তি দিয়ে কিছু অসাধ্যসাধন করা যায়। তবু সে শক্তি যতই প্রবল হোক, নম্বরটাই আসল, সংখ্যাটাই সত্য—তাকে হেলাফেলা করা যায় না। কিন্তু জোহরার কথা শুনে খুশি হই। একটু অনিশ্চিত ক্ষীণ কণ্ঠে ওকে বলি, ‘থ্যাংকস জোহরা, আবার দেখা হবে।’

মেঘলা আকাশের নিচে পাহাড়ের ঘুম

কাউন্টারের পাশে বকশিশ বাক্স

কফি, অমা ধবলাম দেখা আর অনির্ধারিত রডোডেনড্রন বিরতির পর খুমজুং থেকে ৩০ মিনিটের খাড়া চড়াই। তারপর দেড় ঘণ্টা ক্রমাগত উঁচুতে ওঠা শেষ করে যখন আমার হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক দ্রুত হয়েছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, তখন দুপুর। ঠিক সময়ে খাওয়ার জন্য থেমেছি।

মাশরুম সুপ বেশ মজার একটা খাবার। ৩৯৫০ মিটার উচ্চতায় মংলাদাদা নামের একটা জায়গায় থেমে সেখানকার একটা ছোট রেস্তোরাঁয় মাশরুম স্যুপ খেতে চাই। সময়টুকু এই রেস্তোরাঁয় বেশ আনন্দে কাটে। নবীন দম্পতি। দুজনে মিলে লজ চালায়। দুপুরে আমি বেশি খেতে পারি না, তবু কখনো সামান্য ডালভাত খাই, কখনো শুধু এক বাটি স্যুপ। কখনো মোমো। এখানে মোমো ও মাশরুম স্যুপ অর্ডার দেওয়ার পর বসে বসে মন দিয়ে মোবাইলে তোলা ছবি দেখি। চারপাশে কী ঘটছে, তার দিকে একটুও মন দিইনি। একটু পর তেজ বলল, আমার পরে জোহরা ও শিবা এসে সামান্য কিছু খেয়ে চলেও গেছে।

রেস্তোরাঁর মালিক বা ম্যানেজার যেখানে বসেন, সেখানে কাউন্টারের পাশে একটা বকশিশ বাক্স রাখা আছে। খেয়ে ওঠার সময় আমি তেজকে কিছু টাকা দিয়ে বলি ওই বাক্সে দিয়ে আসতে। কাউন্টার থেকে যুবকটি আমাকে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানান। তেজকে নেপালি ভাষায় জিজ্ঞেস করেন আমি কোথা থেকে এসেছি। বাংলাদেশ—শুনেই সেই যুবক বলে ওঠে, ‘থ্যাংক ইউ, আমি তোমাকে বালোবাসি।’ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলি, ‘তোমার কথাটা ঠিক আছে, কিন্তু তুমি আমাকে বললে ঠিক মানায় না। ওই মেয়েটিকে বলো, আমাকে এ কথা বলতে।’ মেয়েটি খুবই সপ্রতিভ। সে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে, ‘আই ক্যান সে দ্যাট। বাট হি উইল কিল মি।’ থাক তোমাদের মারামারি করতে হবে না। তোমরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসো।

ক্ষীণাঙ্গী নদীটি নাচ জানে

দুধকোশি নদীর কিনারে

আবার পথে নামি। এরপর এক ঘণ্টা খাড়া উতরাই পথে নিচে নেমে যেতে হয়। নামতে নামতে একসময় মনে হয় কাঠমান্ডু পর্যন্ত নেমে যাচ্ছি না তো। উতরাই ধরে নামতে গেলে সব সময় মনে পড়ে, একটু পরেই, আজ হোক অথবা আগামীকাল—এর সমপরিমাণ চড়াই ধরে আবার আমাকে উঠতেই হবে। আপাতত নেমে যাই একেবারে দুধকোশি নদীর কিনারে।

দুধকোশি নদীটি চমৎকার নাচ জানে। যাত্রাপথে কতবার কত জায়গাতে দেখেছি, তবু প্রত্যেক জায়গায় নদীটিকে নতুন লাগে। নতুন লাগে তার নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গি। সজীব, দুরন্ত, বন্য, তেজস্বিনী এই নদীটির যেন প্রাণ আছে। ছোট–বড় অসংখ্য পাথরের ওপর সগর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়া নদীর দুধসাদা উচ্ছল জলধারা দেখি। শুনি তার কলস্বর। এখানে নদীর কাছে পৌঁছানোর আগে একটা বড় ঝরনা দেখে এসেছি। আর একটু এগোতেই আরও একটা চমৎকার ঝরনা দেখতে পাই। উঁচু পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েই পাহাড়ি নদীর মতো আকুল হয়ে দুধকোশিতে গিয়ে মিশেছে। ঝরনার পাশে বসে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি বরফশীতল পরিষ্কার পানি। ঠান্ডা-ছুরির মতো ধারালো। এ রকম আরও একটা ঝরনার কাছে যাওয়ার আগেই তেজ আমাকে সতর্ক করে। ওই জায়গাটা দ্রুত পার হয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়। এখানে পাথরধস নাকি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায়ই ওপর থেকে গড়িয়ে আসে বড় বড় পাথর। নিচে গড়িয়ে পড়ার সময় অন্য পাথরে লেগে সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বেশ কিছুটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে সেসব পাথরের টুকরো। তাই এসব জায়গায় থামতে নেই।