ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গ ছুঁয়ে বাংলাদেশে পড়েছে তিস্তা। সেই নদীর ওপর বাঁধ দিয়েছে ভারত। বাঁধের নাম তিস্তা বাঁধ বা তিস্তা ড্যাম বা ব্যারাজ। ২০১৭ সালের মে মাসে সেই বাঁধ দেখতে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলাম। তিস্তা বাঁধের পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিতর্ক তখন তুঙ্গে।
তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত সরকার নমনীয় থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তীব্র আপত্তি ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন করা যাবে না। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বিতর্কের অবসান আজও হয়নি।
তিস্তার উৎপত্তিস্থল ভারতের হিমালয়ের পাদদেশের রাজ্য সিকিম। জানা গেছে, হিমালয়ের ৭ হাজার ৬৮ মিটার উচ্চতায় কাংসে হিমবাহ থেকে তিস্তার সৃষ্টি। এখান থেকে লাচেন চু এবং ল্যাচুং চু নামের দুটি নদীর ধারা সিকিমের চুংথান জনপদে নেমে একটি ধারায় তিস্তা নামে প্রবাহিত হয়েছে। সেটিই আজকের তিস্তা নদী। এখান থেকে সিকিমের রংপোতে চলে আসে এই ধারা। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে পড়েছে এই তিস্তা।
পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় তিস্তা নদীর ওপর তৈরি হয়েছে ২৮৫ ফুট উঁচু বাঁধ। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ মেগাওয়াট। বাঁধস্থলে বর্ষা মৌসুমে পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে কম। চর পড়ে যায়। এই বাঁধে পানি আটকে রেখে সেই পানি শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজে ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এ সময় বাংলাদেশেও পানির অভাব দেখা দেয়। তাই বাংলাদেশ দাবি করছে, ফারাক্কার ন্যায় তিস্তার পানি বণ্টনেরও একটি চুক্তি হোক।
৭ বছর পর এই তিস্তা বাঁধের পাড়ে আবার হাজির হয়েছিলাম। জলপাইগুড়ি থেকে সড়কপথে গজলডোবায় যখন বাঁধ পার হই, মনে ভেসে এল ৭ বছর আগের ছবি। বাঁধের ডান দিকে জল। বাঁ দিকে চর। নদী শুকিয়ে গেছে প্রায়। চারদিকে চর। মাঝে মাঝে পানির ক্ষীণ প্রবাহ। তবে এদিন চোখে পড়ল তিস্তা বাঁধের একটি স্লুইসগেট খোলা। প্রবল বেগে নেমে আসছে পানি। ছড়িয়ে পড়ছে চরপড়া তিস্তা নদীতে। আর বাঁধের ডান দিকের তিস্তা নদীতে পানি রয়েছে।
বাঁধের পাশেই তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের কন্ট্রোল রুম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ দপ্তর এই তিস্তা বাঁধ নিয়ন্ত্রণ করে। দেখভাল করে। আবার এই তিস্তা বাঁধ থেকে ক্যানেলের মাধ্যমে নিকটের মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পানি। এই পানি শুষ্ক মৌসুমে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়। ক্যানেলে আরেকটি ছোট বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। নাম মহানন্দা বাঁধ। জলপাইগুড়ির ফুলবাড়ীতে এর অবস্থান।
তিস্তার ওপর সবচেয়ে বড় বাঁধটি হলো এই গজলডোবার তিস্তা বাঁধ। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রধান বাঁধে রয়েছে ৪৫টি স্লুইসগেট গেট। আর পাশের দুটি ক্যানেলের ওপর তৈরি ছোট্ট দুটি বাঁধে রয়েছে আরও ১৩ ও ৪টি স্লুইসগেট।
গজলডোবা বাঁধের একদিকে গজলডোবা অন্যদিকে মিলনপল্লি। বাঁধ থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে কোচবিহারের মেখলীগঞ্জের ঝাড় সিংহাসন সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে তিস্তা।
৭ বছর আগে যখন গজলডোবায় গিয়েছিলাম, তখন বাঁধের পাড়ে নদীর তীরে মাত্র দুটি চা ও ভাতের হোটেল দেখেছিলাম। এবার দেখি অনেক রেস্তোরাঁ, হোটেল। রাস্তার দুপাশে বড় বড় দোকান। কাঁচাবাজার খুলেছে। মাছ বাজার হয়েছে। আশপাশের গ্রামের মানুষ এখানে আসেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করেন। মোটামুটি জমজমাট বাজার। এখন এটি এক পর্যটন কেন্দ্রের রূপ নিয়েছে। মানুষ আসছে, বাঁধ দেখছে। নিকটেই পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন দপ্তর গড়ে তুলেছে একটি রিসোর্ট। নাম ভোরের আলো।
আর একটি কথা বলতে হয়, এই গজলডোবার তিস্তা নদীতে মেলে ছোট্ট মাছ বোরোলি। খুবই সুস্বাদু। আমাদের চেলা মাছের মতো। শুনেছি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর এই মাছ অত্যন্ত প্রিয় ছিল। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁরা এই মাছের স্বাদ নিতে ভুলে যান না।
নতুন আরেকটা কথা শুনলাম এবার। গত অক্টোবরে সিকিমের দক্ষিণ লোনাক হ্রদে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ফলে প্রচুর পানি নেমে আসে।
ভেসে যায় তিস্তার দুপাড়ের বহু জনপদ। সেই বিপর্যয়ের পর ধীরে ধীরে গতিপথ বদলাতে শুরু করে তিস্তা। উপগ্রহের ছবিতে ধরা পড়ে এই বদল। সেই গতিপথ কতটা বদলেছে, কীভাবে বদলাচ্ছে, দেখার জন্য আগামী মাসে বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রিভার ইনস্টিটিউট। এই বিশেষজ্ঞ দল পশ্চিমবঙ্গের সেবক থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত তিস্তার গতিপথ সরেজমিন পরীক্ষা করবে।