পর্বতারোহণের মর্যাদাপূর্ণ একটি অভিযান ‘স্নো লেপার্ড চ্যালেঞ্জ’। এই অভিযান সম্পন্ন করতে তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে অবস্থিত পামির ও তিয়েন শান পর্বতশ্রেণির পাঁচটি সাত হাজার মিটারের শৃঙ্গে আরোহণ করতে হয়। রোমাঞ্চকর অভিযানটি শুরু করেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী সালেহীন আরশাদী ও ইমরান খান। তিন পর্বের এই অভিযানে প্রথম পর্বে অভিযাত্রীরা গেছেন কিরগিজস্তানের লেনিন শৃঙ্গ আরোহণে। সেখান থেকেই প্রথম আলো অনলাইনের জন্য নিয়মিত লিখছেন সালেহীন আরশাদী। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব
গতকাল বিকেল চারটায় আমরা বেজক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-১ পৌঁছেছি। পৌঁছানোর পর থেকেই আবহাওয়া খারাপ। প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি দিয়ে শুরু হলেও সন্ধ্যা সাতটার দিকে তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। আবহাওয়ার কারণে গতকাল ওয়াইফাইয়ের সংযোগ ছিল না। সারা রাত ধরে আমাদের তাঁবুর ওপর বৃষ্টি ঝরে গেছে। বৃষ্টির কারণেই হবে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা মাইনাস ৬ ডিগ্রি হয়ে গেল।
বেজক্যাম্প থেকে ক্যাম্প–১ আসার পথে মজার একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের কাঁধে ভারী ব্যাকপ্যাক দেখে এক বুড়ো কিরগিজ তাঁর রুশ মিলিটারি জিপ দিয়ে আমাদের কিছু দূর এগিয়ে দিয়েছিলেন। খুব বেশি পথ অবশ্য যাওয়া সম্ভব হয়নি। এবড়োখেবড়ো পথের কারণে গতিও তেমন তুলতে পারেননি। তবুও রুশ জিপটি দেখে আমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় নির্মিত কম্পিউটার গেমস কমান্ডোজের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। জিপটি আমাদের নিয়ে দিল লুকুভায়া পলিয়ানা নামক একটি সমতল জায়গায়। এটিই সেই বিখ্যাত জংলি পেঁয়াজের আস্তানা। কিছু দূর পর পর বুনো পেঁয়াজের গাছ হয়ে আছে। একটি পেঁয়াজ কলি ছিঁড়ে ঘ্রাণ নিতে আমাদের পেঁয়াজের মতোই লাগল। একজন রাশিয়ান ক্লাইম্বারকে দেখলাম হাঁটতে হাঁটতে পেঁয়াজ কলি ছিঁড়ে নিচ্ছেন, স্যুপে দেবেন বলে।
ক্যাম্প–১ এ আসার রাস্তাটি প্রথমে আমি খুব সহজ হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু পথটি প্রথমেই খাঁড়া হয়ে উঠে গেছে একটি একটি পর্বতের ঢাল বেয়ে। ওপরে উঠে একটি সাইনবোর্ডে লেখা দেখতে পাই এটি একটি গিরিপথও, নাম পুটেশেভেনিকভ পাস। আশা করছি, গিরিপথের নামটি ঠিকঠাক বাংলায় লিখতে পেরেছি। আর ভুল হলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অনেক দিন আগে স্বাধীনতা পেলেও এই জায়গাগুলোর এখনো রুশ নামই রয়ে গেছে। জায়গার নাম রুশ, ভাষা রুশ, খাবারদাবার রুশদের।
পাস থেকে পথ আমাদের নামিয়ে দিল একেবারে লেনিন পিকের হিমবাহে। এই হিমবাহ ধরে এগিয়ে যাওয়া আমার খুব অপছন্দ। এখানে পথের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এটা খাঁড়া উঠে আবার নেমে যায়। এভাবে প্যাঁচানো একটি পথ ধরে পুরো হিমবাহ অংশটি অতিক্রম করতে হলো। কিছুক্ষণ পর আবারও পথ আমাদের হিমবাহের ওপরে নিয়ে গেল। এবার দূর থেকে হলুদ রঙের তাঁবুগুলো দেখতে পেরেছিলাম। অদূর ভবিষ্যতে মানুষ চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপন করলে এমনই জঘন্য লাগবে দেখতে। হিমবাহের ওপরেই এজেন্সিগুলো জায়গা দখল করে নিজেদের তাঁবু সারিবদ্ধ বসিয়ে দিয়েছে। বেজক্যাম্পের মতো এত সুযোগ-সুবিধা না থাকলে যতটুকুই আছে, কোনো পর্বতারোহীই মনে হয় এমনটা প্রত্যাশা করেন না। অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম ও ত্রিপল দিয়ে বানানো ফুটবল সাইজের শামিয়ানাটি এখানকার ডাইনিং।
গতকাল খারাপ আবহাওয়ায় আমরা নিজেরা আর রান্নার ঝামেলায় যাইনি। ক্যাম্পের ডাইনিংয়ে খুব অদ্ভুত একটা ডিনার করেছিলাম। গরুর কিমার সঙ্গে অল্প একটু ভাত মাখিয়ে পুরো জিনিসটি একটি বিশাল আকারের মরিচের মধ্যে পুরের মতো ঢুকিয়ে সেটিকে আবার আলু ও গাজরের স্যুপের মধ্যে ডুবিয়ে সেদ্ধ করে দিয়েছে। প্রতিজনের পাতে দুটি করে স্টাফড মরিচ, এই হলো গতকালের ডিনার। এই ডিনারের জন্য আমাদের গুনতে হলো জনপ্রতি ১৫ ডলার করে। অজিল (ইমরান খান) সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষণা দিয়েছে, সে না খেয়ে থাকবে তবুও খাবারের নামে এমন প্রহসন মেনে নিবে না। ১ হাজার ৫০০ টাকায় ঢাকায় কী কী খেতে পারতাম, সেই তালিকা করতে করতে আমরা ঝটপট ঘুমিয়ে গেলাম।
৪ আগস্ট ২০২৩