লোলো মোরার স্বাদ নিচ্ছেন লেখক
লোলো মোরার স্বাদ নিচ্ছেন লেখক

এয়ারপোর্টে চাল–ডাল হারানোর ক্ষোভ ঘুচিয়ে দিল লোলো মোরা

কোস্টারিকার রাজধানী শহর সান হোসের দোকানটির বয়স ১২৪ বছর। এত দিন ধরে লোলো মোরা নামের বিশেষ এক আইসক্রিম বানায় তারা। ব্যবহার করে গোপন এক রেসিপি। শতাব্দীপ্রাচীন সেই দোকানে আইসক্রিমের স্বাদ নিয়ে এসেছেন মহুয়া রউফ

ইমিগ্রেশন শেষ করে বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্ট থেকে বের হতেই একটা চেকিং পয়েন্ট। সেখানে আমার লাগেজ খুলল। ভেতর থেকে বের করে আনল এক কেজি চাল আর আধা কেজি মসুর ডাল। কোনো কথা না বলেই ফেলে দিল ডাস্টবিনে। আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বললাম, শুকনা খাবার তো? দোষটা কী?

বলল, ‘আমরা শস্য নেওয়ার অনুমতি দিই না।’

একটা লম্বা নিশ্বাস নিলাম। দ্রুত বেদনা কমানোর চেষ্টা। চলে যাচ্ছিলাম। আবার ঘাড় ঘুরিয়ে অভিমান নিয়ে বললাম, ‘আমার ডালের বাক্সটা দিয়ে দাও। ওটা তো শস্য নয়।’

পুলিশের পোশাক পরা নারী কর্মকর্তাটি তাঁর গ্লাভস পরিহিত হাতটা ঢুকিয়ে দিলেন ডাস্টবিনে। উঠিয়ে আনলেন আমার বাক্স। ডাল ফেলে দিয়ে ফেরত দিলেন। ডাল-চাল হারিয়েছি তো কী হয়েছে, আমার বাক্সটা তো উদ্ধার করতে পেরেছি। ইমিগ্রেশনে এ–ও কম বাহাদুরি নয়!  

কোস্টারিকার সান হোসে শহরের সেন্ট্রাল মার্কেটে বিশেষ আকর্ষণ ‘লোলো মোরা’, এটি আইসক্রিমের দোকান
ছবি: মহুয়া রউফ

কোস্টারিকায় পা ফেলার সময় এমন অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। পরদিন সকালে গেলাম সান হোসে শহরের সেন্ট্রাল মার্কেটে। এ মার্কেটে এক বিশেষ আকর্ষণ ‘লোলো মোরা’। এটি আইসক্রিমের দোকান। আর আইসক্রিমের পুরো নাম লা সোরবেটেরা দে লোলো মোরা। যার খবরাখবর আগে থেকেই জানতাম।

সেন্ট্রাল মার্কেটে ঢুকে মনে হচ্ছিল, পুরান ঢাকার পাইকারি বাজারে ঢুকেছি। চলতে চলতে আশপাশের মানুষকে লোলো মোরা বলতেই দেখিয়ে দিচ্ছেন কোন দিকে যেতে হবে। সরু অলিগলির ভিড়ভাট্টা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত দোকানে। 

শতবর্ষী দোকানের আইসক্রিম

সরু লম্বাটে ছোট্ট একটা দোকান। দোকানজুড়ে হলুদের ঝলকানি। গোটা দশেক চেয়ার পাতা। যাতে জনা দশেক মানুষ বসতে পারেন। আর জনা বিশেক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। দোকানের ভেতরে ঝুলে থাকা আয়তাকার একটি সাইনবোর্ডে লেখা, এই দোকান ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত, অর্থাৎ সময়ের হিসাবে দোকানটির বয়স ১২৪ বছর পেরিয়েছে! শতাব্দীর বেশি সময় ধরে গ্রাহকদের এক সিগনেচার ফ্লেভার দিয়ে আসছে লোলো মোরা।

বসার টুলগুলো উঁচু। আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। আশপাশটা দেখছি। একটি উঁচু টুল খালি হলে বসে পড়লাম। প্রথমে দাম জানতে চাইলাম। বিক্রেতা বললেন, ‘আগে একবার এক চামচ খেয়ে দেখো, তবেই না…।’

দোকানজুড়ে হলুদের ঝলকানি

এক চামচ খেলাম। স্বাদ স্বতন্ত্র। কাস্টার্ড স্বাদের আইসক্রিম। আমার সামনে এবার পাঁচটা ছোট কৌটো এনে রাখলেন বিক্রেতা। বললেন, ‘যা খেয়েছ, তার মধ্যে এই ফ্লেভারগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। কৌটাগুলো খুলে দেখো।’

যেসব মসলা ব্যবহার করা হয় আইসক্রিম বানাতে

আরে, এ তো গরমমসলা, দারুচিনি, জায়ফল, লবঙ্গ। আরও দুটি মসলা ছিল, চিনতে পারিনি। আইসক্রিম বানাতে গরমমসলা লাগে, জানা ছিল না। বিক্রেতা আমাকে দেয়ালের ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এই দোকান শুরু করেছেন আমার বাবার দাদা। দেয়ালের অন্য ছবিটা আমার দাদার। যিনি ক্যাশে বসে আছেন, তিনি আমার বাবা। এটি পারিবারিক পরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত একটি ঐতিহ্য। শুরু থেকে এই গোপন রেসিপিই চলে আসছে।’

লোলো মোরা আইসক্রিম

নানা আকার ও ঢঙের গ্লাসে পরিবেশিত হচ্ছে লোলো মোরা আইসক্রিম। একেক ঢঙের জন্য একেক মূল্য। আমি সবচেয়ে ছোটটি নিয়েছি।

খাওয়া শুরু করা গেল। ক্রিমের মতো। হলুদ দেহ। স্বাদ মধুর। খুব মিষ্টি না, ডায়াবেটিসের রোগীরাও দিব্বি চালিয়ে নিতে পারবেন। ভ্যানিলার গন্ধ নাকে আসছে। মুখে দিতেই দারুচিনির স্বাদ বোঝা যাচ্ছে। ১০০ বছর আগের স্বাদ নিচ্ছি। কিছু ছবি তুলে রাখতে হয়! কিন্তু এত ছোট জায়গায় ছবি তোলা মুশকিল। নিজের ছবি তোলা আরও মুশকিল।

ওরা বলল, কোনো মেশিনে না, ম্যানুয়ালি তৈরি হয় এই আইসক্রিম। শত বছরেও এই আইসক্রিমের দোকানের কলেবর বদলায়নি, বদলায়নি রেসিপি, স্বাদ; শুধু বদলেছে জনপ্রিয়তা। দিগ্‌দিগন্ত ছুঁয়েছে সুনাম। একটা পরিবারের ছোট উদ্যোগ হয়ে উঠেছে জাতীয় ঐতিহ্য।

জনা দশেক মানুষ বসতে পারে দোকানটিতে

টেবিলে কয়েকটি স্টিলের বাটি রাখা। আমি বেকুব, ভেবেছি, হয়তো ব্যবহৃত টিস্যু ফেলার জন্য। পাশের একজন সাবধান করে দিল, এটা বিল দেওয়ার পাত্র। খাবারের পর টাকা এখানে রাখতে হবে। এটা নিয়ে বাকি পাওনা যদি থাকে, এই বাটিতেই ফেরত দেবেন বিক্রেতা। সাবধান হলাম। দেশ–বিদেশে মাঝেমধ্যে উচ্চতর মূর্খের মতো আচরণ করে ফেলি।

খাওয়া শেষ হলো। ভাবলাম, একটু বসি। আইসক্রিম গালের ভেতরে লেগে আছে। একটু  জাবর কাটা যাক। না, বসা গেল না। আইসক্রিম কিনতে আমার পেছনে মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। বসার জায়গা পাচ্ছেন না। আমার ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে কয়েকজন। পেছনে আরও লম্বা লাইন।

আমার এয়ারপোর্টের চাল–ডাল হারানোর ক্ষোভ ঘুচিয়ে দিল লোলো মোরা।