আমরা আজ পৃথিবীর ছাদ পামিরে ঘুমাব

পর্বতারোহণের মর্যাদাপূর্ণ একটি অভিযান ‘স্নো লেপার্ড চ্যালেঞ্জ’। এই অভিযান সম্পন্ন করতে তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে অবস্থিত পামির ও তিয়েন শান পর্বতশ্রেণির পাঁচটি সাত হাজার মিটারের শৃঙ্গে আরোহণ করতে হয়। রোমাঞ্চকর অভিযানটি শুরু করেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী সালেহীন আরশাদী ও ইমরান খান। তিন পর্বের এই অভিযানে প্রথম পর্বে অভিযাত্রীরা গেছেন কিরগিজস্তানের লেনিন শৃঙ্গ আরোহণে। সেখান থেকেই প্রথম আলো অনলাইনের জন্য নিয়মিত লিখছেন সালেহীন আরশাদী। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব

বিশকেক শহরের সর্বত্র সোভিয়েত আমলের ছাপ
ছবি: লেখক

ঢাকা থেকে রওনা দেওয়ার সাত দিন পর আমরা পৃথিবীর ছাদ পামিরে এসে পৌঁছলাম। আজ আমরা আছি ৩ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতায় পিক লেনিনের বেজক্যাম্পে। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন ট্রান্স আলতাই পর্বতমালার পেছন থেকে সুন্দর আর রহস্যময় এক পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিয়েছে।

গত ২৭ জুলাই দেশ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ভারতের মুম্বাইয়ে সাত ঘণ্টা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৬ ঘণ্টা বিরতি ছিল। খরচ কমানোর জন্য আমাদের দীর্ঘ সময়ের ট্রানজিট মেনে নিতে হয়েছে। এভাবে আবুধাবি বিমানবন্দর থেকে কিরগিজস্তানের মানাস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি ২৯ জুলাই রাত ৮টায়। অবাক করা বিষয় হলো, তখন পৃথিবীর এই অঞ্চলে সূর্য অস্ত যায়নি। চারদিকে বিকেলের আরামদায়ক আলো ঝলমল করছিল।

বিমানবন্দরটি মূল শহর বিশকেক থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। চারদিকে যত দূর চোখ যায়, শুধু খেত আর খেত। রুশ একটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ দিয়ে ট্যাক্সি ডেকে চলে যাই আগে থেকে বুক করে রাখা হোস্টেলে। কী চমৎকার রাস্তা! যেমন মসৃণ, তেমনই চওড়া। দুই পাশে বিশাল বিশাল গাছ। ৩০ কিলোমিটার পথ মাত্র ২০ মিনিটে পৌঁছাই। ট্রানজিটের ধকলে শরীর খুব ক্লান্ত ছিল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম।

বিশকেক শহরে কয়েক দিনের কাজ ছিল। অভিযানের জন্য বাধ্যতামূলক বিমা লাগবে। যেনতেন বিমা নয়, ৩০ হাজার ডলারের ‘ইমার্জেন্সি ইভাকুয়েশন ক্লজ’ থাকতে হয় সেই বিমায়। বিমার প্রিমিয়াম দৈনিক ২০ ডলার। সেই সঙ্গে আমাদের কিরগিজস্তান-তাজিকিস্তান বাউন্ডারি জোন পারমিট, ওভিআর রেজিস্ট্রেশন ও ইকোলজিক্যাল ফি পরিশোধসহ বেশ কিছু অনুমতি নেওয়ার কাজ ছিল। ৩০ জুলাই রোববার সরকারি ছুটি ছিল বলে আরও এক দিন আমাদের বিশকেকে থাকতে হল। এটা অবশ্য আমাদের জন্য শাপে বর হয়েছে। সোভিয়েত আমলের একটি রাজধানী শহর ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি।

বিশকেকের কেন্দ্রীয় মসজিদ

সোভিয়েত আমলের চওড়া সব বুলেভার্ড (দুই পাশে বৃক্ষরাজিশোভিত প্রশস্ত রাস্তা), অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, সরকারি অফিস, লাইব্রেরি আর পার্ক ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। তুরস্ক সরকারের অর্থায়নে নির্মিত বিশকেকের কেন্দ্রীয় মসজিদ দেখেও খুব অবাক হয়েছি। পুরো মসজিদটি ইস্তাম্বুলের হায়া সোফিয়ার আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এই শহরে আরেকটি বিষয় খুব নজর কেড়েছে। সেটা হলো পার্ক। শহরের প্রায় প্রতিটি ব্লকেই বিশাল সব পার্ক রয়েছে। সবুজ ঘাস ও গাছে ছাওয়া পার্কের বেঞ্চে বসে তরুণ থেকে বয়স্ক সবাই আড্ডা দিচ্ছেন। শিশুরা ফুটবল, বাস্কেটবল খেলছে; সাইকেল, ইলেকট্রিক স্কুটার চালাচ্ছে। প্রতিটি পার্ক ও পাবলিক স্কয়ার পরিবারের সবার অংশগ্রহণে মুখর হয়ে আছে।

বিশকেকে খাওয়াদাওয়ার অভিজ্ঞতাও বেশ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, কিরগিজ ভাষার মেনু কার্ড দেখে খাবার পছন্দ করা। খাবার অর্ডার করতে প্রথম দু-তিনবার বেশ কষ্ট হয়েছে। একটি কাবাবের মতো দেখতে খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর দেখি, সেটি কাঁটাওয়ালা কোনো মাছের পদ। তবে এ কথা মানতেই হবে যে এ অঞ্চলের কাবাব আসলেই সুস্বাদু। কাবাবের মাংসে এরা লবণ আর গোলমরিচ ছাড়া আর কোনো মসলা ব্যবহার করে না। আমাদের দেশে অতিরিক্ত মসলা ব্যবহার করার কারণে মাংসের নিজস্ব স্বাদটুকু আর পাওয়া যায় না। তাই কিরগিজ কাবাব আমার খুবই ভালো লেগেছে। বিশেষ করে গরু ও ভেড়ার মাংসের শিক কাবারের স্বাদ মুখে লেগে আছে। তবে কিরগিজ বা পুরো মধ্য এশিয়ার পিলাফের (আমাদের পোলাও/বিরিয়ানির একটি রূপ) অনেক নামডাক শুনেছিলাম, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি যে পিলাফ খেয়ে আমি যারপরনাই নিরাশ হয়েছি। কাচ্চি, মোরগ পোলাওয়ের ধারেকাছেও ভিড়তে পারবে না পিলাফ।

বিশকেক শহরের প্রায় প্রতিটি ব্লকেই বড় বড় পার্ক দেখা যায়

অনুমতি মিলল

এক দিন অপেক্ষার পর ১ আগস্ট সরকারি সব অনুমতি পেয়ে গেলাম। সেই সঙ্গে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ওশের টিকিট কেটে ফেললাম। তিন হাজার বছর পুরোনো ওশ, কিরগিজস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। মুশকিল হলো, আমাদের ফ্লাইট ভোর ৬টা ৫০ মিনিটে। এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকতে হবে তিন ঘণ্টা আগে। নতুন শহরে এত রাতে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে কি না, এই দুশ্চিন্তায় রাতে আর ঘুমই এল না। রাত তিনটায় সঙ্গে থাকা গাট্টিবোচকা নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে এলাম। স্থানীয় একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে বিশকেক থেকে ওশে চলে এলাম মাত্র আধা ঘণ্টায়। এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল। ১৯৯০ সালের তৈরি মার্সিডিজ বেঞ্জের বিশাল আকারের বাসে করে চলে আসি স্থানীয় এজেন্সির অফিসে। এখানে এসে ভরপেট নাশতা করে নিলাম। আমাদের সঙ্গে তিন রুশ পর্বতারোহীও যোগ দিলেন। নাশতা শেষ করে সবাই মিলে রওনা হয়ে গেলাম আচিক-তাশ, বিখ্যাত লেনিন পিকের বেজক্যাম্পের উদ্দেশে।

ওশ শহর থেকে আচিক-তাশ পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টা লেগেছে। প্রথমদিকে রাস্তা চমৎকার থাকলেও শেষ দুই ঘণ্টা পথের পুরোটাই অফরোড ছিল। পাহাড়ের এবড়োখেবড়ো পথ দিয়ে ঝাঁকি খেতে খেতে বেলা তিনটায় এসে পৌঁছাই আচিক-তাশ ইন্টারন্যাশনাল বেজক্যাম্পে।

পিক লেনিনের বেজক্যাম্প

বিলাসীদের বেজক্যাম্প

এমন এক বেজক্যাম্প দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। এমন দুর্গম একটি জায়গায় মানুষের তৈরি এমন এলাহি কারবার নিজে চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতাই অন্য রকম। এত দিন ধরে পর্বতারোহণ করছি, হিমালয়ের দুর্গম সব জায়গায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এত দিন জেনেছি, পর্বতারোহণ হলো জীবনের সবচেয়ে মিনিমালিস্টিক অ্যাপ্রোচ, মানে পর্বতারোহণ করতে হলে আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে হয়। এই ওল্ড স্কুল মেথডের ওপর ভক্তি রেখে সেভাবেই এত দিন ধরে নিজেদের তৈরি করেছি। কিন্তু বর্তমান সময় হলো বাণিজ্যিক পর্বতারোহণের স্বর্ণযুগ। বুদ্ধিমান কিছু কোম্পানি পৃথিবীজুড়েই জনপ্রিয় পর্বতগুলোয় ইজারা নিয়ে নিয়েছে। তারা প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করে পর্বতগুলোয় অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। পর্বতারোহণের সঙ্গে আরাম-আয়েশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছে। তারা পৃথিবীর রোমাঞ্চপ্রিয় ও পর্বতারোহণে আগ্রহী মানুষদের বলছে, ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল।’

এভারেস্ট থেকে কে-টু বেজক্যাম্প—সর্বত্রই এক অবস্থা। পিক লেনিনের বেজক্যাম্পেরই বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করা যাক!

৭ হাজার ১৩৪ মিটার উচ্চতার লেনিন পিকের পাদদেশের সমতল একটি জায়গায় বেজক্যাম্প। বিশাল সবুজ মাঠ সারি সারি হলুদ রঙের তাঁবুতে ছেয়ে আছে। তাঁবুর ভেতর কাঠের পাটাতন দেওয়া আছে, যেন মাটি থেকে হিম না ওঠে। সেই পাটাতনের ওপর নরম স্লিপিং ম্যাট, ২৪ ঘণ্টা বৈদ্যুতিক বাতি ও চার্জ দেওয়ার জন্য তাঁবুর ভেতরেই রয়েছে চার্জিং পোর্ট। তাঁবু থেকে বের হলেও আছে সারি সারি টয়লেট ও গোসলের ব্যবস্থা। প্রতিটি টয়লেটে পশ্চিমা ধাঁচের কমোড, সঙ্গে কল খুললেই সব সময় গরম পানির নিশ্চয়তা। পর্বতারোহণে বরফগলা পানি হাত দিয়ে ধরতে হয়, এ কথা এখন মিথ হয়ে গেছে। সারাক্ষণ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য কোম্পানি ক্যাম্পের পাশেই মাটি খুঁড়ে হ্রদ বানিয়ে দিয়েছে। পাম্প দিয়ে একটু পরপর পানি চলে যাচ্ছে ওপরের ট্যাংকে। তাঁবুগুলোর পরই আছে বিশাল একটি দোতলা কাঠের বিল্ডিং। বেজক্যাম্পের ডাইনিং এটি। সকাল-দুপুর-রাত—তিনবেলা এখানে মিলবে বুফে খাবার। যখন-তখন পাওয়া যাবে চা, কফি, রুটি, চিনি, মধু, ফলমূল, উপমহাদেশীয় খাবার। বিশাল ডাইনিং দেখে মনে হলো, একসঙ্গে ২০০ মানুষ এঁটে যাবে। এখানে আবার হিটারের ব্যবস্থাও আছে। বাইরে যতই ঠান্ডা থাকুক, ভেতরে আরামেই থাকবেন।

পিক লেনিনের বেজক্যাম্পে লেখক

পর্বতারোহণও যে আরাম-আয়েশের সঙ্গে করা যেতে পারে, এত দিন ঝাপসা ধারণা ছিল। এই প্রথমবারের মতো আমরা এমন বিলাসবহুল পর্বতারোহণকে চাক্ষুষ করছি। যদিও এসব বিলাসী ব্যবস্থা আমাদের সামর্থ্যের বাইরে, শুধুই দূর থেকে দেখেই যেতে হবে। তা ছাড়া এটি আমাদের দর্শনের সঙ্গেও ঠিক যায় না। অবশ্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই বলেই হয়তো দর্শনের আড়ালে নিজেদের আত্মমর্যাদা ধরে রাখার চেষ্টা করছি!

সাত বছর আগে এই পর্বতারোহণ প্রকল্পের প্রথম পরিকল্পনা করেছিলাম। অবশেষে আজ আমরা পৃথিবীর ছাদ পামিরে ঘুমাব। এই আপাত অলীক পরিকল্পনা যাঁদের কারণে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাঁদের কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। অদ্রি, ক্লাইম্ব ফর আর্থ, দ্য কোয়েস্ট, ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ, এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস, মঈন ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলোকে আবারও ধন্যবাদ আমাদের এই প্রকল্পের সহযোগী হিসেবে থাকার জন্য। দ্য ডেইলি স্টার ও যমুনা টেলিভিশনকেও ধন্যবাদ প্রচারে সহযোগিতার জন্য।

আগামীকাল পামির পর্বতশ্রেণির কোনো একটি চূড়ায় আরোহণের মধ্য দিয়ে আমাদের মূল অভিযান শুরু হবে। এবার অতি উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পালা। (চলবে)

২ আগস্ট ২০২৩

আচিক-তাশ বেজক্যাম্প, কিরগিজস্থান