সমরখন্দ রেজিস্তান স্কয়ারের সামনে স্বামী মহিউদ্দিন আহমেদ ও তাজনূভা জাবীন
সমরখন্দ রেজিস্তান স্কয়ারের সামনে স্বামী  মহিউদ্দিন আহমেদ ও তাজনূভা জাবীন

বার্গারের সাইজের গরম সমুচা খেলাম

যখন লিখছি, তখন আমরা ট্রেনে। সমরখন্দ থেকে তাসখন্দ যাচ্ছি, পৌঁছে মধ্যরাতে ফ্লাইট দিল্লি পর্যন্ত, সেখান থেকে ফিরব ঢাকা। দিল্লিতে ট্রানজিট নিয়ে ঢাকা থেকে উজবেকিস্তান যাওয়া–আসার পথটাই আমাদের কাছে সহজ আর সাশ্রয় মনে হয়েছে। মধ্য এশিয়ার এই দেশভ্রমণ আমার জন্য এক বিস্ময়ের, এমন না যে খুব ইচ্ছা, আগ্রহ বা পরিকল্পনা ছিল। আমাদের কাছের দু–একজনের কাছে শুনেছি এখানে আসার গল্প, কিন্তু তখনো কল্পনা করিনি এই দেশে আসার পর আমাদের এত ভালো লাগবে। শীতে কোথায় যাওয়া যায়—এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে উজবেকিস্তানের কথা মাথায় এল। জামাই-বউ দুজন মিলে হালকা পড়াশোনা করলাম নেটে। থাকা-খাওয়া, যাওয়া–আসা নিয়ে। সবকিছু সুবিধাজনকই মনে হলো আর যেটা বেশি টানল, সেটা হলো ভিসার তেমন ঝামেলা নেই, অনেক কাগজপত্র ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে জমা দিতে হয় না। শুধু ছবি আর পাসপোর্টের কপি। নিজেরা না পারলে কোনো ট্রাভেল এজেন্সিকে বললেও তারা করে দেবে, তিন কর্মদিবসের মতো লাগে।

পথের ধারে খাবারের আয়োজন

উজবেকিস্তানের যে তিনটি শহরে (তাসখন্দ, বুখারা, সমরখন্দ) আমরা গিয়েছি, সেখানেও কোনো ঝামেলা নেই। তাসখন্দের এয়ারপোর্ট ছোট হলেও ইমিগ্রেশনে বেশি সময় লাগল না। ঝামেলা বলতে বলছিলাম শহরের মধ্যে যাতায়াতব্যবস্থা, কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া, এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়া, খাওয়াদাওয়া, রাস্তাঘাট, মেট্রো, সবকিছু আধুনিক, ডিজিটাল, পরিষ্কার, ঝকঝকে কিন্তু মারপ্যাঁচ নেই।

শাহ ই জিন্দা, রাজ পরিবার ও অভিজাত ব্যক্তিদের সমাধিস্থল

বলতে পারেন এসব তো যেকোনো উন্নত দেশেই আছে, হ্যাঁ জানি, সে জন্যই বলছিলাম শুরুতে এখানে এসে বিস্মিত হয়েছি। কারণ, আমার ধারণা ছিল না তারা এত উন্নত, আমারই অজ্ঞতা হয়তো। অনেক ইতিহাস আছে এ দেশের, অনেক ঐতিহাসিক স্থান আছে, আমির তৈমুরের সাম্রাজ্যের গল্প আছে—এসবই টুকটাক জানতাম। আর ওভাবে বাংলাদেশ থেকে সচরাচর কাউকে আসতে দেখি বা শুনি না, তাই দেশটার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও ধারণা ছিল না। বলে না, একটা দেশ কতটা উন্নত, তার যাতায়াতব্যবস্থা দেখলে অনুমান করা যায়, তাদের প্রশস্ত রাস্তা, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক, শেয়ার রাইডিংয়ের সহজপ্রাপ্যতা, চালকদের ব্যবহার, সময়ানুবর্তিতা, পেশাদারত্ব দেখে আমরা মুগ্ধ। তাদের এখানে উবারের মতো চলে Yandex go.

ইমাম কমপ্লেক্সের ভেতরে

খুব খুব সহজে এখান থেকে ওখানে চলে যাওয়া যায়, সময়ক্ষেপণ ছাড়া। উজবেকিস্তানের বিশাল বিশাল রাস্তা, জ্যামহীন এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে চলে যাওয়া আমাদের মতো ঢাকাবাসীর জন্য অনেকটা অবাক করা। তার চেয়েও অবাক করা গাড়ির ভাড়া, বেশ কম আমাদের তুলনায়। ধানমন্ডি থেকে উত্তরা সমান দূরত্বে উজবেকিস্তান মুদ্রা সোমে ২৫০০০ থেকে ২৬০০০। মানে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা পরে বাংলাদেশি মুদ্রায়। সোম থেকে টাকায় রূপান্তর করতে শেষের দুটি শূন্য বাদ দিতে হবে, এই সহজ বুদ্ধি মহি (মহিউদ্দীন আহমেদ, আমার স্বামী, আমি ছোট করে মহি ডাকি) শিখিয়েছে। যেটা বলছিলাম, ভালো রাস্তা আর গাড়ির প্রতুলতার জন্য যেকোনো জায়গায় সহজে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পেরেছি। আর আমরা যে কদিন ছিলাম, তাপমাত্রা ২-৮ ডিগ্রির মধ্যে ছিল, মধ্যে এক দিন বৃষ্টিও পেয়েছি। কিন্তু যেটা মারাত্মক ছিল, সেটা হলো বাতাস। ঠান্ডার থেকেও ঠান্ডা বাতাসের বেগ ছিল বেশি, কিন্তু এরপরও গাড়ি পেতে একদম ঝামেলা হতো না।

ট্রেনে ওঠার আগে

তাসখন্দে মেট্রোরেলে চড়ে চোরসুবাজার গিয়েছিলাম, হাঁটতে হয়। তবে বেড়াতে গেলে ভালোই লাগে পাতাল ট্রেনে চড়তে। আশপাশের কত রকম মানুষ, তাদের পোশাক, চলাফেরা—সব দেখার মতো, আমার কাছে অবশ্য শেখার মতোও। এখানকার মানুষ সহজসরল, আন্তরিক। আমাদের দেখে তাদের শারীরিক ভাষা, মায়া আর আন্তরিকতায় ভরা, যেসব জায়গায় আমাদের সঙ্গে স্থানীয় গাইড ছিল, সেখানেই আশপাশের মানুষ গাইডকে জিজ্ঞাসা করেছে, আমরা কোত্থেকে এসেছি, বাংলাদেশ শুনে চোখেমুখে কেমন জানি তৃপ্তিভরা হাসি।

ছোট থেকে বড়—স্থানীয়রা খুবই আন্তরিক

সবাই বাংলাদেশ চেনে না হয়তো, কিন্তু তাদের খুশি দেখে বোঝা যায়। পর্যটকদের সম্মান করা, এতটা আন্তরিকতা আমি অন্য কোথাও কম দেখেছি। আসসালামু আলাইকুম বলে যেভাবে অভ্যর্থনা জানায়, তাতেই মন ভরে যায়।

আমাদের যাত্রাটা শুরু করেছিলাম তাসখন্দ শহর দিয়ে, যেখানের চোরসুবাজারের কথা না বললেই নয়। পাইকারি বাজারের মতো, নতুন দেশের এ ধরনের বাজার আমাকে খুব টানে, কেনাকাটার জন্য নয়, দেখার জন্য। তারা কী কী পসরা সাজায়, সেটা দেখলে কিন্তু তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

বাজারের একটি দোকানে এভাবে সাজানো আছে সাবান

আর মানুষ তো আছেই, কতটা ভিন্ন, কতটা অভিন্ন দেখতে, বুঝতে ভালো লাগে। উজবেকিস্তানের ইক্কাত বুননের শীতকালীন পোশাকে বাজার ভর্তি, এরপর বিভিন্ন নকশার সিরামিকের সামগ্রী, স্থানীয় খাবারের পসরা, কাবাব—এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হচ্ছিল, কোন সিনেমার দৃশ্যে আমরা, প্রত্যেকে একেকজন চরিত্র।

এখানকার সিরামিকের খ্যাতি আছে বিভিন্ন দেশে

মন ভরে নতুন দেশে মানুষ দেখি আমি। সেদিন দুপুরে গরুর মাংসের সমুচা খেয়েছিলাম, খুব প্রচলিত একটা খাওয়া তাদের। বার্গারের সাইজের একেকটা সমুচা, গরম গরম ভীষণ স্বাদ।

তৈরি হচ্ছে কাবাব

তাসখন্দে বিভিন্ন দর্শনীয় মাদ্রাসা, মিউজিয়ামের মধ্যে যে স্থানটা মনে দাগ কেটে আছে, সেটা হলো হজরত ইমাম কমপ্লেক্স। এখানের বড় বড় মসজিদ, মাদ্রাসার নির্মাণশৈলী, ইতিহাস আরও জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিচ্ছিল আমাদের।

ইমাম কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি পোশাকের দোকান

বিশেষ করে দেখলাম, গ্রন্থাগারে রক্ষিত কোরআনের পাণ্ডুলিপি। শত শত বছরের পুরোনো এ কোরআন দেখার মতো, একেক পৃষ্ঠায় এক থেকে দুই আয়াত করে লেখা। এই কমপ্লেক্সের বিশাল মসজিদে মহিলাদের নামাজ পড়ার স্থানে অনেকক্ষণ একা একা নীরবে বসে থাকার অনুভূতিও আমার সব সময় মনে থাকবে। কারণ, কোন বিশাল মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করার ভাগ্য আমার এর আগে হয়নি।

বিফ সমুচার আকার বার্গারের সমান

উজবেকিস্তানের শহরগুলোয় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার পথটুকুও আমার খুব ভালো লাগত। গাড়িতে সাধারণত মুঠোফোনে চোখ থাকে, কিন্তু এবার যেন মুঠোফোনও পাত্তা পাচ্ছিল না আমার কাছে। সাজানো–গোছানো ছবির মতো শহর, পাতাবিহীন রুক্ষ সারি সারি গাছ দেখে মনে হচ্ছিল প্রাণহীন শীতে যদি আমার এত ভালো লাগে, তাহলে বর্ণিল শরত, বসন্তে কত না সুন্দর দেখাবে এই শহর।

লেখক: চিকিৎসক ও মডেল