পৃথিবীর রাজধানীতে অপূর্ব দুই মসজিদ

ইজিপশিয়ান বাজার–সংলগ্ন নতুন মসজিদ
ছবি: লেখক

ইস্তাম্বুলে যখন বিমান নামল, তখন বেশ রাত। শহরের সবচেয়ে পুরোনো এলাকা সুলতানামেতে আমাদের হোটেল। এখানে ইস্তাম্বুলের ব্যাপারে কিছু তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। ইস্তাম্বুল পৃথিবীর একমাত্র শহর, যার এক ভাগ এশিয়া, আরেক ভাগ ইউরোপে পড়েছে। ইস্তাম্বুলের আদি নাম কনস্ট্যান্টিনোপল। বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্ট্যান্টিনোপল এই শহরের গোড়া পত্তন করেন। চৌদ্দ শ শতকে অনেক চেষ্টার পর এই শহরের দখল নেয় উসমানীয় (অটোমান) তুর্কিরা। উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষে নাম বদলে রাখা হয় ইস্তাম্বুল। নেপোলিয়ন একবার বলেছিলেন, বিশ্ব যদি একটি দেশ হতো, ইস্তাম্বুল হতো তার রাজধানী।

সকালে তড়িঘড়ি উঠে তুর্কি নাশতা খেতে বেরিয়ে পড়া গেল। পেট ঠান্ডা করে শহর দেখা শুরু করব। নাশতার আয়োজন মোটামুটি এলাহি। ১৫ থেকে ১৬ রকম আইটেম, এক থেকে দুইটা প্রধান আইটেমের সঙ্গে অনেক ফল, জেলি, সালাদ, মধু, দই, তুর্কি রুটি। তুর্কি কফি দিয়ে নাশতা শেষ করলাম।

নয়নাভিরাম আয়া সোফিয়া

একটু হাঁটতেই সামনে পড়ল বিশাল আয়া সোফিয়া। অসম্ভব সুন্দর স্থাপনাটি অনেকবার ক্যালেন্ডারে, ভিউকার্ডে দেখেছি। সামনাসামনি দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। এক হাজার বছর ধরে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপনা ছিল। বর্তমান কাঠামোটি বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান ৫৩২ থেকে ৫৩৭ সালের মধ্যে তৈরি করেন। এটি খ্রিষ্টান ক্যাথেড্রাল হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। ভেতরে পা রাখতেই এক গভীর বিস্ময় অনুভূত হলো। মাথার ওপর বিশাল গম্বুজের সঙ্গে ঝুলে থাকা ঝাড়বাতিগুলোকে মনে হচ্ছিল শূন্যে ভাসছে। চারপাশের ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি ও খ্রিষ্টান মোজাইকগুলো যেন নিজেদের মধ্যে শৈল্পিক এবং আধ্যাত্মিক একটি সহাবস্থান তৈরি করে রেখেছে।

ওপরের জানালাগুলো থেকে সূর্যের নরম আলো ভেতরে বেশ স্নিগ্ধ আভা তৈরি করে। এ আলো বাইজেন্টাইন স্বর্ণালি মোজাইকগুলোর ওপর পড়ে সোনালি আলোর প্রতিফলন করে, যা লিখে বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। এর প্রতিটি দেয়াল বাইজেন্টাইন আর উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস বহন করে চলেছে। আমি অতীতের সঙ্গে গভীর এক যোগাযোগ অনুভব করি। বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের নীরব সাক্ষী আয়া সোফিয়া আমার মধ্যে এক গভীর শ্রদ্ধার অনুভূতি জাগায়।

ট্রাম থেকেই চোখে পড়ল বসফরাস প্রণালি

আয়া সোফিয়া দেখে শেষ করতে প্রায় দুপুরে হয়ে এল। পুরোনো শহরে কিছু দূর হেঁটে ট্রামে চড়ে বসলাম। গুগল ম্যাপে বেশ ভালো রেটিংয়ের একটি রেস্তোরাঁতে দুপুরের খাবার খাব। ট্রাম থেকেই চোখে পড়ল বসফরাস প্রণালি। বেশ ব্যস্ত প্রণালি। অনেক ছোট-বড় নৌকা ও জাহাজ দেখা গেল। এ প্রণালিই ইস্তাম্বুলকে দুই ভাগ করেছে। ট্রাম থেকে নেমে একটু হাঁটার পরে রেস্তোরাঁ পাওয়া গেল। দুপুরের ভিড় এখনো তেমন জমে ওঠেনি। আমরা রেস্তোরাঁর বারান্দার একটা টেবিলে বসলাম, যেখান থেকে বসফরাস দেখা যায়। তুর্কি কাবাব পৃথিবী বিখ্যাত। আমরা তুর্কি জাইরো প্লাটার আর চিকেন কাবাব অর্ডার করলাম, সঙ্গে পানিও হিসেবে আইরান। আইরান আমাদের বোরহানির মতো, দইয়ের সঙ্গে পুদিনা আর লবণ দিয়ে তৈরি করা হয়। কাবাবের সঙ্গে খেতে বেশ ভালো লাগে। বেশ তৃপ্তি করেই দুপুরের খাবার শেষ করলাম। রেস্তোরাঁর ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলাম, আশপাশে দেখার মতো কী আছে? সে জানাল, কাছেই ইজিপশিয়ান বাজার, এখন থেকে হেঁটেই যেতে পারব।

অটোমান সাম্রাজ্যের সময় মিসর থেকে আসা করের টাকায় তৈরি হয়েছিল বলে এই বাজারের নাম ইজিপশিয়ান বাজার

আসলেই বাজারটি কাছে, একটু হাঁটার পরই পাওয়া গেল। অটোমান সাম্রাজ্যের সময় মিসর থেকে আসা করের টাকায় তৈরি হয়েছিল এই বাজার, তাই নাম ইজিপশিয়ান বাজার। ভেতরে ঢুকতেই অনেক রকম মসলার গন্ধ নাকে এসে লাগল। সারি সারি দোকান। প্রায় সব দোকানেই বিভিন্ন রকম মসলা বিক্রি হচ্ছে।

ইজিপশিয়ান বাজারে মসলার পসরা

ছোট ছোট দোকানে বাহারি রংবেরঙের মসলা সাজিয়ে রাখা। অনেকটা আমাদের ঢাকা শহরের মসলার দোকানগুলোর মতোই, কিন্তু আরও গোছানো। বিভিন্ন শুকনা ফুল, ফল থেকে শুরু করে নানা জাতের মসলা। শুধু শুকনা মরিচই দেখলাম ১৫ থেকে ১৬ রকম। আমাদের প্ল্যান ছিল এখন থেকে কিছু জাফরান কিনব। দু-একটা দোকান ঘুরে কিছু জাফরান, আলোপ্পো মরিচ আর তুর্কি চা কিনলাম।

নতুন মসজিদ

এই বাজারের সঙ্গেই একটি মসজিদ। নাম নতুন মসজিদ। মসজিদটি বাইরে থেকে দেখতে যেমন সুন্দর, ভেতরটাও তেমন। মসজিদের বাইরের অংশে পিরামিডের মতো সাজানো ৬৬টি গম্বুজ আর আধা গম্বুজ রয়েছে, আর পাশাপাশি রয়েছে দুটি মিনার। ৩৬ মিটার উঁচু মূল গম্বুজটি চারটি অর্ধগম্বুজ দ্বারা পরিবেষ্টিত। মসজিদটি তৈরির আদেশ দেন সুলতান চতুর্থ মাহমুদের মা। মসজিদটি তৈরির কাজ শেষ হয় ১৬৬৫ সালে। নতুন মসজিদের নকশা তৈরি করা হয়েছিল সুলতান আহমেদ মসজিদ বা নীল মসজিদের (ব্লু মস্ক) নকশার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।

মসজিদ থেকে মুগ্ধ হয়ে বের হলাম মূল রাস্তায়। ছোট একটি কার্টে সিমিট রুটি বিক্রি হচ্ছে। সিমিট দেখতে কিছুটা বনরুটির মতো। তবে এতে তিলের প্রলেপ দেওয়া থাকে। কয়লার চুলায় গরম করে নসিলা লাগিয়ে বিক্রি করে। সিমিট খেতে খেতে হাঁটা শুরু করলাম। এবারের গন্তব্য মহা নীল মসজিদ বা গ্র্যান্ড ব্লু মস্ক। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, পুরান শহরের মধ্যে হেঁটে হেঁটেই সেখানে যাব। হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলাম, দুই পাশে পুরোনো আর নতুন স্থাপনার সংমিশ্রণ। উসমানীয় সময়ের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে আছে অনেক পুরোনো বাড়ি, এগুলোর পাশে নতুন বাড়িগুলোকে মনে হয় খাপছাড়া।

সন্ধ্যার আলোয় অদ্ভুত সুন্দর নীল মসজিদ

নীল মসজিদের পাঁচটি প্রধান গম্বুজ, ছয়টি মিনার আর আটটি গম্বুজ। নকশাটি উসমানীয় মসজিদের দুই শতাব্দীর উন্নয়নের চূড়ান্ত পরিণতি। মসজিদটিতে ইসলামি স্থাপত্যের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আয়া সোফিয়াসহ অনেক বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের অনুপ্রেরণা ব্যবহার করা হয়েছে। এটিকে বলা হয় ধ্রুপদি যুগের শেষ মহান মসজিদ। ওপরের অংশটি ৬০টি ভিন্ন টিউলিপ প্যাটার্নে প্রায় ২০ হাজার হাতে আঁকা সিরামিকে সাজানো। সূর্যের আলো আসার জন্য নিচের তালাগুলোতে ২০০ কাচের জানালা রয়েছে। মসজিদটির সামনে একটি বড় ফোয়ারা এবং অজুর জন্য বিশেষ জায়গা রয়েছে। পশ্চিম দিকের প্রবেশপথে একটি লোহার শিকল ঝুলতে দেখা যায়।

নীল মসজিদ থেকে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা। সারা দিন ঘুরে বেশ ক্লান্ত। সামনেই সুলতানামেত চত্বর। চত্বরের বাগানে বসে নীল মসজিদকে সন্ধ্যার আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। কাছেই তুর্কি একটি রেস্তোরাঁ থেকে রাতের খাবার শেষ করে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। আজকের মতো ঘোরাঘুরি শেষ।