দুর্গম সব গন্তব্যে ট্যুর পরিচালনা করতেন মোহাম্মদ রাফি ও বর্ষা ইসলাম দম্পতি। গত আগস্টে গহিন পাহাড়ে এমনই এক ভ্রমণ-অভিযানে গিয়ে মারা যান রাফি। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে অকূলপাথারে পড়েন বর্ষা। রাফির দেখানো পথ ধরে এক বছরের মাথাতেই কীভাবে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন, সজীব মিয়াকে সেই গল্পই শোনালেন বর্ষা ইসলাম
অ্যাডভেঞ্চারের শখ থেকে ঘোরাঘুরির বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত ছিলাম। এমনই একটি গ্রুপে রাফির ঘোরাঘুরির ছবি দেখি। ছেলেটা দলেবলে দুর্গম পাহাড়ি জলপ্রপাতে ঘুরতে যায়। অপ্রচলিত বিভিন্ন জায়গার সন্ধান দেয়। বিষয়টা আমার ভালো লাগে। রাফির সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধু হই। তারপর টুকটাক কথা। আমি তখন ইউল্যাবে অনার্স পড়ি। একদিন কথায় কথায় রাফি বলল, তাঁদের সঙ্গে পাহাড়ে যাব কি না। তার কথায় পুরো ভরসা পাই না, আমার এক বান্ধবীকে রাফি সম্পর্কে খোঁজখবর করতে বলি। সে সবুজ সংকেত দেওয়ার পর রাফির সঙ্গে যোগাযোগ বেড়ে যায়। একসময় সেই যোগাযোগ সম্পর্কে গড়াল।
২০২০ সালে রাফির দলের সঙ্গে প্রথম ঘুরতে যাই। সেটা ছিল ক্রিসতং-রুংরাং ট্রিপ। সাইংপ্রা জলপ্রপাতেও গিয়েছিলাম। তারপর থেকে অনেক ট্যুরে তার কো–হোস্ট হিসেবে দলে ভিড়েছি। মানে যারা যেতেন, তাঁদের দেখভাল করা ও পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজগুলো করতাম।
২০২২ সালে পারিবারিকভাবেই আমাদের বিয়ে হয়। রাফিদের বাড়ি চট্টগ্রামে। আমার যশোরে। রাফির স্নাতকোত্তর আগেই শেষ হয়েছিল। চাকরির জন্য বাসা থেকে তাকে তাগাদা দিচ্ছিল; কিন্তু ছেলেটার ধ্যানজ্ঞান ছিল পাহাড় আর ঝরনা। পর্যটন খাতেই সে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখত। সেভাবেই কাজ শুরু করল; কিন্তু বিয়ের পর বিপত্তি বাধল। আমাকে নিয়ে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়াটা তার পরিবার ভালোভাবে নিত না। খুব ছোটবেলায় আমার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়েছিল। তারপর চাচা-মামাদের কাছে মানুষ। এই ব্যাপারটা নিয়েও শ্বশুরবাড়িতে কথা শুনতে হতো। একসময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল—আমি আর রাফি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলাম। ঢাকায় দুজনে ছোট একটা বাসা নিলাম। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন জায়গায় ট্যুর নিয়ে যেতে থাকলাম। ভালোই চলছিল সব।
এর মধ্যে কুকি-চিনের বিরুদ্ধে পাহাড়ে অভিযান শুরু হলে বান্দরবান ও রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায় ভ্রমণ বন্ধ হলো। আয়ের বিকল্প কোনো উৎস আমাদের নেই। ঢাকায় না খেয়ে থাকলেও মাসে মাসে বাসা ভাড়াটা তো দিতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে ধারদেনা করে চলতে হলো মাসের পর মাস।
রাফির সঙ্গে শেষ ছবি
আমাদের সম্পর্কের তিন বছর পূর্ণ হয় গত আগস্টে। রাফি পরিকল্পনা করে ক্রিসতং-রুংরাং ট্রিপেই আবার যাবে, সঙ্গে আমিও যাব। এই পথে রাত কাটাতে হয় খেমচংপাড়া নামে এক বমপাড়ায়। তিন বছর আগে প্রথম ভ্রমণে খেমচংপাড়ায় আমাদের দুজনের ছবি আছে। রাফি বলল, আগস্টে আমরা ঠিক ও রকমভাবেই ছবি তুলব।
তত দিনে পাহাড়ে ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে তখন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় ট্যুর বাতিল করতে বললাম; কিন্তু রাফি নাছোড়। প্রায় ১৯ জনের মতো মানুষ যাবেন। তাঁদের জন্য বাস, গাইড, স্থানীয়ভাবে খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে, হঠাৎ সব বাতিল করা ঝক্কির।
নির্ধারিত দিনেই সেই ট্যুরে আমরা যাই। আলীকদম থেকে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে প্রথম দিন গেলাম খেমচং পাড়ায়। এই পাড়ায় তিন বছর আগের মতো ‘ফলো মি’ ছবি তুললাম। হাতে মেহেদি দিলাম। দীর্ঘ পাহাড়ি পথে হাঁটার ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল।
পরদিন ভোরে সাইংপ্রা জলপ্রপাতে যাওয়ার কথা। আমার মধ্যে ভীষণ আলস্য ভর করল। আমি যাব না জানিয়ে দিলাম; কিন্তু রাফি জোরাজুরি করলে হাঁটা শুরু করলাম। সবাই একসময় সাইংপ্রা জলপ্রপাতের সামনে হাজির হলাম। দলেবলে ছবি তুললাম। রাফির সঙ্গেও—পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছি দুজন। রাফির কাঁধে আমার হাত। সামনে অবিরল জল ঝরিয়ে চলেছে সাইংপ্রা।
দূর থেকে তোলা এই ছবিটাই যে দুজনের একসঙ্গে শেষ ছবি হবে কে জানত। ছবিটি তোলার মিনিট কয়েক পরই পাথরে পা পিছলে পড়ে যায় রাফি। পরের স্মৃতিটা আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। গত বছরের ১২ আগস্টের কথা ভাবতে গেলেই এখনো হিম হয়ে আসে গা।
ট্রেক উইথ রাফি
রাফির মৃত্যুর পর অথই জলে পড়লাম। রাফিদের বাড়িতে আমার জায়গা হলো না। যশোরেও আমার যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আবার ঢাকায় এসে থাকার মতো অবস্থাও নেই। বাধ্য হয়ে চট্টগ্রামে এক আপুর বাসায় উঠলাম। নিজের কাছে অর্থকড়ি নেই। যাঁরা এত দিন আমাদের সঙ্গে ঘুরতে গেছেন, তাঁরাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রতি মাসে তাঁরা সহযোগিতা করতেন। চট্টগ্রামে মাস দুয়েক থেকে ঢাকায় এলাম। মনে হতে থাকল—এভাবে অন্যের সহযোগিতায় আর কত। নিজের কিছু করার দরকার; কিন্তু রাফির দেখানো পথ ছাড়া আমি তো কিছু চিনি না। ফেসবুকে ওর সঙ্গে যাঁরা ঘুরতে যেতেন, তাঁরাও পরামর্শ দিলেন, আমি যেন ট্যুর অপারেট করা শুরু করি। রাফির নামে ফেসবুকে গ্রুপ খুললাম—‘ট্রেক উইথ রাফি’। না থেকেও আমার সঙ্গেই থাকল রাফি।
যেসব জায়গায় রাফির সঙ্গে ঘুরতে গেছি, যাঁদের সঙ্গে রাফির মাধ্যমে যোগাযোগ, সেই পথে, সেসব মানুষের সহযোগিতায় ভ্রমণপিপাসুদের নিয়ে যাওয়া শুরু করলাম। প্রথমে গেলাম সোনাদিয়ায়। ক্যাম্পিং ট্যুর। ট্যুর অপারেটর হিসেবে আরও কয়েকজন যুক্ত হলো। ট্রেক উইথ রাফির দল বড় হলো। সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনই এখন ট্যুর থাকে। আমাদের আয়ের ৫ থেকে ১০ শতাংশ রাফির নামে মানুষকে সহযোগিতার জন্য বরাদ্দ রাখলাম। এ উদ্যোগেও একসময় বাধা এল, কটু কথা শুনতে হলো। অনেকে বলতে থাকল, রাফির নাম ব্যবহার করে, তার মৃত্যুকে পুঁজি করে আমি ব্যবসা করছি। শুনে খুব আহত হলাম। ট্রেক উইথ রাফি নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য হলাম। গ্রুপটার নাম এখন ‘ট্যুর এক্সপার্ট’।
আমরা সাতজন এখন এই গ্রুপ পরিচালনা করছি। পেশা হিসেবে পর্যটন খুবই অনিশ্চিত একটি খাত। বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মহামারিসহ নানা সমস্যায় প্রথমে ভোগে এই খাত। তবু এই পেশাতেই নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করছি। হাওরে আমি একটি হাউসবোটের অংশী হয়েছি। অনেক মানুষ আমার সঙ্গে নতুন নতুন গন্তব্য দেখছেন। সবার অনুপ্রেরণা সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই।