১৯১ দেশ ভ্রমণ করে স্বদেশে ফেরার পথে এই পর্যটক বললেন, 'বাংলাদেশ আমার প্রথম বিদেশ'

এইচআইভি এইডস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ২০০৪ সালে বিশ্বভ্রমণে পথে নামেন ভারতের সোমেন দেবনাথ। দুই চাকায় ১৯১ দেশ ভ্রমণের শুরুটা বাংলাদেশ দিয়ে করেছিলেন, ১৯ বছর পর সেই লক্ষ্য পূরণ করলেন আরেক প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে পা রেখে। অভিযানের ইতি টেনে এবার স্বদেশে ফিরছেন তিনি। ফেরার পথে বাংলাদেশের হাওয়া গায়ে মেখে নিতে এলেন ঢাকায়। ৬ ডিসেম্বর প্রথম আলো কার্যালয়ে এই ভূপর্যটকের সাক্ষাৎকার নেন সজীব মিয়া

প্রশ্ন

ঢাকায় কবে এলেন?

সোমেন দেবনাথ: ২ ডিসেম্বর। গত মাসে মিয়ানমার ভ্রমণ করে থাইল্যান্ডে গেলাম। সেখান থেকে বাংলাদেশের ভিসা করে চলে এলাম।

প্রশ্ন

সাইকেল ছেড়ে উড়োজাহাজে উঠতে হলো…

সোমেন: আমার পুরো সফরে ২৮ বার জাহাজ আর ৩২ বার বিমানে উঠতে হয়েছে। এমন কিছু দেশ আছে যেখান থেকে গন্তব্যে যেতে এ ছাড়া আর উপায়ও ছিল না।

প্রশ্ন

ঢাকায় কীভাবে সময় কাটছে?

সোমেন: এই যে একটু আগে চন্দ্রিমা উদ্যান ফিটনেস ক্লাবের একটি অনুষ্ঠান শেষ করে এলাম। সকাল সকাল সেখানে সবার সঙ্গে পরিচয় হলো, ঘণ্টা দুয়েক কথাবার্তা হলো। আগেরবার এসেও সেখানে গিয়েছি। তখন দেখেছি দু-তিনজন হাঁটাহাঁটি করছেন, এখন অবশ্য দেখলাম, অনেক মানুষ হাঁটেন।

ঢাকায় কমলাপুরের একটি হোটেলে উঠেছি। ঢাকায় অনেক পরিচিত মানুষ। নেমন্তন্ন, অনুষ্ঠান-আয়োজনে সময় কাটছে। ১০ ডিসেম্বর দেশে ফেরার আগে ‍কয়েকটা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসব, কথা বলব।

ঢাকায় সোমেন দেবনাথ
প্রশ্ন

মিয়ানমারের আগে কোন দেশে ছিলেন?

সোমেন: মিয়ানমার আমার বিশ্বভ্রমণের ১৯১তম ও সর্বশেষ দেশ। এর আগে পূর্ব তিমুর ও লাওস ভ্রমণ করেছি। আমি যখন ভ্রমণ শুরু করি, তখন জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৯১টি ছিল, পরে দুটি দেশ যোগ হয়েছে। তবে শুরুর সেই সংখ্যাটা ধরেই আমি এগিয়ে গেছি।

মিয়ানমার সফরে সোমেন
প্রশ্ন

শুরুটা কীভাবে করলেন?

সোমেন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সুন্দরবন কলেজে আমি প্রাণিবিদ্যায় পড়েছি। আমার স্নাতকের শেষ পরীক্ষা ছিল ২০০৪ সালের ২৫ মে। ভাবলাম, এই তো সময়। দুদিন পরেই ভারতের রাজ্যগুলো ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তবে এই বেরিয়ে পড়ার চিন্তাভাবনা আরও আগের। যার সঙ্গে আমার ১৪ বছর বয়সের একটি ঘটনা জড়িয়ে আছে।

প্রশ্ন

কেমন সেটি?

সোমেন: দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবনের বাসন্তী আমার গ্রাম। সেখানে স্কুলে পড়ার সময় পত্রিকায় দেখেছিলাম, এইডসে আক্রান্ত একজন মৃত মানুষকে কেউ স্পর্শ করছে না, তাঁর শেষকৃত্যও হচ্ছে না। ব্যাপারটি আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়। এইডস সম্পর্কে জানতে কৌতূহলী করে তোলে। কিন্তু শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইলে তাঁরা আমাকে কিছুই বলেন না। তখন মনে হলো, এইডস কি তবে ক্যানসারের চেয়ে ভয়াবহ রোগ। এই রোগের বিষয়ে তো জানতে হয়।

জানতে আমার দুই বছর লাগল। তারপর গ্রামে গ্রামে সাইকেলে ঘুরে এইডস সম্পর্কে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে শুরু করলাম। ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এভাবেই আমার কার্যক্রম চলেছে। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বভ্রমণে নামা।

২০০৪ সালে বাংলাদেশ ভ্রমণে সোমেন দেবনাথ
প্রশ্ন

তারপর বেরিয়ে পড়লেন...

সোমেন: জি, বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ভ্রমণ করে আবার ভারতে ঢুকি। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ভারতসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে যাই। এর পরই শুরু হয় আমার রুট প্ল্যান অনুযায়ী মূল যাত্রা—পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান হয়ে চলতে থাকল আমার সফর। ২০০৯ সাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২৩টি দেশে গেলাম। এরপর ২০১২ সাল পর্যন্ত আমি ইউরোপের ৫০টি দেশ সফর করলাম। তারপর গেলাম আফ্রিকায়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত কেটে গেল সেখানে। এ সময়ে আফ্রিকার ৫২টি দেশ ভ্রমণ করলাম। শততম দেশ ছিল নামিবিয়া। এভাবেই সব কটি মহাদেশে পা পড়ল।

অ্যান্টার্কটিকা সফরেও সঙ্গে নিয়েছিলেন বাইসাইকেল
প্রশ্ন

অ্যান্টার্কটিকায়ও তো গেছেন?

সোমেন: গেছি। দক্ষিণ আমেরিকা সফরে আর্জেন্টিনার উসুয়াইয়া শহরে ছিলাম। সেখান থেকে গেলাম অ্যান্টার্কটিকায়। সঙ্গে নিয়েছিলাম বাইসাইকেল।

প্রশ্ন

একে একে এতগুলো দেশ ঘুরলেন, খরচ কীভাবে জোগাড় হলো?

সোমেন: আমার একটা সহজ কনসেপ্ট আছে। সফরের প্রতি কিলোমিটার এক ডলারে বিক্রি করি। প্রবাসী ভারতীয়, ভারতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে গেছে। আরও কতজন কতভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে। অর্থের জন্য অবশ্য কোনো দিন কাউকে চাপ দিইনি। মানুষ ভালোবেসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।

প্রশ্ন

এই পুরো সফরে দেশে গেছেন কতবার?

সোমেন: একবার। ২০১৭ সালে আমার বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে এল সালভাদর থেকে বিমানে তিন দিনের জন্য গিয়েছিলাম।

রাশিয়ায় সোমেন
প্রশ্ন

বাড়িতে আর কেউ নেই?

সোমেন: সবাই আছেন। মা আছেন, দুটি ভাই আছে। ওরা কলকাতায় থাকে। গ্রামেও যায়। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগযোগ হয়। ১০ ডিসেম্বর কলকাতা বিমানবন্দরে অনেকের সঙ্গে মা আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।

প্রশ্ন

করোনায় সময় কোথায় ছিলেন?

সোমেন: চীনে। কোভিড পজিটিভ হয়েছিল আমার। তারপর সুস্থ হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যাই। সেখান থেকে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে আটকা পড়ি। ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। অবশ্য করোনার কারণে ভিসার মেয়াদ নিউজিল্যান্ড সরকার অটো এক্সটেন্ড করে ছয় মাস।

২০২০ সালে সফর শেষ করার পরিকল্পনা করে পথে নেমেছিলাম। করোনার কারণে তিন বছর বেশি লাগল।

বিশ্বভ্রমণে সবচেয়ে বেশি দিন কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে
প্রশ্ন

পথে পথে নানা অভিজ্ঞতাও তো হলো…

সোমেন: ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছিল। তালেবান যোদ্ধাদের খপ্পরে পড়লাম। তাঁরা আমাকে বন্দী করে রাখল সাড়ে তিন সপ্তাহ। সেই ভয়ংকর বন্দিদশার কথা হয়তো কোনো দিন ভুলব না। আবার আলজেরিয়া থেকে তিউনিসিয়া যাওয়ার সময় সাহারা মরুভূমির অভিজ্ঞতাও মনে থাকবে। এমন অনেক অভিজ্ঞতার কথাই বলতে পারি।

২০১০ সালে যুক্তরাজ্য সফরে সোমেন
প্রশ্ন

এত দেশ ঘুরলেন, আপনার প্রিয় কোনটি

সোমেন: আমার কাছে অপ্রিয় দেশ বলে কিছু নেই। প্রতিটি দেশই আমার প্রিয়। আপনি যদি বলেন, কোন দেশে কী ভালো লেগেছে, সেটি বলতে পারি। তবে কিছু দেশ আছে, যেখানে আমি হয়তো দ্বিতীয়বার যাব না। এর মানে এই নয় যে সেই দেশগুলো আমি ভালোবাসি না।

প্রশ্ন

মিয়ানমার থেকে তো সরাসরি ভারতে যেতে পারতেন…

সোমেন: বাংলাদেশকে আমি প্রণাম জানাতে এসেছি। এই দেশ আমার যাত্রার প্রথম সঙ্গী, আমার প্রথম বিদেশ। তাই শুরুর মতো শেষটাও এই দেশ দিয়েই করার ইচ্ছা ছিল।

সোমেনের কাছে অপ্রিয় দেশ বলে কিছু নেই
প্রশ্ন

এত দিন বাইরে বাইরে ঘুরলেন, বাড়ি ফিরে থাকতে পারবেন?

সোমেন: থাকতে পারাটা পুরোপুরি নিজের ব্যাপার। আমার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। আমি বাড়িতে যাব, বই লিখব। নোট নেওয়া আছে, এসব গোছাতে হবে। আমি একজন পেইন্টার। প্রত্যেকটি দেশ নিয়েই ছবি আঁকি। এসব ছাড়াও গ্রাম নিয়ে কিছু ভাবনা আছে। কত কাজ...