শ্রীলঙ্কার প্রাচীন এই হাসপাতালে বিয়ের ছবি তোলা নিষেধ

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মধ্যখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন ৬ষ্ঠ পর্ব।  

দিল রু ভিলেজ ইন
ছবি: লেখক

ষষ্ঠ দিন: রামবেওয়া থেকে মিহিনতালে হয়ে অনুরাধাপুরা (২৬.৩২ কিলোমিটার)

কাল রাতে দিল-রু ভিলেজ ইনের যে রাস্তাকে ঘনায়মান অন্ধকার আর বৃষ্টিতে রহস্যময় মনে হচ্ছিল, সকালবেলা সেটাই বড় স্নিগ্ধ। মুথা ঘাস আর ইপিল ইপিলগাছ রাতের বৃষ্টিতে সেজেছে নতুন করে। এ একদম কাঁচা সবুজ, যেন ছুঁলেই সবুজ রং হাতে উঠে আসবে। আমাদের আজকের গন্তব্য অনুরাধাপুরা। রামবেওয়া থেকে দূরত্ব মাত্র ১৫ কিমি। কিন্তু আমরা সিধা পথে অনুরাধাপুরা যাব না। মিহিনতালে হয়ে তবেই অনুরাধাপুরার পথ ধরব। এতে ১১-১২ কিলোমিটার রাস্তা বাড়লেও মিহিনতালের মতো ঐতিহাসিক জায়গায় প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া হবে।

মিহিনতালেই সম্রাট অশোকপুত্র মাহিন্দা তৎকালীন লঙ্কান রাজা দেভানামপিয়াথিসসার কাছে বৌদ্ধধর্মের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন। এরপরেই শ্রীলঙ্কাজুড়ে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। মাহিন্দা ছিলেন মৌর্য বংশের রাজপুত্র। তাঁর নামেই নাম শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে শ্রীলঙ্কান তরুণ-তরুণীদের একটা অংশ চেনেন মৌর্য বংশের মশালবাহক হিসেবে!

বটবৃক্ষ

রাস্তায় প্রচুর গাড়িচাপা পড়া ব্যাঙের দেহাবশেষ। বাচ্চাসমেত মুখপোড়া হনুমান দেখলাম একটা মজা খালের ওপরে। নিজেদের চেহারাও যে রোদে ঝলসে গিয়ে এই বানরদের মতো হয়ে যাচ্ছে, সে কথা বলাই বাহুল্য! কিছুটা এগিয়ে রাস্তার ধারেই একসঙ্গে অনেক ময়ূর। কাউকে পেখম তুলতে অবশ্য দেখা গেল না। এরা এক বাড়ির উঠোনের পাশেই চরে বেড়াচ্ছে। মানব-সাহচর্যে সম্ভবত এরা বেশ অভ্যস্ত। কার্তিকের বাহন ময়ূর দেখার পরে এবারের হাঁটায় প্রথমবারের মতো কাক দেখলাম। বৌদ্ধ–অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করলেও পথের পাশে বটের তলে এখনো কার্তিকের সহোদর গণেশের ছোটো ছোটো মূর্তির দেখা মিলছে।

এই ছিল দুপুরের খাবার

উক্কুলানকুলামার কাছে অনেকগুলো ইংরেজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। ছোট্ট এক দোকানে থেমে চা আর ক্রাকার্স খাওয়া হলো। এরপর সোজা হেঁটে মিহিনতালে জংশন। প্রথমেই গেলাম প্রাচীন হাসপাতালে। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে চারপাশে অনেকগুলো কক্ষ। আর মাঝের বেদির মতো জায়গায় থাকত বুদ্ধমূর্তি, যদিও এখন পোড়ামাটির ধ্বংসাবশেষই আছে খালি। আর একপাশের একটা বড় কক্ষে হামানদিস্তায় পিষে বানানো হতো নানা ওষুধ। এক কোণায় মানবদেহের আকারের একটা বাথটাব আছে। এখানে রোগীদের পথ্য হিসেবে দেওয়া হতো হার্বাল গোসল।

বিয়ের ছবি তোলা নিষেধ!

হাসপাতালের পাশেই একটা সাইনবোর্ডে লেখা—ডু নট টেক ওয়েডিং ফটোগ্রাফস! নবম শতাব্দীতে নির্মিত এই হাসপাতালকে দুনিয়ার সবচেয়ে পুরোনো হাসপাতালগুলোর একটি বলে ধারণা করা হয়।

এই পথ যদি না শেষ হয়!

শ মিটার সামনেই মিহিনতালে আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম। এখানে হাসপাতালের সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট থেকে শুরু করে স্যানিটেশনের জিনিসসহ প্রচুর জিনিসের রেপ্লিকা আছে। আগ্রহ নিয়ে ঘুরে দেখলাম। এ ছাড়া আছে অনেকগুলো বুদ্ধমূর্তি আর মাটির তৈরি নানা তৈজস। পুরো এলাকাতেই প্রচুর মুখপোড়া হনুমান। কিছুটা এগিয়েই মানিনাগা মন্দির। চারপাশের সীমানা আর মাঝের পাঁচটা কক্ষ অবশিষ্ট আছে।

রাতে এখানেই ছিলাম

ভিক্ষুদের আবাস ছিল মূলত এই জায়গা। এর চত্বরেই তালগাছকে গ্রাস করা বিশাল এক অশ্বত্থ আছে। এখান থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি ধাপে ধাপে পেরিয়ে উঠতে হয় কানথাকা ডাগোবা। এই ডাগোবা মূলত তিনটি বৃত্তাকার পোড়ামাটির ইটের তৈরি স্তূপ।

মূল স্থাপনার সদর দরজা হিসেবে এটি অসম্ভব সুন্দর।

নাগা পুকুর

কাঠগোলাপের ঝরে পড়া ফুলের মধ্য দিয়ে আরও আরও সিঁড়ির সোপান বেয়ে ওপরে উঠলে কানথাকা চেটিয়া। উঠতে উঠতে জুমন ভাই বললেন, ‘শেষ হয় না ক্যান! মনে হচ্ছে এভারেস্টে উঠতেছি!’ শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রাচীন স্তূপা এটি। ৪২৫ ফুট ব্যাসার্ধের এই স্তূপা কার হাতে তৈরি জানা না গেলেও স্থাপনা হিসেবে এটি অনন্য। এর আশপাশে রাজা দেবানাপেতিস ৬৮টি গুহা বানালেও আমরা খুঁজে পেলাম আসালি নামে একটিমাত্র গুহা। কালের পীড়নে আর ভূখণ্ডের নানা পরিবর্তনে বাকিগুলো বুজে গিয়েছে। আসালি গুহা থেকে একটু এগোলে বিশাল এক খাদ। মিহিনতালে রাজমহা বিহার পরিষ্কার দেখা যায় এখান থেকে।

মিহিনতালে রক

কানথাকা চেটিয়া থেকে নেমে পড়লে টিকিট কাউন্টার। রাজমহা বিহার আর মিহিনতালে রক দেখার জন্য দর্শনার্থীদের টিকিট কাটতে হয়। টিকিট কাউন্টারের অদূরেই বৌদ্ধভিক্ষুদের ভিক্ষার হল। স্থাপত্যের দিক থেকে অনেকটাই আগের স্থাপনাগুলোর মতোই।

পাশের পাথুরে শিলালিপিতে আছে পোড়ামাটির তৈরি নানান ইটের স্তূপ। দশম শতাব্দীতে রাজা চতুর্থ মাহিন্দার আমলে তৈরি এসব। এবার টানা সিঁড়ির অনেকগুলো ধাপ চড়ে সেলা স্তূপা। এর আগেই অবশ্য পা আর মাথা খালি করতে হয়েছে এই ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রবেশের রীতি অনুযায়ী। স্তূপাকে কেন্দ্রে রেখে চার কোণায় চারটি বুদ্ধমূর্তি। বামে একটি পাথরের ওপর ধ্যানী শুভ্র বুদ্ধ। ওই পাথর কেটে ধাপ বানানো হয়েছে।

এর ডানে একটাই পাথরের ওপর আরাধনা গালা। অবশ্য সবাই এখন একে মিহিনতালে রক নামেই চেনে। সম্রাট অশোকপুত্র মাহিন্দার সঙ্গে রাজা দেভানামপিয়াথিসসার প্রথম সাক্ষাৎ এখানেই হয়েছিল। তীর্থযাত্রীদের উঠার জন্য এখানে ধাপ কেটে সিঁড়ি করা আছে। সঙ্গে রেলিংও দেওয়া আছে। জায়গাটায় প্রচণ্ড বাতাস। এই কড়া রোদ আর চড়া বাতাস উপেক্ষা করেও একদল বুড়াবুড়ি তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছেন। ওপর থেকে আশপাশের এলাকার ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ দেখা যায়। দূরের বেশ কয়েকটা বড় জলাধার চোখে পড়ল। এরপরে আবার সিঁড়ি ভাঙা।

মিহিনতালে রাজমহা বিহার

আরাধনা গালার অপর পাশে মিহিনতালে রাজমহা বিহার। বিশাল দুই স্তূপার পাশপাশি আছে ছোট্ট একটি মন্দির। এর অভ্যন্তরে সিংহশয্যায় শায়িত বুদ্ধের পাশাপাশি আছে গণেশের মূর্তিও। আর আছে বিহার প্রাঙ্গণে বেশ কয়েকটা অতিকায় বোধিবৃক্ষ। বিহার দর্শন শেষে অনেকগুলো সিঁড়ির সোপান টপকে এগোলাম বাম দিকে। গন্তব্য নাগা পকুনা। সিংহলাতে পকুনা শব্দের অর্থ পুকুর। একটা অতিকায় পাথরের খুঁড়লে ছোটো পুকুরের মতো জলাশয়। উপলখণ্ড নিংড়ানো পানি অল্প অল্প জমা হচ্ছে ওই জলাশয়ে। সবখানেই গুলাচি তথা কাঠগোলাপের বিশাল সব গাছ। কাঠগোলাপের এমন অতিকায় গাছ আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

কানথাকা চেটিয়াতে জুমন ভাই

রাজমহা বিহার থেকে নেমে সোজা কাটু সেয়া। মহাসড়কের পাশের স্তূপা এটি। শ্রীলঙ্কা পৌঁছে যেদিন বাসযোগে কলম্বো থেকে জাফনা যাচ্ছিলাম, সেদিনই রাস্তার পাশে দেখেছিলাম এই স্তূপা। এই স্তূপাতে মহাযানপন্থীদের শিলালিপি পাওয়া গেছে। অন্য স্তূপার তুলনায় এখানে প্রচুর আরাধনা হয়। লোকে নৈবেদ্যের ফল সাজিয়ে আনছে পুরোহিতের কাছে। আর আমাদের চোখের সামনেই পুরোহিতের থালা থেকে কলা ছিনিয়ে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে উদরে চালান করে দিল বানরেরা। জুমন ভাই অনেক চেষ্টায়ও ওদের ফুসলিয়ে একটা কলা নিতে পারল না।

মানতের সুতাও কম জমেনি এই স্তূপার গায়ে। ইনডিকাটু স্তূপার অবস্থা কাটু সেয়ার মতো নয়। ভগ্নদশা স্তূপাটির এক কোণে ছোট্ট একটা বুদ্ধমূর্তি আছে। আর একটু এগিয়ে একটি প্রাচীন পুকুর। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে গভীরে। মধ্য আর দক্ষিণ ভারতে এই ধরনের জলাশয় প্রচুর। ওরা বলে বাওলি।

আসিলা গুহা

মিহিনতালের মনাস্টিক জোন ছাড়িয়ে লালরঙা সুন্দর একটা পোস্ট অফিস চোখে পড়ল। হেলা বজুন হালা নামক রেস্তোরাঁয় খাওয়া হলো দুপুরের খাবার। রাজারাতা ইউনিভার্সিটি অব শ্রীলঙ্কার ক্যাম্পাসের সঙ্গেই লাগানো রেস্তোরাঁটি। কৃষি বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব খাবারের দোকান চালান মূলত নারীরা। খেয়ে পথে নামতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে গৌতমবুদ্ধের বিশাল মূর্তি। কান্নাত্তিয়ার কিছু পরে ফের থামা। আমরা দুজনই চা-কাতর, চায়ের পিপাসা মেটাতে হবে। আজ চায়ের প্রাপ্যতা হিসেবে বেশ ভালো দিন যাচ্ছে। সকাল থেকে বেশ কয়েক কাপ চা-কফি জুটেছে। একটু এগিয়ে পেলাম মানাসলু নামক লজ। নেপালে অবস্থিত বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম শৃঙ্গ এই সমতলে চলে এল কীভাবে কে জানে!

ধ্যানরত বুদ্ধের স্থাপনা

কুরুনডানকুলাম থেকে বামের ছোটো রাস্তা ধরলাম। রাস্তায় পা রেখেই মনে হলো, আরে এমন রাস্তাই তো খুঁজছি। ছায়াঘেরা, মৃদুমন্দ বাতাসও আছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার মহাসড়কের ব্যস্ততা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। একটাই ঝামেলা। পথের ধারের বাড়িগুলোর কুকুরেরা আমাদের সহ্যই করতে পারছে না। দুজনের হাতে দুটো কঞ্চি নিতেই আর কেউ আমাদের দেখে ঘেউ ঘেউ করে না।

কিংস মেমোরিয়াল

কালাট্টেওয়ার কাছে সমাধি ইন্টারন্যাশনাল বুড্ডিস্ট সেন্টার। পাশেই এক খেতে প্রচুর ময়ূর। অনুরাধাপুরের কাছেই রাজভবনা নামে ঝাঁ–চকচকে বাড়ির সামনে ‘রুমস’ লেখা সাইনবোর্ড দেখে খানিকটা দোনোমনা করে মালকিনের নম্বরে ফোন দিলাম। দোটানায় ভোগার কারণ একটাই। দেখে মনে হচ্ছিল এই হোটেলের ভাড়া আমাদের সাধ্যের বাইরে হবে। কিন্তু ফোনে কথা বলে বুঝলাম ভাড়া আমাদের সাধ আর সাধ্যের মধ্যেই আছে। তবে অসুবিধা অন্য জায়গায়। বাড়ির কেয়ারটেকার ভদ্রমহিলা সিংহলা ব্যতীত অন্য কিছু জানেন না।

জুমন ভাইয়ের শ্রীলঙ্কান কলিগ নাতাশার সাহায্য নেওয়া হলো যোগাযোগের জন্য। বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িতে আমরা ছাড়া আর কোনো অতিথি নেই। অসম্ভব পরিপাটি আর গোছানো বাড়িটি। যোগাযোগের অসুবিধা দূর করার জন্য বাড়ির মালকিন শহরের অন্য প্রান্ত থেকে নিজেই গাড়ি নিয়ে চলে এলেন। অসম্ভব প্রাণবন্ত ব্যবহার মেনকা নামের এই ব্যাংক কর্মকর্তার। কেয়ারটেকার মহিলার নারকেল তেলের শৈল্পিক ব্যবহারে রাতের খাবারটাও হলো জম্পেশ। (চলবে)