পর্যটকদের নিয়ে পদ্মায় নৌকা বাইতেন। এই কাজ করতে করতেই পাখিবিশারদ আর আলোকচিত্রীদের সান্নিধ্যে আসা। তাঁদের সঙ্গে মিশে মিশে এখন নিজেই হয়ে উঠেছেন পাখির আলোকচিত্রী, সুদক্ষ গাইড। রাজশাহীতে পাখির ছবি তুলতে গিয়ে নূর ইসলামেকে গাইড পেয়েছিলেন মোছাব্বের হোসেন
পাখির ছবি তুলতে রাজশাহীতে যাব। আরও দুই শখের আলোকচিত্রীর সঙ্গে পরিকল্পনা পাকাপোক্ত। গাইডের কথা উঠতে একটি নামই মাথায় এল—নূরু মাঝি। মাসখানেক আগেই নূরকে বুকিং দিলাম। পাখির ছবি তুলতে যাঁরা রাজশাহী যান, তাঁদের অধিকাংশই গাইড হিসেবে নূরকে চান। নূর জানেন, কোন পরিযায়ী পাখি কখন চরে আসে, কোন জায়গায় বাসা বাঁধে, সকালে বা বিকেলে কোথায় কোথায় বসে থাকে, কখন ওদের প্রজনন সময়। পাখির গতিপ্রকৃতি যাঁর নখদর্পণে, দূরদূরান্তের পাখিপ্রেমীরা তো তাঁকে খুঁজবেই!
গত বছরের এপ্রিলে ছিল নূরের সঙ্গে আমাদের সেই ছবি তোলার আয়োজন। গিয়েছিলাম পদ্মার চর মাঝারদিয়ায়। প্রখর রোদ তখন। পাখি উড়ছে বেশ ওপরে। উড়ন্ত পাখির ছবি তুলতে গিয়ে আমাদের গলদঘর্ম দশা। দেখে আমাদের আশ্বস্ত করলেন নূর, ‘অপেক্ষা করেন, এই পাখিরই ভালো ছবি পাবেন।’
ষাট বিঘা নামের একটি চরে নোঙর করলেন নূর। একটু দূরেই ছোট আরেকটি চর। দুই পাশে পানি। নূরের পরামর্শমতো পানিতে গা ডুবিয়ে ক্যামেরা হাতে অপেক্ষা করতে থাকলাম। রোদ পড়ে এল। শেষ বিকেলে চরে একে একে নেমে এল পানচিল। একটি পুরুষ পাখি সঙ্গীকে মাছ তুলে খাইয়ে দিল। আমরা ক্যামেরার শাটার চাপতে লাগলাম। সারা দিনের অপেক্ষা আর পানিতে ডুবে থাকা আমাদের সার্থক হলো। নূরের পরামর্শেই কিন্তু কাছ থেকে সুন্দর পাখিটির সাক্ষাৎ পেলাম।
এ তো গেল গত বছরের অভিজ্ঞতা। টাটকা অভিজ্ঞতাটাও আছে। গত সপ্তাহে ঝটিকা সফরে রাজশাহী গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগেই নূরের সময় নিয়ে রাখলাম। সেই সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে গেলে আমার কাঙ্ক্ষিত পাখির ছবি পাওয়া যাবে কি না, জানতে চাইলাম। পাখির নাম শুনে নূর আশ্বস্ত করলেন, পাওয়া যাবে। যাতায়াত, খাওয়াদাওয়াসহ স্থানীয় মাঝির ব্যবস্থাও করলেন নূর। তাঁর দেখানো পথে গিয়ে সকাল সকালই মিলল বিরল মদনটাকের দেখা। বিকেলে ক্যামেরাবন্দী হলো মাছ মুরালও। সেদিন ছবি তুলতে তুলতেই নূর ইসলাম ওরফে নূরু মাঝির জীবনের গল্পটাও শোনা হলো।
হাতে উঠল বইঠা
২০১৫ সাল। আগের বছর এইচএসএসি পাস করেছেন নূর ইসলাম। তারপর অর্থের অভাবে থেমে যায় তাঁর পড়াশোনা। বাবা তৈয়ব হোসেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কম বেতনের চাকরি করতেন। বেতনের টাকায় সংসার চলছিল না বলে ঋণ করেন। পাঁচজনের সংসারে বাবার ঋণের বোঝাটা নূরও অনুভব করলেন। তাই একদিন যমজ ভাই নূর মোহাম্মদকে নিয়ে নেমে পড়লেন পদ্মায়। নৌকা ভাড়া নিয়ে ঘুরতে আসা মানুষদের বিভিন্ন জায়গা দেখাতে নিয়ে যেতেন দুই ভাই। যাত্রী না থাকলে মাছ ধরতেন।
একদিন কয়েকজন আলোকচিত্রী নূরের নৌকাটা ভাড়া নেন। পাখি দেখতে এসেছেন তাঁরা। সারা দিন তাঁরা চরে চরে পাখি দেখেন, ছবি তোলেন। বিদায়বেলায় আলোকচিত্রী দলটির সদস্য তারেক অণু পাখিবিষয়ক একটি বই নূরের হাতে তুলে দিয়ে আসেন। তারপর থেকে কোনো পাখি দেখলেই বইটি থেকে পাখিটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন। যেমনটি নূর বললেন, ‘অনেক সময় বইয়ের ছবির পাখিও বাস্তবে মিলিয়ে দেখতে থাকলাম। বইয়ের পাখিকে বাস্তবে দেখলে ভারি আনন্দ হতো। আবার আলোকচিত্রীরা যখন পাখির ছবি তুলতে আসতেন, আমি তাঁদের পাখির নাম বলতাম আর বলতাম সেসব পাখি কোথায় কোথায় থাকে। আলোকচিত্রীরাও খুশি হতেন।’
আলোকচিত্রীদের বাহবা নূরকে পাখি সম্পর্কে জানতে আরও আগ্রহী করে তোলে। বই সংগ্রহ করেন। ইন্টারনেটে ছবি সম্পর্কে পড়েন। আলোকচিত্রীদের প্রথম দলটিও উৎসাহ দিতে থাকে। এভাবে নিজেই খুঁজে খুঁজে বের করলেন রাজশাহীর কোন চরে কোন পাখি থাকে, কখন থাকে। জানাশোনা বাড়তে থাকলে আলোকচিত্রীদের কাছে চেনা মুখ হয়ে ওঠেন নূর।
সচরাচর যেসব পাখি দেখা যায়, তার বাইরে নতুন কোনো পাখি দেখলে যেন আলোকচিত্রীদের জানান, নূরকে সেই কথাও অনেকে বলে রাখতেন। নূরও নতুন পাখির সন্ধানে পাখিদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করলেন। নতুন পাখির দেখা পেলেই আলোকচিত্রীদের জানাতেন। সেই পাখির ছবি তুলতে আলোকচিত্রীরা আসলে তাদের কাছ থেকে নতুন পাখির নামও শিখে নিতেন নূর।
এভাবে দেখা যেত মৌসুমি পাখিদের যাঁরা ছবি তোলেন, তাঁরা নূরের কাছে পাখি আসার খবর জেনে নিচ্ছেন। রাজশাহী গিয়ে তাঁরা নূরেরই খুঁজে নিচ্ছেন। নূরের পরিচিতি ও কাজের ব্যাপ্তি দিন দিন বাড়তে থাকে। তত দিনে শুধু আলোকচিত্রীই নন, দেশি-বিদেশি পাখি–গবেষকেরাও খুঁজে নিতে থাকেন নূরকে। পাখি দেখানো, ছবি তুলতে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করা, পরামর্শ দেওয়া—সবই করতে থাকেন নূর।
হাতে উঠল ক্যামেরা
অনেক সময় বইঠা রেখে হাতে তুলে নিতেন অতিথি কোনো আলোকচিত্রীর ক্যামেরা। নিজেই পাখির ছবি তুলতেন। শুরুতে যেভাবে তুলতে চাইতেন, পারতেন না। আলোকচিত্রীদের কাছে তখন এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতেন নূর। ক্যামেরার প্রতি নূরের আগ্রহটা খেয়াল করেছিলেন আলোকচিত্রী নাজমুল হক। একদিন তিনিই একটি ক্যামেরা এনে তাঁকে উপহার দিলেন। নূরের আনন্দ আর ধরে না। ফুরসত পেলেই ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে ছুটে যান। অনেক সময় কোনো দলের সঙ্গে গেলে নৌকা রেখে তুলতে থাকেন পাখির ছবি। বইঠার সঙ্গে এভাবে ক্যামেরা চালনাতেও হাত পাকিয়ে ফেলেন নূর।
২০১৯ সালে আরেকজন আলোকচিত্রী নূরকে উপহার দিলেন নতুন একটি নাইকন ক্যামেরা আর সরঞ্জাম। এটা আগেরটার চেয়েও উন্নত। গাইড হিসেবে অন্য আলোকচিত্রীদের সঙ্গে নূরও ছবি তোলেন এখন। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন নূর। তিনি বলছিলেন, ‘এর মধ্যে আছে বৈকাল তিলিহাঁস, নীলশির হাঁসসহ প্রায় সব ধরনের পরিযায়ী হাঁস ও রাজহাঁস, বিরল প্রজাতির ইউরোশিয়ান চামচঠোঁটি বক, পাঁচ ধরনের মানিকজোড়, পাঁচ ধরনের প্যাঁচা, গাংচোষা, তিন ধরনের তিতির, মদনটাক, ঝুঁটিয়াল চটক, সাহেব বুলবুলি, বামন মাছরাঙাসহ অনেক বিরল পাখির ছবি। তবে একসঙ্গে ১৩৫টি রাঙা মানিকজোড় দেখা আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।’
আরেকটা বিরল অভিজ্ঞতার গল্পও শোনালেন। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর আলোকচিত্রী মঈনুল আহসানের সঙ্গে রাজশাহীর চরে গিয়ে দেখেন অচেনা চারটি পাখি। মঈনুল আহসানের সঙ্গে পাখি চারটির ছবি নূরও তোলেন। পরে জানা যায়, এগুলো সাগরের পাখি। নাম সুটি টার্ন, ব্রাইডেল টার্ন, লং টেইলড জেগার, উইলসনস স্টর্ম পেট্রেল। বাংলাদেশে পাখি চারটি দেখার নতুন রেকর্ড হয়।
কাজটা নূর ভালোবেসে করেন
বছরজুড়েই এখন ব্যস্ত নূর। তবে শীতের সময়টায় বেশি। এ সময় পদ্মায় পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বেড়ে যায়। নূর বললেন, ‘ছুটির দিনগুলোয় আমার নৌকা দুই মাস আগেই বুকিং থাকে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের হয়ে নিয়মিত কাজ করি। এসব কাজের বিনিময়ে ভালো পারিশ্রমিক পাই।’ এই কাজ করেই এখন পাঁচ সদস্যের সংসারের হাল ধরেছেন নূর।
কয়েক বছর ধরেই নূরকে চেনেন বন্য প্রাণী গবেষক ও আইইউসিএনের কর্মকর্তা সীমান্ত দীপু। নূর সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘নূরুকে আমরা আমাদের সহকর্মী মনে করি। তাঁকে বন্য প্রাণী বা পাখির বই দিয়ে আমরা গড়ে তুলেছি। পাখিশুমারি বা পাখি গবেষণার জন্য রাজশাহীর দুর্গম চরে আমাদের যেতে হয়। নূরুকে আমরা চোখ বন্ধ করে সঙ্গে নিতে পারি। রাতে বা দিনে কোন চরে কীভাবে যেতে হবে, কোথায় জোরে, কোথায় আস্তে চলতে হবে বা কোথায় থামতে হবে, নূরু তা আমাদের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারেন। রাতের বেলা চরের মধ্যে গিয়ে গবেষকদের খাবার সরবরাহ করেন। বিরল পাখির সম্বন্ধে স্থানীয় মানুষদের মাঝে কীভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, সে দায়িত্ব নূরু পালন করেন। এসব কাজ ভালোবাসা ছাড়া করা যায় না। নূরুর সেটা আছে।’