শৈবাল সংগ্রহ করতে উত্তর মহাসাগরে গিয়েছিলেন ফৌজিয়া, দেখে এসেছেন মেরুভালুক

আর্কটিক ওশান বা উত্তর মহাসাগরের শৈবালের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের ফৌজিয়া আহমেদ। তিনি পিএইচডি করছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবায়। গবেষণার অংশ হিসেবে গত জুনে গিয়েছিলেন মহাসাগরের বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে। সেখান থেকে শৈবালের নমুনাসহ গবেষণার অনেক উপাদান সংগ্রহ করে এনেছেন। সেই অভিযানের অভিজ্ঞতা শুনুন তাঁর কাছেই

কোর ব্যারেল দিয়ে বরফের নমুনা সংগ্রহ
ছবি: ওলাফ স্নাইডার

গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। জাহাজটা কেমন ধীরলয়ে দুলে দুলে এগিয়ে যাচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসি। ঘটনা বোঝার জন্য জানালার ভারী পর্দাটা সরিয়ে বাইরে তাকাই। দেখি, চারদিকে শুভ্র বরফ। আকাশে গোধূলির মিষ্টি রোদ বরফের গায়ে পড়ে চকচক করছে। আর জাহাজটা বরফ কাটতে কাটতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই শব্দেই ঘুম ভাঙে আমার।

আর্কটিক ওশান বা উত্তর মহাসাগরে ৩ জুন ছিল আমাদের তৃতীয় দিন। নরওয়ের সিলবার্ডের জেটি ছাড়ার পর কিছুটা সময় পাহাড় দেখতে পেয়েছি। এরপর শুধু পানি আর পানি। দ্বিতীয় দিন নজরে পড়ে ভাসমান বরফখণ্ড। যতই উত্তরের দিকে যাচ্ছিলাম, বরফের ঘনত্ব ততই বাড়ছিল। আর আজ পেলাম শুধুই বরফ। আমাদের বহনকারী জাহাজটি আইস ব্রেকিং শিপ। এটি এখন বরফ কাটতে কাটতে এগোতে থাকবে।

বরফ কাটার সময় এমন শব্দ হবে আগেই জানা ছিল, তাই আকস্মিক ভয় কেটে গেলে পর্দা টেনে আবার শুয়ে পড়ি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি, রাত তিনটা বাজে। তবে বাইরে গোধূলিবেলা। উত্তর মহাসাগরে জুনের এই সময় ২৪ ঘণ্টাই দিন। ঘুমের জন্য এখানে রাতের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

উত্তর মহাসাগরের শুভ্র বরফে গবেষকেরা নেমে পড়েছেন নমুনা সংগ্রহের কাজে

ক্রাউন প্রিন্স হাকন

জাহাজ এগিয়ে চলছে। আরভি ক্রাউন প্রিন্স হাকন নামের অত্যাধুনিক জাহাজটি নরওয়েজিয়ান পোলার ইনস্টিটিউটের। পুরোপুরি গবেষণার জন্য তৈরি এটি। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণার জন্য নিউট্রিয়েন্ট, জুপ্লাঙ্কটন, আইসোটোপ, মাইক্রোপ্লাস্টিক ল্যাব আছে জাহাজেই। গবেষণাগারের পাশে আছে গবেষকদের থাকার ছোট ছোট কেবিন। প্রতিটি কেবিনে বাঙ্ক বেড বা দোতলা খাটে থাকার ব্যবস্থা।

১ জুন সিলবার্ডের লংইয়ারবিনের জেটি থেকে ছোট নৌকায় করে আমাদের জাহাজের কাছে নিয়ে আসা হয়। এরপর ক্রেনে করে জাহাজের চারতলার ডেকে তোলা হয়। বিশাল সব যন্ত্রপাতির বাক্সও একে একে ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুরের পর উত্তর মহাসাগরের উদ্দেশ্যে আমাদের জাহাজ ছেড়ে আসে।

জাহাজে আমরা ২৬ জন গবেষক। এর মধ্যে নরওয়েজিয়ানদের সংখ্যাই বেশি। এর বাইরে পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের গবেষক আছেন। ২৪ জনের মধ্যে ১৮ জনই নারী। আমি রুমমেট হিসেবে পেয়েছি ফরাসি মেয়ে কোরাকে। ২০ বছরের মেয়েটি এই অভিযানের সবচেয়ে কমবয়সী সদস্য। এর বাইরে ক্যাপ্টেন, নাবিক, ক্রু মিলে জাহাজ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন আরও কয়েকজন।

জাহাজে বাংলাদেশি আমি একা। গবেষকদের অনেকেই আমার দেশের নাম আগে শোনেননি। তাই দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের সঙ্গে অনেক গল্প করলাম দেশ নিয়ে। আমাদের সংগ্রাম, ঐতিহ্য আর এগিয়ে চলার গল্প বললাম। অনেকেই বেশ অবাক হলেন এ কারণে যে আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তের একটা দেশ থেকে মেরু অঞ্চলে এসেছি গবেষণা করতে।

সংগৃহীত নমুনা সংরক্ষণ করছেন লেখক

এমন অবাক আমার কাছের মানুষেরাও হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলাম। স্নাতকোত্তর শেষে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য আবেদন করি। সাড়া পাই কানাডা আর যুক্তরাজ্যের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার যে অধ্যাপক আমাকে গবেষণার সুযোগ দেন, তিনি আর্কটিক বা উত্তর মহাসাগরের শৈবালের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কাজ করেন। আমি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ, পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেরিয়েছি। তাই তৎক্ষণাৎ মনে হলো, যাই না এবার সাগরে! ২০২১ সালে চলে আসি কানাডায়। মাস্টার্স শেষে এখন পিএইচডি এগিয়ে নিচ্ছি।

গবেষণার কাজে কানাডীয় আর্কটিক অঞ্চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হলেও উত্তর মেরুর কাছাকাছি এবারই প্রথম। মার্চ মাসে হঠাৎ করেই আমার পিএইচডি কমিটি মেম্বার এই অভিযানের কথা আমাকে জানায়। অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছি জেনে দারুণ খুশি হয়েছিলাম। এরপর নরওয়ের ভিসা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিমান টিকিট সব ঝামেলা শেষ করে কানাডা থেকে উড়ে আসি নরওয়েতে।

উত্তর মহাসাগরে লেখক

জাহাজ উত্তর মহাসাগরে

জাহাজে ওঠার আগে কয়েক দিন প্রশিক্ষণ হয়েছে আমাদের। জাহাজে থাকা, বরফে নামা, নমুনা সংগ্রহ ইত্যাদি বিষয় কীভাবে সমাধা হবে, সেসব শেখানো হয় তখন। রীতিমতো রেগাটা স্যুট পরে বরফেও নেমেছিলাম। কোনো কারণে বরফ ভেঙে নিচে পানিতে তলিয়ে গেলে এই পোশাক ভেসে থাকতে সাহায্য করে।

প্রশিক্ষণের সময়ই পরিকল্পনা হয় আমরা নানসেন সামুদ্রিক অববাহিকায় যাব। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বরফের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বরফ ভাঙতে জাহাজের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এ বছর ইউরোপের বসন্ত অনেক ঠান্ডা হওয়ায় জুনের শুরুতেও বরফ গলতে শুরু করেনি। প্রায় চার-পাঁচ দিন চেষ্টার পরও আমরা একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি। অভিযানের ষষ্ঠ দিনে ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত নিলেন, অবস্থান বদলে জাহাজ দক্ষিণ-পশ্চিমে নিয়ে যাবেন।

জাহাজে করে যেতে যেতে যেখানে নামার উপযুক্ত বরফের আস্তরণ দেখা যাবে, সেখানে আমাদের নামানো হবে। ষষ্ঠ দিনে এমন একটা জায়গায় এসে জাহাজ থামল। প্রথমে আমাদের নিরাপত্তা কর্মকর্তা নামলেন। তিনি বরফের পুরুত্ব পরীক্ষা করে দেখলেন, জায়গাটা নামার উপযোগী। তাঁর সবুজ সংকেত পেতেই আমরা কয়েকজন নেমে পড়লাম। নামাটাও কায়দা করে। নিচে নেমে যথাসম্ভব জাহাজের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করলাম। যেন মেরুভালুক এলে দ্রুত জাহাজে ফিরতে পারি। এরপর ক্রেন দিয়ে নিচে নামানো হলো নমুনা সংগ্রহের আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি।

যেখানে দাঁড়িয়েছি, সেখানকার বরফ বহু বছরের পুরোনো। এখানে বরফের পুরুত্ব ১৫০ সেন্টিমিটারের বেশি। এমন পুরু বরফে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। বরফ সংগ্রহের জন্য আমরা কোর ব্যারেল নামের যন্ত্র ব্যবহার করি। পাইপের মতো যন্ত্রটির নিচের দিকে ব্লেড যুক্ত, এটি বরফ কেটে নিচে চলে যায়। ওপরে তুলে আনে লম্বা আইস কোর বা বরফের ফালি। আমার কাজ অবশ্য নিচের অংশটুকু নিয়ে, যেখানে শৈবাল জন্ম নেয়। এবারও তা-ই করলাম। পুরো বরফটুকু তুলে আনার পর আমি ছুরি দিয়ে নিচের অংশ কেটে নিয়ে কুলারে রাখলাম। কাজ শেষে নমুনা নিয়ে গেলাম ল্যাবে। এখানে প্রক্রিয়াজাত করার কাজটিও বেশ সূক্ষ্মভাবে করতে হয়। কিছু নমুনা ২৪ ঘণ্টার জন্য শীতল কক্ষে ইনকিউবেশন করি। আর কিছু ফিল্টার করে হিমাঙ্কের নিচে ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রার ফ্রিজে সংরক্ষণ করি।

মেরুর বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষায় শৈবালের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আর্কটিকের বরফ গলে যাচ্ছে খুব দ্রুত, যার ফলে শৈবালের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এই অঞ্চলের পুরো ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের ওপর।

জাহাজ নিয়ে সামনে যেতে যেতে এভাবে বরফ সংগ্রহ করাই ছিল আমাদের কাজ। এর পাশাপাশি সমুদ্রের পানিও সংগ্রহ করেছি আমরা।

গবেষণার সরঞ্জাম পেয়ে মেরুভালুকের কৌতূহল দেখে কে!

ভালুকটা মুখ তুলে তাকাল

জাহাজ থেকে নিচে নেমে যখন একটা দল কাজ করে, তখন আরেকটা দল ভালুকের আনাগোনায় লক্ষ রাখতে জাহাজের ৮ নম্বর ডেকে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার হাতে দাঁড়ায়। কাজটা খুব মনোযোগ দিয়ে করতে হয়। দায়িত্ব পালনের সময় আমি কয়েকবার ভালুক দেখেছি, তবে সেটা অনেক দূরে।

মেরুভালুক ভয়ের হলেও, প্রাণীটা দেখতে খুব আদুরে। তাই আমরা সবাই একবার না একবার সামনাসামনি দেখতে চাই। এই মনোবাসনা ক্যাপ্টেনকে জানাই। তিনিও যখনই ভালুক দেখতে পান, তখনই তা মাইকে জানিয়ে দেন। আমরা যে যেখানে থাকি, সেখান থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ি ভালুক দেখতে। কিন্তু এত দূরে থাকে যে কিছুতেই ছবি তোলা সম্ভব হয় না।

অভিযান শেষ দিকে চলে এসেছে। জাহাজ যেখানে নোঙর করা, তার চারপাশে বরফ। এখানে জাহাজের কাছে ভালুক আসার সম্ভাবনা প্রবল। ক্যাপ্টেনকে কেবিন নম্বর দিয়ে বললাম, কাছাকাছি যখনই ভালুক দেখা যাবে, তখনই যেন ইন্টারকমে কল দিয়ে জানান।

পরদিন ভোর পাঁচটায় আমাদের রুমে কল এল। আমি গভীর ঘুমে। কোরা ডাক দিয়ে তুলে বলল, কল এসেছে। কার কল, কিসের কল এসব শোনার সময় নেই! পড়িমরি করে দৌড়ে বাইরে গেলাম। ডেকে দাঁড়াতেই দেখি, একটা ভালুক হেলেদুলে আমাদের জাহাজের দিকেই আসছে। একসময় জাহাজের খুব কাছে চলে এল। একবার আমার দিকেও মুখ তুলে তাকাল। কী যে সুন্দর তার চোখ দুটো! এরপরই খাবার খুঁজতে শুরু করল।

মেরুভালুকের সুন্দর সেই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে আমরা সিলবার্ডে ফেরার পথ ধরি।