আয়না হ্রদের খোঁজে

পর্যটন শহর ব্যানফ
ছবি: লেখক

গত শীতে ব্যানফ শহরে যাওয়া হয়েছিল। নভেম্বর মাত্র শুরু হয়েছে, এর মধ্যেই চার দিকে তাল তাল বরফ। ক্যালগারি এয়ারপোর্টের রানওয়ের দুপাশেও জমে আছে বরফ। টরন্টোতেও ঠান্ডা, তবে সেভাবে বরফ পড়েনি। বেশ সুন্দর আবহাওয়া। যত পশ্চিমে যাওয়া হবে, শীতের প্রকোপ ততই মনে হয় বাড়বে। অন্তত ক্যালগারি এয়ারপোর্টে এসে তা-ই মনে হলো। এখনো নাকি পুরোদস্তুর শীত পড়েনি।

ব্যানফ কানাডার আলবার্টা প্রদেশের একটি পর্যটন শহর। এই শহর খোদ কানাডীয়দের কাছেই বিশেষ আগ্রহের। অবাক করা সুন্দর, ছিমছাম এক ছোট্ট জনপদ, কোনো এয়ারপোর্ট নেই। এ থেকেই বোঝা যায় শহরটা আসলেই কত ছোট। পাহাড়ঘেরা এই নগরের চারদিকেই সৌন্দর্য। শীতে পাহাড়গুলো বড় বড় আইক্রিমসদৃশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—এ আমার ছবিতে দেখা। বাস্তবে কেমন, এবার দেখা যাবে। আগে গ্রীষ্মে আসা হয়েছিল। ভ্রমণপ্রেমীদের আনাগোনায় এই শহর তখন কানায় কানায় ভরে থাকে। অনেক আগে থেকে নাকি হোটেল-মোটেলের বুকিং দিতে হয়। হওয়ারই কথা—এই শহরে বহুতল দালান আছে বলে তো মনে পড়ে না। কটেজ ও মোটেল-জাতীয় থাকার জায়গা আছে প্রচুর, তবে সেই সংখ্যা এখানে বেড়াতে আসা মানুষের সংখ্যার কাছে কিছুই নয়। বড় হোটেলও আছে। শহরের বাইরে। এই ব্যানফেই আছে বিখ্যাত ফেয়ারমাউন্ট হোটেল। আমার অনেক দূর থেকেই কেবল দেখা হয়েছিল। বিশাল রাজকীয় ব্যাপার! এখানে রানি এলিজাবেথও নাকি ছিলেন!

ব্যানফেই আছে বিখ্যাত ফেয়ারমাউন্ট হোটেল

ক্যালগারি এয়ারপোর্ট থেকে ব্যানফ শহরে যাওয়ার সরাসরি বাস আছে ৩০ মিনিট পরপর। দারুণ ব্যবস্থা! কিন্তু দুই সহপাঠীর সঙ্গে গাড়িতে যাওয়া আরও বেশি আনন্দের হওয়ায় লিখন আর সুজার আহ্বান ফেলা গেল না। যদিও তারা ভেবেছিল, আমি আবারও সাইকেল নিয়ে এসেছি। কিন্তু না। এবার আর সাইকেল নেই। এই শীতে আর যা-ই হোক, সাইকেল একদমই না। টরন্টো থেকে আমার সঙ্গে মাহবুব ভাই জুড়ে গেছেন। থাকার সুবন্দোবস্ত আছে নিমন্ত্রণকারী সংস্থার পক্ষ থেকে। দুজনে বেশ জমে যাবে—এই লোভে আমরা পথিক হলাম।

দুপুর নাগাদ ক্যালগারি পৌঁছানো হলেও ব্যানফের উদ্দেশে রওনা হতে হতে প্রায় বিকেল। ঘণ্টা দেড়েকের পথ। ১৩০ কিলোমিটারের মতো। আমরা আসার কয় দিন আগেও নাকি বেশ বরফ পড়েছিল। কিছুটা গলে গেলেও সবটা যায়নি। তাই বিকেলের হেলে পড়া আলোয় রাস্তার দুধার সোনার চরের বালুর মতো।

আমাদের নেমন্তন্ন করেছে ব্যানফ সেন্টার। এটা বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমির মতো, তবে সরকারি নয়। কানাডার সবচেয়ে পুরোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন। আমার মতো আরও কয়েক দেশের মানুষের দাওয়াত ছিল বিখ্যাত ব্যানফ মাউন্টেন ফিল্ম অ্যান্ড বুক ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের জন্য।

ব্যানফে অনেকের সঙ্গে

ব্যানফের প্রথম তিন দিনই তুষার পড়ল। সঙ্গে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিও একটা সময় পেঁজা তুলোর আকার ধারণ করে তুষারে পরিণত হয়ে গায়ে পড়ল। প্রথমটায় দারুণ অনুভূতি! আমাদের জন্য তুষার তো দারুণই লাগার কথা। কিন্তু কিছুটা সময় পর সেই তুষার গলে পানি হয়ে যখন গা স্পর্শ করল, বুঝতে পারলাম কাকে বলে ঠান্ডা! ব্যানফ সেন্টারের পুরো ক্যাম্পাস, শহর, শহরের আশপাশের সব পাহাড়, নদী, হ্রদ—একেবারে ধবধবে সাদা। এমনই এক বিরতির দিন ভোরবেলা নানান দেশের নয়জন মিলে আয়না হ্রদ খুঁজতে গেলাম।

খুঁজতে যাওয়া কিছুটা নাটকীয়তা করে বলা। হ্রদ তো আর হারিয়ে যাবে না। কিন্তু যে পরিমাণ তুষারপাত হয়েছে, কোনটা যে হ্রদ আর কোনটা উপত্যকা, বলা দুরূহ। কথাটা আমাদের দলনেতা জিম ব্যেকারের। তিনিই প্রায় দুই যুগ ধরে ব্যানফ মাউন্টেন ফিল্ম অ্যান্ড বুক ফেস্টিভ্যালের সমন্বয়কারী।

দুই গাড়িতে দুই দলে ভাগ হয়ে আমরা নয়জন। ব্যানফ থেকে আগে যেতে হবে লেক লুইজ। লেক লুইজে বাসেও যাওয়া যায়। সেখান থেকে ট্রেকিং। আগের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। একে তো শীতের তীব্রতা, তার ওপর যে পরিমাণ তুষারপাত হয়েছে, এর জন্য আগাম প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে; বিশেষত জুতা। কিন্তু নেই যখন, কী আর করা। পথ যেহেতু দীর্ঘ নয়, তাই খুব একটা ঘাবড়ালাম না। কী আর হবে। মাঝপথে উল্টো হাঁটা—খুব বেশি হলে এ-ই।

খুব ভোরের কুয়াশার ঘোমটার মাঝে পাহাড়গুলোর অবয়ব ঠিকই ধরা দেয়। রাস্তার দুপাশের নতুন তুষারের শুভ্রতায় কালো বিটুমিন আরও চকচকে। লেক লুইজ অবধি রাস্তার ওপরের তুষার সরানো হচ্ছে অবিরত। এই যাত্রা ছোট। মিনিট চল্লিশের। প্রাতরাশের জন্য একটা ক্যাফেতে থামা হলো। যে যার মতো খাওয়া আর কফি পানে আড্ডায় নানান দেশের নানান গল্প। শীতে স্কি রিসোর্টগুলোয় মৌসুমি কামলা দেওয়ার জন্য নানান দেশের লোকজন আসেন। আমাদের মধ্যেও দুজনকে পাওয়া গেল, যাঁরা অনেক বছর আগে এসেছিলেন কামলা দিতে।

লেক লুইজ

লেক লুইজের পথের দুই পাশে গাছগাছালি। পাতাগুলোয় তুষার জমে আছে। নুয়ে পড়া ভাব। তার ফাঁক দিয়ে ফেয়ারমাউন্ট হোটেল ভবনটা দেখার মতো। এর আসল নাম ফেয়ারমাউন্ট স্যাটো লেক লুইজ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে তৈরি ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে লেক লুইজের কোলজুড়ানো মনোরম এই স্থাপনা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন! যেহেতু হোটেল, তাই রুম ভাড়াও পাওয়া যায়, তবে আমাদের সঙ্গে আসা কেউ কোনো দিনও এই হোটেলে থাকেনি। ভীষণ নাকি খরচা!

লেক লুইজের ডান পাশ ধরে ট্রেকিংয়ের পথ। জিম সবার আগে হাঁটছেন। হোটেল ছাড়িয়ে মিনিট কুড়ি এগিয়ে যেতেই তুষারে নুয়ে পড়া গাছের ডালগুলো আমাদের গা ছুঁল। পায়ের নিচে বরফমোড়া পথ। প্রতি কদমে মচমচ শব্দ হচ্ছে। এখানে আমাদের কারও কোনো তাড়া নেই। খুব ছোট পথ। ঘণ্টা তিনেক হাঁটা। ৫০০ মিটারেরও কম চড়াই ভাঙতে হবে। যে যার মতো করে হাঁটছি। তবে দেখা তো কিছু যাচ্ছে না। দুই ধারে কোমর-উঁচু বরফ আর গাছগুলো তুষারের ভারে যেন একটার সঙ্গে আরেকটা সেঁটে গিয়ে পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। সূর্য উঠেছে, তবে গাঢ় মেঘে ঢাকা। আলো আছে বটে, তবে সেই আলোয় আমাদের কোনো ছায়া পড়ছে না। লেক লুইজের পাশেই বলে কিনা জানি না, বাতাসটা একেবারে কনকনে। শরীরের যে অংশে কাপড়ের আস্তরণ নেই, তাতেই দাঁত বসিয়ে দিচ্ছে। একটা কথা আছে না—শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবেন তা-ই সয়! এখানেও তা-ই হলো। আধা ঘণ্টাও হয়নি, তাতেই ঘাম। নরম তুষার ঠেলে এগোতে শক্তি যাচ্ছে বেশি। ঘাম না ঝরে আর যায় কই। এই ট্রেইল ধরে এগিয়ে গেলে এগনেস লেক পাওয়া যাবে। সবার আগে আয়না হ্রদ পাওয়ার কথা। আরও সামনে পাওয়া যাবে একটা টি হাউস। ১৯০৯ সালে এজনেস হ্রদের পাশে লগের তৈরি একটা স্থাপনা। আমরা সেই অবধি যাব বলে জিম জানিয়ে দিলেন।

আয়না হ্রদের আসল নাম মিরর লেক

আয়না হ্রদের আসল নাম মিরর লেক। সুন্দর দিনে হ্রদে যে জলছবি তৈরি হয়, তা নাকি অতুলনীয়! কিন্তু আজ সে গুড়ে বালি। কোথায় জলছবি! জলই তো ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে বরফ আর তুষারকণায় জবজবে বাতাস। দেখব কী! যত ওপরে ওঠা, বরফের পরিমাণ শুধু বাড়ছেই। গোড়ালিডোবা পথ যে কখন হাঁটুডোবা হয়েছে, খেয়ালই নেই। ঘণ্টাখানেক পর আমরা সেই বিখ্যাত টি হাউস পেলাম। কাঠের মাচার ওপর বড়সড় একটা ঘর। বেশ কয়টা কাঠের সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হলো। যাত্রাবিরতি। জুতা ভিজে গেছে। পা জমে প্রায় বরফ। খুলে যে যার মতো খানিকক্ষণ ডলাডলি করে ধাতস্থ হওয়া গেল। যার ব্যাগে যা ছিল, তা-ই একসঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়াও হলো। আরও এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। এগনেস লেকের চার পাশে একটা চক্কর দিতে কমসে কম আরও এক ঘণ্টা। কিন্তু পথ বড় মুশকিলের। জিমের ঊরুছোঁয়া বরফ। আমার বাঙালি উচ্চতায় সেটা কোমর অবধি। তার ওপর ভেজা জুতা নিয়ে আর থাকতে চাইছিল না আমার মতো আরও কেউ কেউ। বেঁচে থাকলে দেখা যাবে আবার।