সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন দ্বাবিংশ ও শেষ পর্ব
সন্ধ্যায় কেবিনে ঢুকেই দেখি, টেবিলে একটি প্লেটে বেগুনভর্তা আর পাঞ্জাবি রুটি। কথায় কথায় জাহাজের রেস্তোরাঁ কর্মী সুহার্তু আর জুবায়েদকে বলেছিলাম, শেষবারের মতো ভর্তা-রুটি খেতে চাই। নিশ্চয়ই তাঁরা পাঠিয়েছে। হাত দিয়ে রুটি ছিঁড়ে, ছেঁড়া টুকরায় ভর্তা ভরে তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। রেস্তোরাঁয় এত তৃপ্তি নিয়ে খেতে পেতাম না!
একটু পর রাতের খাবারের ডাক এল। তৈরি হয়ে চলে গেলাম। আজ বিদায়ী ডিনার। আয়োজনে বাড়াবাড়ি রকমের পদ দেখতে পাচ্ছি। ডাইনিং রুমে এতক্ষণ মৃদু সুরে বাদ্য বাজছিল, হঠাৎ উচ্চ শব্দে গান বেজে উঠল! জাহাজে নাবিক, রেস্তোরাঁ কর্মী, পানশালার বেয়ারা, প্রশাসনের নির্বাহী, গৃহপরিচারিকাসহ নানা পদে কর্মরত মানুষ। এখন বিভিন্ন দল নানা ঢঙে নেচে-গেয়ে আনন্দ করছেন। তাঁদের হাতে নানা পদের কেক-পেস্ট্রি। মুহূর্তেই খাওয়ার রুমের দৃশ্যপট পাল্টে রীতিমতো উৎসবে রূপ নিল।
খাওয়াদাওয়া শেষে কেবিনে ফিরে বাক্স-পেটরা গোছাতে আরম্ভ করলাম। কেবিনে আমরা দুজন একই কাজে ব্যস্ত, কারও মুখে কোনো কথা নেই। নিশ্চুপ। নাস্তা আমার দিকে তার একটি কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার তো নদী খুব পছন্দ, মহুয়া। যদি ভোলগা দেখতে মন চায় তো আমার শহরে এসো। আমি যত্নে নাস্তার কার্ডটা ব্যাগে রাখলাম।
রাতে একরত্তি ঘুম হয়নি। উসুয়াইয়া বন্দরে জাহাজ ভিড়েছে। আকাশে অনেক অ্যালবাট্রস। নাশতা শেষ করে কেবিনে প্রবেশ করতেই একটি খাম। খুলে দেখি, বিলের রসিদ। এত দিন যা যা খেয়েছি আর জাহাজ থেকে যা কিনেছি, তার বিল। রিসেপশনে গিয়ে মূল্য পরিশোধ করলাম।
রিসেপশন থেকে একটার পর একটা ঘোষণা আসছে—‘অনুগ্রহ করে আপনার লাগেজ আপনার কেবিনের দরজার বাইরে রাখুন। যাঁর লাগেজ শিপ থেকে এয়ারপোর্টে যাবে, তিনি লাগেজের হাতলে সবুজ রঙের ফিতা শক্তভাবে বাঁধুন। যাঁর লাগেজ শিপ থেকে লাগেজ স্টোরে যাবে, তিনি হলুদ-নীল রঙের ফিতা শক্তভাবে বাঁধুন। ফিতা সংগ্রহ করুন “ওমুকের” কাছ থেকে।’ আমার লাগেজ এয়ারপোর্টে এখন যাবে না কারণ, আমার ফ্লাইট রাত সাড়ে নয়টায়। এখন সকাল। আমার লাগেজ যাবে লাগেজ স্টোরে। কর্তৃপক্ষ একটি হোটেল অংশবিশেষ ভাড়া নিয়েছে, যাঁদের ফ্লাইট বিকেলে বা রাতে, তাঁদের লাগেজ সেখানে জমা রাখা হবে।
কেবিনে ফিরে গিয়ে ফিতা বাঁধব, এমন সময় আবার ঘোষণা—‘দ্রুত সার্টিফিকেট সংগ্রহ করুন। আপনাদের যে দুটি কার্ড দেওয়া হয়েছে, দ্রুত ফেরত দিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করুন।’ কোথায় এই বিদায়বেলায় বন্ধুদের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদব! এসব তাগাদায় বিচ্ছিরি অবস্থায় পড়লাম। লাগেজে নীল ফিতা বেঁধে কেবিনের বাইরে রেখে দিয়েছি। আমার দায়িত্ব শেষ। এ সময় আরেক ঘোষণা, ‘রিসেপশনে একটা বাক্স রাখা আছে। কেউ যদি ক্রুদের বকশিশ দিতে চান, তবে সে বাক্সে ফেলতে হবে। বাধ্যবাধকতা নেই।’
আমি সুহার্তু আর জুবায়েদকে কিছু বকশিশ দিতে চাই; কিন্তু আলাদা করে কাউকে বকশিশ দেওয়ার নিয়ম নেই। পানির বোতল নিয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম। যেন ছল করে জল আনতে যাওয়া! ডাইনিং রুমে আর কোনো অভিযাত্রী নেই, শুধু কয়েকজন ক্রু। সুহার্তু এগিয়ে এল। একটু দ্বিধা হচ্ছে, চারদিকে ক্যামেরা। একটি টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। কিছু ডলার রাখলাম সংগোপনে টেবিলের একটা পিরিচের নিচে। আমি কেন এখানে সে বুঝতে পেরেছে। কৌশলে সে ডলার পকেটে নিল। আমি দ্রুত বিদায় নিয়ে ডাইনিং রুম ত্যাগ করি। পেছন থেকে সে ডেকে বলল, হেই বেঙ্গলি নন-অ্যালকোহলিক গার্ল, তোমার জন্য যে বেগুনভর্তা পাঠিয়েছি, সেটা কিন্তু ভদকা দিয়ে বানানো। আর যে পাঞ্জাবি রুটি, সেটাও ভদকা দিয়ে বানানো!
বিদায়বেলাতেও তার চিরাচরিত রসিকতা! তার কৌতুকপ্রিয় সত্তার সন্ধান তো আগেই পেয়েছি। আমি হেসে বললাম, ‘খুব ভালো করেছ।’
জাহাজের বাইরে কয়েকটি বাস দাঁড়িয়ে। এক বাসে লাগেজ যাবে, আরেক বাসে যাত্রী। আশপাশে পরিচিত কাউকে দেখছি না। নাস্তা, সাসকিয়া, ক্যারোলিন, সাঈদা কেউ নেই। বিষণ্ন হৃদয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। বাস চলল মিনিট দশেকের কম সময়। একটি হোটেলের সামনে আমাদের নামিয়ে দিল। রিসেপশনে বড় জটলা হয়েছে। লাগেজ এই হোটেলেই থাকবে বিকেল পর্যন্ত।
যাঁদের ফ্লাইট রাতে, সে রকম ২০ জনের একটি দল তৈরি হয়ে গেল। সে দলের আমিও একজন। প্রথমে ঠিক হলো আমরা এই শহরের ইনফরমেশন সেন্টারে যাব। যত পরিব্রাজক এই শহরে আসেন, তাঁদের পাসপোর্টে উসুয়াইয়া সিলটি ছাপিয়ে নিতে ভোলেন না। পৃথিবীর শেষ মাটি ছোঁয়ার প্রমাণ। পর্যটকের ভিড়ে সিল পেতে বেশ সময় লাগল। এমন সম্ভ্রান্ত জায়গায় বাঙালি কায়দায় ধাক্কাধাক্কি, কাড়াকাড়িও তো করা যায় না। ধৈর্য ধরতে হয়। আর আছে আরেকটি বিশেষ সিল ‘অ্যান্টার্কটিকা’। আমরা দুটিই নিলাম পাসপোর্টের দুই পাতায়। সদলবলে বেরিয়ে এলাম, ঢালু রাস্তা ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছি। একটার পর একটা বাহারি সু৵ভেনিরের দোকান। মনপ্রাণ দিয়ে দেখছি, আর তো আসা হবে না।
শহরের প্রধান সড়ক ধরেই হাঁটছি। হঠাৎ দেখি, আমার সামনে উল্টো দিক থেকে এগিয়ে আসছে সাঈদা। এক হাতে সিগারেট। ধূমপান করতে করতেই রাস্তায় ভবঘুরের মতো সে হাঁটছে। আমরা পাগলের মতো দুজন দুজনকে জাপটে ধরলাম। জাহাজ থেকে বেরিয়ে আসার সময় নাকি আমাকে সে খুঁজেছে। আমিও বললাম ওই একই কথা। আমি আর সাঈদা একটি রেস্তোরাঁয় বসলাম। দুজনের সামনে দুটি বার্গার। নাম তার ‘মেসি বার্গার’। একসময় সাঈদাও বিদায় নিল। আমিও বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য একটি ট্যাক্সি ডাকলাম।
উসুয়াইয়ার একমাত্র বিমানবন্দর থেকে বিমান ছাড়ল যথাসময়ে। যাচ্ছি আর্জেন্টিনার রাজধানী শহর বুয়েনস এইরেস। সেখান থেকে আমার গন্তব্য মেক্সিকোর কানকুন, কানকুন থেকে কিউবার হাভানা, হাভানা থেকে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে স্বদেশ। রাত সাড়ে ১২টায় পৌঁছালাম বুয়েনস এইরেসের বিমানবন্দরে। চার ঘণ্টা পরই যাত্রা করার কথা কানকুনের উদ্দেশে, সেভাবেই টিকিট কেটে রাখা। কিন্তু একটু পর জানতে পারলাম, যে বিমান সংস্থার টিকিট কেটে রেখেছি, সেই ভিভা এয়ার দেউলিয়া হয়ে গেছে। ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এখন কী হবে, কোথায় যাব! (শেষ)
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা
৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’
৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি
৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি
৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী
৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি
৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়
৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম
১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই
১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল
১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্যাপিত হলো জন্মদিন
১৩. পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম
১৪. মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠাতে পারতেন তাঁরা, এতেই হতো যোগাযোগ
১৫. নদীপারের মেয়ে আমি কিন্তু বইঠা হাতে নিয়েছি আজই প্রথম
১৬. রূপপুরে কাজ করতে আসবে রাশিয়ার ওলগা, তাঁর সঙ্গে দেখা অ্যান্টার্কটিকায়
১৭. কবরের মতো বরফ খুঁড়ে সেখানেই থাকতে হয় রাতভর
১৮. একেকজন এগিয়ে যাচ্ছেন আর লাফিয়ে পড়ছেন সাগরের হিমশীতল পানিতে
১৯. এটি পৃথিবীর একমাত্র আগ্নেয়গিরি, যার কেন্দ্রে জাহাজ নিয়ে যাওয়া যায়
২০. ‘দ্রুত সবাই জাহাজের ভেতরে প্রবেশ করো, আবহাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক’