টাঙ্গুয়ার হাওরের শান্ত জলে এ যেন প্রশান্তিময় যাত্রা
টাঙ্গুয়ার হাওরের শান্ত জলে এ যেন প্রশান্তিময় যাত্রা

হাওরে হইচই

দমকা হাওয়ার তোড়ে ত্রিপলের এক পাশ উল্টে এসে মুখই ঢেকে দিল। বেঘোরে ঘুমালে কাঁথা ভেবে হয়তো ত্রিপলটা গায়ে জড়িয়ে নিতাম। আধো ঘুম বলেই ধড়ফড় করে উঠে বসি। নোঙর করা নৌকাটা বাতাসে দুলতে থাকে। ‘চোর, চোর’ শব্দে চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়, রীতিমতো বাড়িতে ডাকাত পড়ার মতো হইচই। মুহূর্তেই বুঝতে পারি, এ মনের চোর, আনন্দ করতেই পর্যটকদের সমবেত চিৎকার! আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, একটু আগের তারা জ্বলজ্বল আকাশে কালো মেঘের রাজত্ব। মাঝি-মাল্লারা আসন্ন ঝড় কিংবা বৃষ্টি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরা যে কজন নৌকার ছাদে ঘুমিয়েছিলাম, দুজন ছাড়া সবাই নিচে চলে গেল। নৌকার পাটাতনে বিছানা পাতা, দলের ১৪ জন সেখানেই ছিলেন। আমরা কয়েকজন আকাশের তারা গুনতে গুনতে গল্পে হারিয়েছিলাম।

হাওর ঘুরে টেকেরঘাটে ভিড়েছে পর্যটকবাহী নৌকা

সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাটে তখন প্রায় ২০০ নৌকা নোঙর করা। সুনামগঞ্জের শাহেব বাড়ির ঘাট, তাহিরপুর ঘাট, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেড়ে আসা নৌকাগুলো টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দুপুরের পর থেকে টেকেরঘাটে ভিড়েছে। শহীদ সিরাজ লেকে দুর্বার আড্ডায় সন্ধ্যা কাটিয়েছে পর্যটকেরা। রাত বাড়তেই নৌকাগুলো পর্যটকদের নিয়ে ঘাট ছেড়ে কিছুটা দূরত্বে নোঙর করে রাখে। রাতের এক প্রস্থ পর্যন্ত নৌকা নৌকায় গানের আসর বসল, কেউ করল আড্ডায় আনন্দ–উল্লাস, কোনো নৌকা থেকে ওড়াল ফানুস। দিনভর হাওরের জলে ঘুরে আসা পর্যটকেরা একসময় ঝিমিয়ে পড়ে। প্রদীপ হয়ে যেন জ্বলে একেকটা নৌকা। হাওরের জলের মতো নীরবতা নামে চারপাশে।

শহীদ সিরাজ লেকে সন্ধ্যা নামার মুহূর্ত

আমরা ছাদে শুয়ে দূর গ্রামে শিয়াল তাড়া করা কোনো কুকুরের ডাক শুনি। ওপাশে ভারতের সীমান্ত বাতির উজ্জ্বলতা বাড়ে, শহীদ সিরাজ লেকের জলে সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে। আকাশে তাকালে তারার পতন দেখি হরহামেশায়। প্রকৃতির নিজস্ব রূপ দেখতে দেখতে তন্দ্রায় যখন ডুবে গেলাম, তখনই ঝড়ের আভাস, ‘চোর, চোর’ চিৎকার।

হাওরে গিয়ে সাঁতার না কাটলে চলে!

যদিও শেষরাতে তর্জনগর্জনেই থেমে গেল ঝড়। প্রতীক্ষিত বৃষ্টিও নামল না। দিনের গুমোট গরম আরও বাড়ল। অবশ্য বৃষ্টি পাব না জেনেই হাওরে পা বাড়িয়েছিলাম। ভ্রমণ পরিকল্পনা যখন করি, তখন শরৎ শুরু হলেও প্রকৃতির চরিত্রে ছিল বর্ষার রূপ। বর্ষায় হাওরের প্রকৃতি শুধু পানিতে টইটম্বুর থাকে এমন নয়, থাকে আলাদা এক সৌন্দর্যও। কিন্তু ভাদ্র মাসের শেষ সময়ে হাওর কি তেমনটি থাকবে?

হাওর ভ্রমণে অভিজ্ঞ কেউ কেউ বলেছিলেন, থাকবে, থাকবে!

জাদুকাটার শীতল জলে

বিশেষজ্ঞ-মত মানতে অনাগ্রহ থাকলেও, অগ্রাহ্য করা যায় না! তার ওপর দীর্ঘদিন মনটা কেমন ‘পালাই, পালাই’ করছিল। ভ্রমণ ও পর্যটনবিষয়ক খবরাখবর, ছবি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে খোলা ফেসবুক গ্রুপ ‘ঘুরান্তিস’ থেকে দ্রুতই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গ্রুপের পক্ষ থেকে এবারই প্রথম দলেবলে ভ্রমণে যাওয়া। ১৮ জন ভ্রমণসঙ্গীদের মধ্যে কারও সঙ্গে রোজ দেখা হয়, কারও সঙ্গে বাসে উঠে প্রথম দেখা। এই চেনা, অল্প চেনা আর অচেনা মানুষেরা কলাবাগান থেকে বাসে ওঠার পরই হয়ে উঠল ‘আমরা’।

হাওরে ভাসতে ভাসতেই পেটপূজা

ভ্রমণ শেষে ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ফিরেও সবাই সবাইকে অনুভব করছি। মেসেঞ্জার গ্রুপে প্রত্যেকের খোঁজ নিচ্ছি। মুঠোফোনে তোলা ছবিতে ভেসে আসছে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছে সাঁতার কাটা গল্প, বারিক্কা টিলার নিচে বয়ে চলা জাদুকাটা নদীর জলে ডুব দেওয়ার চঞ্চলতা, সবুজাভ শিমুলবাগানের ক্ষণ। নির্মল আড্ডামুখর ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে, আরও কিছুটা সময় তো আমরা গান–গল্প আর আড্ডায় মশগুল থাকতে পারতাম। যেমনটা থেকেছি ভাদ্র মাসের রোদে পুড়ে, গরমে নাকাল হয়েও হাওরে ভাসার দুটি দিন।