বন্য প্রাণীর ছবি তুলতে সুন্দরবনে গিয়েছিলেন একদল আলোকচিত্রী। তিন দিনের সফরে বনের নানা প্রান্তে ঘুরেও বেঙ্গল টাইগারের দেখা পেলেন না। এরপর যেদিন ফিরে আসবেন, সেদিন শেষবেলায় স্বমহিমায় তাঁদের দেখা দিলেন তিনি। কেমন ছিল বনের রাজাকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা? লিখেছেন দলটির সদস্য আদনান হোসেন
সুন্দরবনে ছবি তুলতে যাচ্ছি পাঁচ বছর হলো। দিনের পর দিন কত প্রাণী-পাখির ছবি তো তুলেছি, কিন্তু বাঘের দেখা পাইনি কখনো। সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়াটা আসলে কপাল। অনেকে মজা করে বলেন, বাঘ যদি কারও সঙ্গে দেখা করে, তবেই দেখা পাওয়া সম্ভব! তাই বনে গেলে মনোবাসনা থাকত, একবার যদি তার দেখা পাই! একজন আলোকচিত্রী হিসেবে সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগারের ছবি তোলা যে স্বপ্নের মতো ব্যাপার।
বাঘের দেখা না পেয়ে কিছুটা হতাশাও চেপে বসে একসময়। কমে আসে সুন্দরবনে যাওয়া। এর মধ্যে শুরু হয় করোনা, জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি। করোনার পর সুন্দরবনে ভ্রমণে শুরু হলে ব্যয়ও বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে বনের প্রতি কেমন একটা অভিমান জমা হয়। ভেবেছিলাম, সুন্দরবনে আর যাবই না!
কিন্তু গত ১২ মার্চ অভিমান ভুলে নতুন করে সুন্দরবনে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে হলো। কারণ, বাঘের ছবি আর ভিডিওতে সেদিন সয়লাব হয়ে গিয়েছিল ফেসবুক। পর্যটকেরা একসঙ্গে ৫টি বাঘ দেখতে পেয়েছেন। অভিজ্ঞদের কেউ কেউ বলতে লাগল, সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়ার এখনই মোক্ষম সময়।
সুন্দরবনে একা ছবি তুলতে যাওয়া বেশ ব্যয়বহুল ব্যাপার। পর্যটকদের মতো ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফাররাও দলবদ্ধ হয়ে ছবি তুলতে যান। সমমনা ১২ জন একত্র হলাম, যার মধ্যে ছিলাম আমরা সাতজন আলোকচিত্রী। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁরা ঢাকায় এলেন। পরের গন্তব্য মোংলা।
আয়োজনের দায়িত্ব নিলেন ফেমাস বিডি ট্যুরের তানজির হোসেন, রুবেল নামেই যিনি বেশি পরিচিত। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আলোকচিত্রী ফরিদী নুমান জাহাজ ‘এমবি গাঙচিল’ ঠিক করলেন। ২৮ মার্চ রাত সাড়ে চারটায় সে জাহাজেই উঠে পড়লাম আমরা।
প্রথম দিনেই কচিখালী হয়ে ছিটা কটকায় যাওয়ার কথা ছিল। এখানেই পাঁচটি বাঘের দেখা পেয়েছিলেন পর্যটকেরা। কিন্তু যাত্রাপথের সমস্যার কারণে সেদিন যাওয়া হলো না। রাত কাটাতে হলো কচিখালীতে।
আমাদের মর্নিং কল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টা। এ সময়টায় বন্য প্রাণীর ছবি তোলার সুন্দর সময়। দ্বিতীয় দিন সকালে উঠতে দেরি হলো। পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হলো। সাড়ে ছয়টার দিকে ডিমের চরের দিকে চলে গেলাম। অনেকের ধারণা, ডিমের চরের ও দিকটায় বাঘ আছে। আগেরবার আমরা ডিমের চরে বাঘের গর্জনও শুনতে পেয়েছিলাম। চরের বেশ ভেতরে ঢুকে যাই। কিন্তু বাঘ তো দূর কি বাত, হরিণ আর বড় মোটা হাঁটু পাখি ছাড়া তেমন কোনো প্রাণী-পাখির দেখাই পেলাম না।
ডিমের চরের ব্যর্থ অভিযান শেষে কচিখালী অফিসপাড়ার একটা খালে ঢুকে পড়ি। কিছুদূর আসার পর বনমুরগি আর বনমোরগের দেখা পেলাম। তাদের ছবি তোলার জন্য অফিসপাড়ায় নেমে পড়লাম। তাদের ছবি তুলতে গিয়েই মিঠাপানির একটা পুকুরও দেখতে পেলাম। এসব পুকুরে বাঘ পানি খেতে আসে। মনে হলো, বাঘ মামা এদিকে আসতে পারে।
আমরা কচিখালী অফিসপাড়ার ছনের মাঠ হয়ে বের হই। কচিখালী অফিসপাড়ার ছনের মাঠকে বাঘদের ডাইনিং রুমও বলা যেতে পারে। অনেক তাজা পাগমার্ক (বাঘের পায়ের ছাপ) দেখলাম। দেরি না করে আমরা জাহাজের উদ্দেশে রওনা দিই। জাহাজে আসতে আসতে প্রায় সাড়ে ১১টা বেজে যায়। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মতো হাঁটার পর আমাদের সবার অবস্থা কাহিল। সেখান থেকে আমরা কচিখালী থেকে ছিটা কটকার দিকে রওনা হই।
কিন্তু দুঃসংবাদ হচ্ছে, ছিটা কটকায় দুই বছর পর গোলপাতা কাটার অনুমতি দিয়েছে বন বিভাগ। গোলপাতা কাটলে বনজীবীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। তাই বাঘের দেখা পাওয়ার সুযোগ অনেকটা ম্লান হয়ে গেল। সবার মুখে বিষণ্নতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। কেটে গেল দ্বিতীয় দিন।
অভিযানের তৃতীয় ও শেষ দিন ছিল ৩১ মার্চ। ঘড়ির কাঁটা যখন সকাল ছয়টা ছুঁই ছুঁই। ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়ি। দিনের শুরুটা হয় জামতলা সাপের খালে তিনটা গোক্ষুর গোখরার ছবি তুলে।
জামতলা ঘোরাঘুরি করতে করতেই সাড়ে ১২টা বেজে যায়। কিন্তু তখনো সকালের নাশতা হয়নি। খিদেয় কারও কারও অবস্থা কাহিল। জামতলা জেটি থেকে নৌকা ছেড়ে জাহাজের দিকে রওনা দিলাম। ছোট খাল থেকে বের হয়েই সমুদ্রের মোহনা। মোহনায় বাতাসের বিপরীতে নৌকা চালাতে বেগ পেতে হলো। পেটের ক্ষুধা আর সমুদ্রের ঢেউয়ে অনেকের যা-তা অবস্থা।
আগের দিন রাতের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দুপুরের পর কটকা অফিসপাড়ায় যাওয়ার কথা। সেখানেও বাঘের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্র উপকূলে অতিরিক্ত বাতাস থাকায় আমরা কটকা অফিসপাড়া থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরের দিকে চলে গেলাম।
সকালের নাশতা খেতে বসলাম দুপুরে। সিদ্ধান্ত হলো, বিকেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ব।
চারটায় ছোট নৌকায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এ-খাল ও-খাল পেরিয়ে নৌকা এল সুন্দরীখালে। সুন্দরীখালে ঢুকতেই বাঘের পাগমার্ক দেখলাম। পায়ের ছাপ দেখে ধারণা করলাম, ভাটার আগে একটি বাঘ পার হয়েছে। বাঘটি খালের ডান পাড় থেকে বাঁ পাড়ে গেছে।
আমরা সুন্দরীখালের ভেতরের দিকে যেতে থাকি। সবার দৃষ্টি সতর্ক। সুন্দরীখালে বেশ কিছু পাখি পাওয়া যায় কিন্তু বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিলল না। সূর্যটা পশ্চিমে পড়ে গিয়ে সোনালি রং ধারণ করেছে। ঘণ্টাখানেক পর আমাদের সফর শেষ হতে যাচ্ছে। কেন যেন এবার আমাদের মন বলছিল বাঘের দেখা পাব। পেলাম না ভেবে হতাশা চেপে বসল। নৌকায় বসে আছি। নৌকা এ খাল থেকে সে খালে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এরই মধ্যে সরু আরেকটি খালে (বাঘের নিরাপত্তার কারণে নামটি আর বললাম না) আমরা ঢুকে পড়লাম। খালে বাঁ দিকের চেয়ে ডান দিকে দিনের আলো ভালো পাওয়া যাচ্ছিল। পাখির ছবি তোলার জন্য আমরা বাঁ দিক দিয়ে না গিয়ে ডান দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি, রুবেল ভাই এবং ফরিদী ভাই নৌকার সামনে বসে আছি। দলের অন্যরাও চুপটি করে বসে। এরই মধ্যে আচমকা রুবেল ভাই চিৎকার করে উঠলেন, ‘বাঘ, বাঘ!’
সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল। খালের পাড়ে হেলে পড়া বাইনগাছের মোটা ডালে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন বাঘটি। তার ডেরায় এসেছি বলে কিছুটা বিরক্ত। মিনিট পাঁচেক আমরা চুপটি করে থাকলাম। তাকে বোঝাতে চাইলাম, আমরা আপনাকে বিরক্ত করব না! তিনি হয়তো বুঝতে পারলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে নির্ভার ভঙ্গিতে দুই পা ঝুলিয়ে বসে পড়লেন গাছের ডালে। কখন যেন বাঘের খুব কাছে চলে গিয়েছিল নৌকা। তারপর নিরাপদ দূরত্বে মাঝি নৌকা রাখলেন। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। মেমোরি কার্ড ভরে গেল, আরেকজনের কাছ থেকে একটি কার্ড নিলাম। সেই সঙ্গে আক্ষেপ, ভালো ক্যামেরাটা কেন জাহাজে রেখে এলাম!
যা–ই হোক, লক্ষ রাখছিলাম যেন আমাদের কারণে রাজামশাই বিরক্তি বোধ না করেন। গাঢ় হলুদ কালো ডোরাকাটা চকচকে শরীর নরম আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল তখন। একটু লেজ নাড়িয়ে আর রাজকীয় চাহনিতেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন যে এই বনের তিনিই রাজা।
ছবি তুলতে তুলতে এক ঘণ্টা কেটে গেল। বেলাও পড়ে এল। তখনো আমরা বাঘের মুখোমুখি। জোয়ার আসবে আসবে করছে। বসা বাঘ একসময় উঠে দাঁড়ায়। তার লেজ নাড়ানোর ভঙ্গি আমাদের মনে ভয় জাগায়। মূলত শিকার দেখলে এভাবেই লেজ নাড়াতে থাকে বাঘ। তবে কি আমরা কেউ তার লক্ষ্যবস্তু? ভাবতেই পারে, কত কাছে আমরা, চাইলেই আক্রমণ করতে পারে। তাই ঝুঁকি এড়াতে সেখান থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই। ‘মামা’ থেকে যান তার আস্তানায়।