বেড়ানো

যে শালবনকে অনেকে বলেন ‘উত্তরের সুন্দরবন’

কুয়াশামাখা সকালে সবে সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে। দিনাজপুর শহর থেকে বাসে উঠে বসলাম। ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়কে ঘণ্টাখানেক চলার পর নামলাম সিংড়া জাতীয় উদ্যানের দরজায়। হাঁটাপথে বনের ভেতর ঢুকতে হয়। বনে ঢুকতেই শাল-সেগুনসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালির ছায়া যেন স্বাগত জানাল। গাছের ছায়া ভেদ করে সকালের সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে গায়ে। ওদিকে ঝিঁঝি পোকার কোরাস। অবিরাম। ক্ষণে ক্ষণে কোকিল, ঘুঘু, টিয়া, শালিকসহ নানা জাতের পাখিও ডেকে উঠছিল।

সিংড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথ
ছবি: ছুটির দিনে

ছায়া সুনিবিড় পথে হাঁটার পর ছোটমতো একটা নদীর দেখা মিলল। সাইনবোর্ডে লেখা ‘নর্ত নদী’। ঠাকুরগাঁও জেলার টাঙ্গন নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে সিংড়া বনের মাঝ দিয়ে বীরগঞ্জের ঢেপা নদীতে মিশেছে নর্ত। শুকনা মৌসুমে তেমন পানি না থাকলেও ভরা বর্ষায় নদীটি যেন যৌবন ফিরে পায়। এখন নদীর চরে চিকচিক করছে সাদা বালু। কিছুদিন আগেও যেখানে শরতের মেঘেদের সঙ্গে মাথা দুলিয়ে নেচেছে শুভ্র কাশফুল, যার রেশ এখনো রয়ে গেছে।

বনে ঢুকতেই শাল-সেগুনসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালির ছায়া যেন স্বাগত জানাল

সিংড়া শালবনকে অনেকে বলেন ‘উত্তরের সুন্দরবন’। কেন বলেন, তার ব্যাখ্যা নেই! দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ভোগনগর ইউনিয়নের সিংড়া গ্রামে এই বনের অবস্থান। ২০১০ সালে বন বিভাগ সিংড়া শালবনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। এখন তাই মানুষের আনাগোনাও বেড়েছে।

ঘুরতে ঘুরতে বনের ঠিক মাঝবরাবর পৌঁছেছি ততক্ষণে। বনজুড়ে পাটের দড়ির মতো ঝুলে আছে একধরনের লতাগুল্ম। বনে জ্বালানি সংগ্রহ করতে আসা একজন জানালেন, এগুলোর নাম গিলা লতা, যা দেখে বনের কাল্পনিক রাজা টারজানের কথা মনে পড়ে গেল।

শালবনের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে নর্ত নদী

বনের মধ্যে পাড় বাঁধানো মাঝারি আকারের দুটো পুকুর। স্বচ্ছ নীলজলের এক পাশে শালগাছের ছায়া, অন্য পাশে সূর্যের আলো। পুকুর আর তার জল বনের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে অনেকটা। বনের ভেতর পাঁচ-সাত ফুট উচ্চতার অসংখ্য ঢিবি। প্রথমে মনে হলো ভেঙে পড়া গাছের গোড়া। কাছে যেতেই রহস্য উন্মোচিত হলো। নিখুঁতভাবে বানানো উইয়ের বসতি।

হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিমে বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি। সূর্য ততক্ষণে হেলে পড়েছে। বেশ বড়সড় একটি মাঠ। ফুটবলে মেতেছে জনা বিশেক কিশোর। চলছে হইহুল্লোড়। শালগাছের শাখা-প্রশাখায় মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের হইহুল্লোড়, চেঁচামেচি আর আনন্দ।

এখানে ১৩০টি সাঁওতাল পরিবারের বাস। মাঝারি আকারে নির্মিত সাঁওতালদের ঘরগুলো মাটির। কোনো কোনোটির মাটির দেয়ালে সাদা রঙের আলপনা। প্রকৃতির মতোই সহজ-সরল জীবন।

বনের ভেতর উইপোকার বসতি

একটি সাঁওতাল বাড়ির উঠোনে বসে ছিলেন রাকেশ মুরমু। তাঁর সঙ্গে কিছু সময় আড্ডায় কাটল। গল্পে গল্পে রাজেশ জানালেন, একসময় বন থেকে বিভিন্ন প্রাণী শিকার, ফলমূল সংগ্রহ করে খেতেন তাঁরা। এখন সবাই কৃষিকাজ করেন। ফসল ফলান। তাঁদের উৎপাদিত সবজিপণ্য বিভিন্ন জায়গার পাইকারেরা এসে নিয়ে যান। ভালোই আছেন তাঁরা।

বনে হাঁটতে হাঁটতেই দেখা মিলল একজন সাঁওতাল নারীর

সন্ধ্যার আগে সিংড়া বন ঘুরে ফিরছি শহরের সেই কোলাহল, গাড়ির হর্ন, যানজটে। আবার সেই হাঁটাপথ ধরে মহাসড়কে উঠলাম। পাখিদের কোলাহল কিছুটা কমলেও ঝিঁঝিরা ডাকছে অবিরত। মাঝেমধ্যে গা ছমছম করে উঠছে। হাঁটছি আর ভাবছি বনের গাছপালা, লতাগুল্ম, শিয়াল, বেজির সঙ্গে সাঁওতালদের কী গভীর মিতালি! নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় নানা উৎসব-আনন্দ তারা ভাগাভাগি করে বনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। চোখে ভাসছে সাঁওতাল কিশোরদের প্রাণচাঞ্চল্য, বন থেকে জ্বালানি নিয়ে ফিরছেন বিমলা মুরমু, উঠানে বসে মাছ কুটছেন তুরী হাসদা।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বিমানযোগে সরাসরি সৈয়দপুর। সেখান থেকে বাস কিংবা মাইক্রোবাসযোগে সোজা সিংড়া ফরেস্ট। এ ছাড়া ঢাকা থেকে রয়েছে এসি/নন-এসি বাস সার্ভিস। সরাসরি বীরগঞ্জ শহরে বাস থেকে নেমে বনে যাওয়া যাবে। ট্রেনেও যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সৈয়দপুর অথবা দিনাজপুরে নেমে তারপর বাসে বা ভাড়ার গাড়িতে সিংড়া ফরেস্টে যেতে পারেন।