সেই থেকে পূর্ব তিমুরে কুমির বড় শ্রদ্ধার

পূর্ব তিমুর ভ্রমণের ওপর এই লেখাটি প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র 'ছুটির দিনে'তে ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

আকাশ আর সমুদ্রের মিশেল
আকাশ আর সমুদ্রের মিশেল

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। সাগরে ডুবে যাচ্ছিল এক ছোট্ট ছেলে। এক কুমির তাকে পিঠে তুলে বাঁচায়। সেই থেকে ছেলেটিকে পিঠে নিয়েই পৃথিবীময় সাগর থেকে সাগরে ঘুরছে কুমিরটি। বছরের পর বছর। অতঃপর বৃদ্ধ কুমিরের যাওয়ার সময় হয়। পূর্ব তিমুরের এই অঞ্চলে এসে মারা যায় কুমিরটি। ছেলেটি নামল ডাঙায়। ততক্ষণে সে–ও পরিণত মানুষ, শুরু হলো এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস।...এই মিথ কিংবা এমন গল্পের কারণেই পূর্ব তিমুরে কুমির বড় শ্রদ্ধার প্রাণী। তিমুরি ভাষায় আবো (কুমির) মানে পূর্বপুরুষ।

ওই যে দূরে যিশুর ভাস্কর্য। আর পূর্ব তিমুরে এমন ঘরেই পূর্বপুরুষেরা রাখতেন সম্পদ

তিমুরে চার মানা!

গল্পটি শোনালেন পূর্ব তিমুরে কর্মরত ইউনিসেফের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের আরিফা শারমিন। রাজধানী দিলিতে সাগরের পাশে তাঁর চমৎকার বাংলো বাড়ি। ওই বাড়িতে বসেই শোনা। ঘর থেকেই সাগরের স্বচ্ছ নীল জল দৃষ্টিসীমানায়। আর সাগর যেন পাহাড়ের পাহারায়।

ওরে সুন্দর! শুধু কি নীল? এক সাগরের চাররঙা পানি—গাঢ় নীল, আকাশ নীল, বেগুনি, খয়েরি। সাগরের নিচের বালুর রঙের তারতম্যে নাকি পাল্টে যায় পানির রং। আর সৈকতে কালো, ধূসর পাথরের পাশাপাশি অসংখ্য অগণিত সাদা নুড়ি। সব মিলিয়ে যেন মনে হয় সৈকতে বিছানো ভেজিটেবল ডাই করা বাটিক প্রিন্টের চাদর!

ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে ইন্দোনেশিয়ার বালি। অতঃপর ঘণ্টা দুয়েকের বিমানযাত্রায় পূর্ব তিমুরের দিলি। আগেভাগে ভিসা নেওয়ার ঝক্কি নেই। তবে মাথাপিছু ৩০ মার্কিন ডলার আর আরিফা শারমিনের একখানা চিঠি নিয়ে অক্টোবরের শেষে ঢুকে গেলাম নতুন এক দেশ দেখতে আমরা চার বন্ধু।

একটা শহর, পুরোটাই সাগরপারে। এরা মাছ ধরেই জীবিকা চালায়। তারের মালায় গেঁথে কাঁচা মাছ তো বটেই, বিকেল থেকেই সৈকতে বিক্রি হয় নানা সামুদ্রিক মাছ ভাজা। নেই গায়ে গায়ে উঁচু উঁচু দালান, নেই যানজট, নেই কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে রাস্তায় অসংখ্য মানুষের হেঁটে চলা, নেই অহেতুক ভেঁপু। থাকবেই–বা কী করে? সব মিলিয়ে দেশের জনসংখ্যা ১২ লাখ!

মার্কিন ডলারেই লেনদেন। নিজেদের কিছু তিমুরি মুদ্রা আছে বটে। ভাংতি ফেরতে পাওয়া যায়। তবে নিজেদের ভাষা আছে, তেতুন। যেমন আরিফাকে দেখতাম দোকানে, রেস্তোরাঁয় বিক্রয়কর্মী মেয়েদের ‘মানা’, ‘মানা’ বলে ডাকে। পরে জানলাম তেতুন ভাষায় ‘মানা’ অর্থ বোন। যে তিনটি দিন ছিলাম, আমরাও পরস্পরকে মানা ডাকা শুরু করলাম। তবে তেতুন ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ভাষা চলে দেশটিতে।

তিমুরি কফির সুনাম অনেক

স্বাধীন পূর্ব তিমুর

পর্তুগালের উপনিবেশ থেকে মুক্তির প্রক্রিয়ার শুরুতে ইন্দোনেশিয়া দেশটি গ্রাস করতে চেয়েছিল। প্রায় দুই যুগ লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে দেশটির মানুষ। এখন চলছে দেশ গড়ার লড়াই। তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার বিদেশি মানুষের নিয়মিত আনাগোনা। ২০১২ পর্যন্ত সেখানে কাজ করেছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সদস্যরা। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যেমন হয়, এখানেও তেমনি ধনী-গরিবের ফারাক বিস্তর।

আরিফার গাড়িচালকই আমাদের পথপ্রদর্শক। তা সে পথের ধারের ডাবের শ্বাস কিংবা ভুট্টা পোড়া খাওয়াই হোক, তিমুরি হস্তশিল্পের খোলাবাজারে কাঠের কাজের অসাধারণ মুখোশের দামদর হোক, সাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে এমন নিরিবিলি রেস্তোরাঁয় বসে অপার্থিব সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে গলা ছেড়ে গান গাওয়া হোক—সেই তো ভরসা। নামটা বোধ হয় জেলারডো। আমরা নির্দ্বিধায় ডাকতে লাগলাম ‘রোনালদো’। ও একবারও শুধরে তো দিলই না বরং মিটিমিটি হাসে। কারণ কী? জানলাম ফুটবল দেখতে পাগল তিমুরবাসী। অতএব, কে হায় রোনালদো নাম শুধরে দিতে চায়!

যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খ্রিষ্টধর্মের, তাদের দেশে যিশুর ভাস্কর্য থাকবে না, তা কি হয়?

কুমির যেন তাদের পূর্বপুরুষ

যিশু কফি বাংলাদেশ

খ্রিষ্ট রাই নামে খোলা চত্বরের পাশের রাস্তায় রোববার ছুটির দিনে তরুণদের চলে আওয়াজ তুলে মোটরসাইকেলের দৌড়। এর মধ্যেই সাগরমুখী সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে দেখলাম সূর্য ডোবার পালা। দু-চারজন ভিনদেশি আর দিলিবাসীই যে শুধু এই অপরূপ দৃশ্য দেখলাম তা কিন্তু নয়, পাহাড়ের চূড়ায় দুই হাত প্রশস্ত করে প্রতিদিন এই অপরূপ দৃশ্য দেখেন যিশুর ভাস্কর্য। আঁধার নেমে এল, যিশুর ভাস্কর্যে আলোর খেলায় স্বপ্নিল এক পরিবেশ তৈরি হলো। নিচের চত্বরে তখন সংগীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে তরুণের দল। ঠিক এই সময় সবার তিমুরি কফি খাওয়ার ভীষণ তেষ্টা পেল। বালি থেকে শুনে এসেছি ইন্দোনেশিয়ার কফির তারিফ, কিন্তু তিমুরের কফির খ্যাতি ছিল অজানা। বাংলাদেশের মৌসুমি–নোমান দম্পতির দেওয়া তথ্যে আর মৌসুমির বানানো তিমুরি কফির কাপে চুমুক দিয়ে আমরা হুড়মুড় করে ছুটলাম কফি কেনার জন্য।

মাছ বিক্রি তাঁদের পেশা

ভালো লাগল আরিফার কারণে দু-চারজন বাংলাদেশিকে পেয়ে। কেউ আলমগীর বা ডা. রুহুলের মতো সাহায্য সংস্থায় কাজ করেন, কেউ মৌসুমি, নোমান বা রত্নার মতো ব্যবসা-বাণিজ্য করে জমিয়ে ফেলেছেন। ছেলে-মেয়েরা পড়ছে আন্তর্জাতিক মানের স্কুলে। তবে শিকড়টা বাংলাদেশেই। নয়তো তড়িঘড়ি করে আয়োজন করে এশিয়া কাপের ফাইনাল (বাংলাদেশ বনাম ভারত) দেখার জন্য সবাই মিলে নোমান–মৌসুমির বাড়ি হানা দিত না। মৌসুমির ছোট ছেলেটা ক্রিকেট খেলাই বোঝে না, বোঝে বাংলাদেশ। আমাদের উত্তেজনা দেখে দৌড়ে লাল–সবুজ মোমের রঙে ইংরেজিতে লিখে আনল ‘গো বাংলাদেশ’। সুদূর তিমুরে আমাদের উত্তেজনা অন্য আবেগে রূপ নিল।

তৈরি হচ্ছে হস্তশিল্প

তিমুরি প্রকৃতি

পাহাড়ের ওপরে বাঁশ বেত কাঠের অন্দরসজ্জায় আধুনিক রেস্তোরাঁ টিবার। তিমুরি খাবার থেকে শুরু করে ফরাসি, পর্তুগিজ, চীনা—বাদ নেই কিছু। নীল সমুদ্রের গর্জন, পাহাড়ের গাম্ভীর্য, হঠাৎ বারান্দায় উড়ে আসা পাখির ডাক ছাড়া নিঃশব্দ নিস্তব্ধতা উপভোগ আর স্মৃতির দেরাজ খুলে একেকবার একেকটা সময়কে সামনে এনে বন্ধুদের সঙ্গে চাপহীন আনন্দ–বেদনায় অবগাহন...এই চমৎকার পরিবেশ তিমুরেই বুঝি সম্ভব হলো। অবরিগাদা (তিমুরি ভাষায় ধন্যবাদ) বন্ধুরা!

সন্ধ্যায় সমুদ্রসৈকতে

লড়াকু কবি

স্বাধীন পূর্ব তিমুরের প্রথম প্রেসিডেন্ট জানানা গুসমাওয়ের। পরবর্তীকালে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। লড়াইয়ের সময় জানানা অবিসংবাদিত জননেতা হয়ে ওঠেন। কারাবাস আর কবিতা লেখা চলে, একই সঙ্গে তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে দেশ। হাজার মাইল দূরের এই লড়াকু কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন আমাদের দেশের প্রয়াত প্রধান কবি শামসুর রাহমান। পড়ে দেখি আবার সেই শ্রদ্ধার কুমির—

পিতামহ কুমির

লোককাহিনি বলে এবং

আমি কে অবিশ্বাস করার!

সূর্য সমুদ্রের বেশ কিছু উঁচুতে আসন পেতে

চোখ মেলে ছিল

এবং ওর কিরণমালা দিয়ে

ঠিক করেছিল একটি পথের দিশা

সমুদ্রের গভীরতা থেকে একটি কুমির

নিয়মিত সন্ধানে জলের গভীরতা ছেড়ে আলো দেখে

ভেসে উঠল

তারপর ক্লান্তিতে নিজেকে ছড়িয়ে দিল সে

এবং ওর তরঙ্গিত চর্ম

রূপান্তরিত হলো পর্বতমালায়

যেখানে মানুষ বংশানুক্রমে

জন্মগ্রহণ এবং মৃত্যুবরণ করত

—উপকথা অনুসারে

সে যে তিমুর

এ কথা অবিশ্বাস করার আমি কে!

পাহাড়ের পাহারায় সমুদ্র। পূর্ব তিমুরের দিলিতে