অনেক দিন ধরেই যাব যাব করছিলাম, কিন্তু হয়ে উঠছিল না। ওই যে কথায় বলে, মক্কার মানুষ নাকি হজ পায় না—আমাদেরও হলো সেই অবস্থা। ইউরোপ-আমেরিকায় হরহামেশা যাচ্ছিলাম, কিন্তু ভুটান যাওয়া হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত নওরোজের (ছুটি ডটকম) বদৌলতে আমরা ১০ জন মিলে রওনা দিলাম বজ্র ড্রাগনের দেশে।
ছোট প্লেনে চড়তে যে একটু ভয় পাই, এটা আমার পরিচিত অনেকেরই জানা, এ নিয়ে বন্ধুবান্ধবের মধ্যে হাসাহাসিও হয়। তা পড়বি তোর পড় মালির ঘাড়ে। চড়লাম গিয়ে ড্রুক এয়ারের ছোট্ট একটি উড়োজাহাজে। পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার আগে দুটি বড় ঝাঁকি প্রমাণ করে দিল, বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিমানবন্দরগুলোর একটি হিসেবে পারো বিমানবন্দরের সুনাম। সব মিলিয়ে বোধ হয় পৃথিবীজুড়ে ১১ জন পাইলট এই বিমানবন্দরে নিরাপদে উড়োজাহাজ অবতরণ করাতে পারেন। আমাদের পাইলটও পারলেন।
উড়োজাহাজ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে বুক ভরে নিশ্বাস নিতেই বুঝে গেলাম, ভ্রমণটা একেবারে মন্দ হবে না। আর কিছু না হোক, বুকভর্তি অক্সিজেন নিয়ে ফেরা যাবে।
যা হোক, বেশ তাড়াতাড়ি ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ আর ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই প্রায় ভুলতে বসেছিলাম ভুটানে এসেছি; মনে হচ্ছিল সুইজারল্যান্ডের কোনো ছোট্ট পাহাড়ি শহরের পথে আমরা। কী যে সুন্দর সেই দৃশ্য, একদিকে পাহাড় আরেক দিকে কুলকুল বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। নদী আর পথ হাত–ধরাধরি করে বিকেলবেলায় আমাদের পৌঁছে দিল থিম্পুতে। একদম থিম্পু শহরের বুকে আমাদের হোটেল। ছিমছাম, মাঝারি আকারের একটি হোটেল। সেখানকার মানুষগুলো ভীষণ ভালো। সবাই যেন অতিথিদের একটু সাহায্য করতে পারলে বর্তে যায়। কিন্তু কোনো কিছুতেই খুব বেশি বাড়াবাড়ি নেই। একটি সম্মানজনক দূরত্ব সবাই বজায় রেখে চলে।
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, কিন্তু রুমে গিয়ে জানালার পর্দা সরাতেই আক্কেলগুড়ুম। একটু চোখ তুললে প্রথমে রাস্তা, তারপর মাঠ, আর তারপরই বাহারি রঙের পাহাড়। সূর্যটা ততক্ষণে পাহাড়ের ওপর নেমে এসেছে, আর পাহাড়ের ওপর রং ছড়াচ্ছে। জানালা থেকে তাকালে হঠাৎ মনে হয় যেন জলরং। ভেবেছিলাম চায়ে চুমুক দিয়ে শহরটা দেখতে বেরোব, কিন্তু জানালার পাশ থেকে উঠতেই পারছি না। পরে কানিজ আপা (পারসোনার পরিচালক কানিজ আলমাস খান) এসে জোর করে উঠিয়ে গাড়িতে তুললেন। হাই তুলতে তুলতে আর আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে গিয়ে পৌঁছালাম থিম্পু শহরের মধ্যখানে।
ছোট্ট শহর, চারদিকে পোশাক আর গয়নার ছোট ছোট দোকান, আর হঠাৎ মাঝারি সাইজের ক্যাফে। বাইরে থেকে আটপৌরে দেখতে হলেও ভেতরে ঢুকে কফি পেস্ট্রি খেয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বিজলিবাতির একটু সমস্যা পরিলক্ষিত হলো। শুনলাম, যা উৎপাদন করে তার সবটুকুই নাকি রপ্তানি করে দেয়, তাই এই সমস্যা।
সন্ধ্যা নামতেই বেশ একটা ঠান্ডা একদম গায়ের ওপর এসে পড়ল, তার জন্য অবশ্য মোটামুটি ব্যবস্থা নেওয়াই ছিল। এরপরও বাংলাদেশের হিসেবে অক্টোবর মাসে এমন আবহাওয়া, একটু নতুন তো বটেই। রাতে হোটেলে ফিরে হোটেলেই খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। কারণ, পরদিন সকাল সকাল আবার পুনাখার পথে রওনা দিতে হবে।
পুনাখার পথে
আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে পুনাখার পথে এগোচ্ছি। মনে হচ্ছে একটু একটু করে ওপরে উঠছি। গাইডকে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, একটু ওপরেই উঠছি বটে, পথে আমরা দোচুলা পাসে থামব। দোচুলা পাস পৌঁছেই মেঘের সঙ্গে দেখা। কনকনে ঠান্ডায় মেঘের সঙ্গে আলাপ–গপ্প শেষ করে আবার পুনাখার পথে যাত্রা। সব মিলিয়ে চার ঘণ্টা পর পুনাখা পৌঁছালাম।
পুনাখায় এসে উঠলাম পুনাতাংশু রিভার সাইড রিসোর্ট বলে একটি রিসোর্টে। রিসোর্টটা শহর থেকে একটু বাইরে। অভ্যর্থনার কাজ সেরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম বয়ে চলা সবুজে-নীল ন দীটা দেখে। একদম নদীর গা ঘেঁষে আমাদের রিসোর্টটা। সুইটি (অভিনয়শিল্পী তানভীন সুইটি), দিশা, ফিমা ঘরে না ঢুকেই নেমে পড়ল ছবি তোলার কাজে। কাউকে আর ঘরেই নেওয়া যাচ্ছে না। নদীর পাড়ে বসেই চা-নাশতা খাওয়া হলো। আসলে এই প্রথম আমরা সবাই নিজেদের জীবনে ব্যক্তিগত নদী পেলাম।
সাধারণত ভুটানের খাওয়াদাওয়া আমাকে খুব মুগ্ধ করেনি, কিন্তু এই রিসোর্টের রাতের খাওয়াটা আমাদের বেশ লাগল। সবুজ ভাই তো ঘোষণাই দিয়ে ফেললেন, ‘ওয়ার্ল্ডের বেস্ট খাবার।’ বুঝলাম, আগের দুদিনের বিস্বাদ খাবারের পর ভদ্রলোক মুগ্ধ হওয়ার জন্য বসেই ছিলেন। সকালবেলা ঘুম ভেঙে ঘরের দরজা খুলতেই সেই ব্যক্তিগত নদী। সকালের দিকে রংটা নীলচে থাকে, আর বিকেল হতে হতে নীলচে-সবুজ হয়ে যায়—আজব ব্যাপার।
ঢাকার এই কোলাহল আর ব্যস্ততা ছেড়ে এই নদীর পাড়ে এসে আসলেই কেমন যেন থমকে গেল ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা। বাকি সবাই বেরিয়ে পড়ল পুনাখা জং আর শহর দেখার কাজে, কিন্তু আমার আর যেতে মন চাইল না। সারা দিন ওই নদীর পাড়ে কাটিয়ে দিলাম, পুরো রিসোর্ট সুনসান। একটু লেখালেখি চলল, সঙ্গে গরম-গরম মসলা চা আর দারুণ সব গান। শরীর, মাথা আর মন সব থামিয়ে দিয়ে একটু পিছে ফিরে তাকালাম, যন্ত্র হতে থাকা মানুষটাকে একটু মানুষের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা হলো, আর কিচ্ছু না করার মতো কঠিন কাজটা একটু করে ফেললাম। বিকেলবেলা সবাই ফেরার পর আবার আড্ডা, ছবি তোলা আর হেঁড়ে গলায় গান। এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না...!
পারো পর্ব
পুনাখা ঘুরে আবারও থিম্পুতে শুধু রাতটা কাটানো। পরদিন পারো। অদ্ভুত একটি ঝকঝকে শহর পারো। এই শহরেও আমাদের রিসোর্টটা নদীর পাড়ে। নাম ‘কিছু রিসোর্ট’। আজব একটা নাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছিল। গাইড আমাদের খাওয়ার কষ্ট দেখে বললেন, ‘আজ তোমাদের একটা দারুণ জায়গায় খাওয়াতে নিয়ে যাব।’ আমরা খুব উৎসাহী হয়ে চললাম তাঁর সঙ্গে। এরপর নিয়ে গেল একটি পুরোনো বাড়ির মতো জায়গায়, বাইরে একটা হারলি ডেভিডসন মোটরসাইকেল পার্ক করে রাখা। কিন্তু রেস্তোরাঁটি কোথায় তা বুঝতে পারছি না। একটু ভেতরে ঢুকতেই দেখি বেশ কয়েকটি টেবিল-চেয়ার সাজানো। এবার মনে হলো খালি পেটে বোধ হয় ফেরত যেতে হবে না।
ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, বাড়িটি যে নারীর, তিনিই শেফ। তাঁর হাতের রান্না খাওয়ার পর পাগল হয়ে গেলাম। শেষে এসে জানতে পারলাম, তিনি হচ্ছেন পারো শহরের বিখ্যাত শেফ। বিভিন্ন বিখ্যাত অনুষ্ঠানে তাঁকে ভাড়া করে রান্না করতে নিয়ে যাওয়া হয়। পেট খুশ তো দুনিয়ে খুশ—ব্যস, পেট খুশ করে পারো ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা ছেলেরা যা–ই পরিকল্পনা করি না কেন, মেয়েরা পড়ে রইল গয়না আর সাজসজ্জার দোকানে। রাজর্ষি, আমার ছেলে, কাঁধে করে ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল, সেই ক্যামেরা সে যেদিকেই ধরে, সেদিকেই অপার সৌন্দর্য। আর অদ্ভুত সভ্য ভুটানিজরা। রাস্তা পার হওয়ার জন্য যদি ভুল করে পথে নেমেও পড়েন, গাড়ি থেমে যায় মানুষের জন্য, কারণ ওরা জানে মানুষের জন্য গাড়ি, গাড়ির জন্য মানুষ নয়।
সাত দিনের ভ্রমণ শেষ করে বুকভরা অক্সিজেন আর মাথাভর্তি মানবিক ভাবনা নিয়ে যখন ড্রুক এয়ারের বড় উড়োজাহাজে উঠছি, তখন আমি যেন এক নতুন মানুষ, মানুষের প্রতি আমার নবায়িত নতুন বিশ্বাস নিয়ে দেশে ফিরে আসা। পৃথিবীতে মানুষের জন্য, সভ্যতার জন্য আশা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। মানুষের জয় হোক, মানবতার জয় হোক।
সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন: গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশের প্রধান