ছবি: লেখক
ছবি: লেখক

নীলডুমুর: এপারে জলের জীবন, ওপারে বনের!

নীলডুমুর সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার একদম শেষবিন্দু, যার পর আর মানুষের বসতি নেই। নির্দিষ্ট করে বললে, সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জে নীলডুমুরের অবস্থান। সেখানে আছে ছোট ছোট নদী বা খাল, ওপারে সুন্দরী সুন্দরবন। আজ সুন্দরবনের গল্প নয়, বলব নীলডুমুরের মানুষের জলের জীবন নিয়ে, যেখানে প্রতিটি জীবন, প্রতিটি পরিবার, তাদের প্রতিটি মুহূর্ত পানির সঙ্গে ভেসে চলা যেন! যাকে বলা যায়, ‘জলের জীবন’। তাই আমি নাম দিয়েছি নীলডুমুরের জলের জীবন।

নীলডুমুরের যেখানে যত দূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি

এখানে, এই নীলডুমুরের যেখানে যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি, ছোট ছোট জলাভূমি দিয়ে সাজানো পুরো নীলডুমুর। কারণ, এটা দেশের অন্যতম চিংড়ি রপ্তানি অঞ্চল। এখানের অন্যতম অর্থনৈতিক উৎস হলো চিংড়ি। তাই চারদিকে যত দূর চোখ যায় শুধু চিংড়ি ঘের আর চিংড়ি ঘের। ছোট, বড় বা মাঝারি, নানা আকারের চিংড়ি ঘের দিয়ে নীলডুমুর নিজেকে আলাদা করে রেখেছে।

এই পুরো এলাকায় উৎপন্ন হয় নোনা জলের মাছ, বিশেষত চিংড়ি। এখানে যাদের বসবাস, এখানে যাদের জীবিকা, তারা জলবন্দী। অন্তত যতটা সময় এখানে কেউ বসবাস করে, ততটা সময় তারা জলজ জীবনে বন্দী হয়ে যায়। এখানে যাদের স্থায়ী বসবাস, তাদের কথা বলাই বাহুল্য, তাদের জীবন হয়ে ওঠে জলে ভেসে থাকা কচুরিপানার মতো! সে জন্যই নীলডুমুরের মানুষের জীবন জলের জীবন। আরও বিশদে বললে, নোনা জলের জীবন।

শরতের নীল আকাশ, বুরিগয়ালিনী রেঞ্জ

এখানে যারা বসবাস করে, এখানে যাদের বাড়ি, এখানে যাদের সাময়িক বা স্থায়ী আবাস, তাদের যে ঘর, যে বাড়ি, যে থাকার জায়গা, তার চারপাশে শুধু পানি আর পানি। ঠিক বসবাসের জায়গাটুকু ছাড়া চারপাশে শুধুই পানি, চিংড়ির ঘের—ছোট, বড় আর মাঝারি। কোনো কোনোটা আবার বিশাল। যত দূর চোখ যায় শুধু চিংড়ি ঘের, একেকটা ঘেরের মাঝে ছোট ছোট পায়ে চলার আলপথ। আর পথের ধারে কাঠের, গোলপাতার, টিনের ঘরবাড়ি। যে বাড়িগুলোর সঙ্গেই গায়ে গায়ে লেগে আছে নানা রকমের চিংড়ির ঘের।

এখানে ঘর থেকে বের হওয়া মানেই জলের মাঝে নিজেকে সঁপে দেওয়া। আমাদের মতো এক বেলার পর্যটকদের কাছে দেখতে মজার আর উপভোগ্য হলেও আসলে নীলডুমুরের জীবন অতটা আনন্দের বা সুখের নয়। আমাদের অভ্যস্ত জীবনের ঝাঁচকচকে আয়োজন এখানে নেই। হাত বাড়ালেই সবকিছু মুঠোয় ভরে ফেলার বিলাসিতা এখানে স্বপ্নেরও বাইরে। চারদিকে যত দূর চোখ যায়, তত দূরই দেখা যাবে নিস্তরঙ্গ নোনা পানি। আমরা যারা ফোর লেন হাইওয়ে দেখে অভ্যস্ত, তাদের কাছে নীলডুমুরের সরু সরু আলের মতো রাস্তাগুলো তরুণীর চুল বাঁধা ফিতা ছাড়া অন্য কিছু মনে হবে না। নীলডুমুরের ঘেরের ভেতর দিয়ে যাওয়া এই সরু ফিতার মতো পথ ধরে মোটরবাইক কিংবা ছোট ছোট বাহন নিয়ে চলে যাওয়া যায় মুন্সিগঞ্জ, নীলডুমুরের শহরতলি বলা যায় যাকে। শ্যামনগর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার।

সুন্দরবনের শুরু, মুন্সিগঞ্জ

আর উল্টো দিকে সরু পথের শেষে আমাদের দেশের অন্যতম বড় সম্পদ, আমাদের দেশকে রক্ষাকারী বিশাল সুন্দরবনের শুরু। মাঝারি নদীর মতো বড় খালের ওপারেই সবুজ সুন্দরী সেই বনভূমি। খালের এপারে যদি হয় জলের জীবন, তবে ওপারে শুরু হয় বনের জীবন। খাল পার হলেই বন্য মাদকতাময় জীবন, সেটা বনদস্যু, বনের পশু বা বনের নিজের জন্যও। খালের ওপারে কোনো বসতি নেই, সাধারণ মানুষের বিচরণ নেই, কোনো স্থাপনা নেই, নগর জীবনের ব্যস্ততা নেই, ইঁদুর দৌড় নেই। খালের ওপারে সুন্দরবন, যার সুন্দরের কোনো শেষ নেই, যার রহস্য, রোমাঞ্চ প্রতিটি পদক্ষেপে; যার সৌন্দর্য আর আনন্দ অপার, অপরিসীম, বন্য পশু, নানা রকম পাখি, সরীসৃপ, গোলপাতা, ফলমূল, মধু, মাছ, বৃক্ষলতাগুল্মসহ নানা রকম প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা। সে সম্পদশালী সুন্দরবনে আছে বিশুদ্ধ বন্য জীবন, সত্যিকারের ঘন, সবুজ, প্রাকৃতিক বন, যেখানে দাঁড়ালেই ফুসফুস ভরে ওঠে বিশুদ্ধ অক্সিজেনে।

বন রক্ষায়, হয়তো বনের গভীরে বনপ্রহরীদের সাময়িক আবাস আছে, তবে সেগুলো সাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। সুন্দরবন, তাই আমার কাছে মনে হয়, এটাই আমাদের একমাত্র বন, যেটা সত্যিকারের বন, যেখানে সত্যিকারের বন্যতা খুঁজে পাওয়া যায়, রোমাঞ্চ নিয়ে উপভোগ করা যায়, আর স্মৃতির অ্যালবামে অমলিন অনেক অনেক কিছু জমিয়ে রাখা যায় সুন্দরবন দেখে, সুন্দরবন ঘুরে, সুন্দরবন উপভোগ করে।

নীলডুমুরের খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে সুন্দরবনের রোমাঞ্চকর জীবনের কথা ভাবা যায়

নীলডুমুরের খালের পাড়ে, জলের জীবনে দাঁড়িয়ে, ওপারের সুন্দরবনের রোমাঞ্চকর বনের জীবনের কথা ভেবে ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম আর মনে মনে এই লেখাটার কথা সেদিনই ভেবে রেখেছিলাম—নীলডুমুর, এপারে জলের জীবন, ওপারে বনের!