অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে সজ্জিত সুচতুর কমান্ডো খুব সংগোপনে এগিয়ে চলেছে পাথুরে রাস্তা ধরে। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। কোথাও কোনো সবুজ নেই। হঠাৎ অনুচ্চ কোনো ধূসর পাহাড়ের চূড়া থেকে শত্রুঘাঁটির অবস্থান বোঝা গেল। বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে কমান্ডো নিশ্চিত হয়ে নিল শত্রুঘাঁটির অবস্থান। সেই সঙ্গে দেখে নিল চারদিক। কয়েকটা ঝাউগাছ, দু–একটা পাটা ঝোপ, নাম না–জানা ফুলগাছ সবুজ ছড়িয়ে যাচ্ছে সেখানে। কমান্ডো তার স্নাইপার গান তাক করল।
কম্পিউটারে খেলা কমান্ডো গেমের এই দৃশ্যের সঙ্গে ভারতের জম্বু-কাশ্মীর রাজ্যের লেহ্ অঞ্চলের কিছুটা মিল আছে। এখানেও আছে সবুজহীন ধূসর অনুচ্চ পাহাড়, পাথুরে রাস্তা। এমন প্রতিকূল পরিবেশ পার হয়ে আপনি যখন তুরতুক নামে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের শেষ গ্রামটিতে উপস্থিত হবেন, তখন পাবেন প্রাণ মাতানো সবুজের ছোঁয়া। তখন আপনি ক্যামেরার লেন্স তাক করতে পারেন ধূসর পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে থাকা নাম না জানা ফুলের দিকে।
নুব্রা থেকে তুরতুক যাওয়ার পুরো পথে একবারের জন্যও কোথাও সবুজের দেখা পাইনি। মাঝে একবার পাহাড় থেকে বেশ সমতলে নেমে যাওয়ায় হুট করেই এক চিলতে সবুজ চোখে পড়েছিল কোথায় যেন। এরপর আবার সেই ধূসর রুক্ষ পাহাড়, ঝুরো মাটির দেয়াল, গোঙানো নদী, অসহ্য শীত, ঢুঁ ঢুঁ প্রান্তর, পাথর ছুটে আসা ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি পথ। ভেবেছিলাম তুরতুকও এমনই হবে—কোথাও সবুজের কোনো চিহ্ন নেই, চারদিকেই শুধু রুক্ষতা আর রুক্ষতা। কিন্তু তুরতুক পৌঁছে যা দেখলাম এক পলকে, আমার মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল—এ যে বিধাতার আশীর্বাদ!
এই গ্রামের অবস্থান আমাদের বাংলাদেশ থেকে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরে! শুধু ভারতের লেহ শহর থেকেই এই গ্রামের দূরত্ব ২০৫ কিলোমিটার! যেতে সময় লাগে আট থেকে নয় ঘণ্টা। তিন হাজারজনের চেয়ে কিছু বেশি মানুষের বসবাস এই গ্রামে। তুরতুকের গ্রামের চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। সেসব পাহাড়ে কোথাও নেই গাছ, ঘাস বা সবুজের এতটুকু ছোঁয়া। চারপাশের পাহাড়গুলো কোনোটি পাথুরে, কোনোটি মাটির, কোনোটি বরফের, কোনোটি ইস্পাতের মতো কঠিন। শুধু অদ্ভুতভাবে এই তুরতুক নামের গ্রামটির সবটুকুই সবুজে মোড়ানো! বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদ ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তুরতুক ভারতের জম্বু-কাশ্মীর রাজ্যের লেহ জেলার নুব্রা তেহসিলের অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রাম এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেনাঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। আনুষ্ঠানিকভাবে এই পথে ভারত-পাকিস্তানে চলাচলের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখান থেকে পাকিস্তান সীমান্ত মাত্র আট কিলোমিটার দূরে।
তুরতুক গ্রামে ধান থেকে শুরু করে গম, জব, আলু, কপিসহ অন্যান্য তরকারি, আপেলসহ নানা রকম ফলমূলের চাষ হয় নিয়মিত। নানা রকম ফুল, পাথুরে বাড়ি, ঝরনার বিশুদ্ধ পানি সবই আছে এখানে। আছে উত্তাল, খরস্রোতা সায়ক নদ। গায়ে গায়ে লেপটে থাকা পাহাড়ের সারি, পাহাড় থেকে বয়ে চলা ঝরনা, ঝিরি ও নদী। এই গ্রামের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই গ্রামের বাইরের পাহাড়গুলো যখন বরফে মোড়ানো থাকে, তখন এখানে বরফ পড়লেও সেটা জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার মতো খুব বেশি নয়। এখানে বরফ পড়ে ঠিকই, কিন্তু একটু রোদের পরশ পেলেই সেই বরফ দ্রুত গলে জল হয়ে পাশের সায়ক নদে চলে যায়।
তুরতুকের সব ঘরবাড়িই পাথরের। শুধু পার্থক্য এই যে যাদের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো, তারা পাথর সাইজ মতো করে কেটে নিয়ে কিছু সিমেন্টের ব্যবহার করে সাজানো বাড়ি বানাতে পারে। আর যাদের সেই অবস্থা নেই, তারা নিজেদের মতো করে পাথর সংগ্রহ করে একটার পর একটা বসিয়ে দেয়, কখনো নদীর কাদার সাহায্যে বা শুধু পাথরের স্তূপ সাজিয়েই বানিয়ে ফেলে বসবাসের জন্য আস্ত ঘর বা বাড়ি!
পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু বোঝা গেল, এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীই যথেষ্ট দরিদ্র। প্রকৃতির দান, ট্যুরিস্টদের যাওয়া–আসা তাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে। একদম সাদামাটা জীবন তুরতুকের মানুষের। যদিও সেখানে আছে বিদ্যুৎ, টিভি, ডিশের সংযোগসহ আর নানা রকম সুযোগ। এমনকি আছে মোবাইলও! তবে সবকিছু মিলে তারা খুবই দরিদ্র আর অবহেলিত একটি প্রায় বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। যেখানে প্রকৃতি ভীষণ উদার, বিধাতা ভীষণ আবেগপ্রবণ আর মানুষ সবাই খুব সাধারণ।
তবে এই গ্রামের যারা একটু অবস্থা সম্পন্ন বা যাদের নিজেদের থাকার ঘর ছাড়াও আছে দু-একটি বেশি বা তার চেয়ে বেশি কক্ষ, সেগুলো তারা ট্যুরিস্টদের জন্য ভাড়া দিয়ে থাকে হোমস্টে হিসেবে। যেখানে একদম কোলাহলমুক্ত একটি দিন বা রাত কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে নিশ্চিন্তে। এই হোমস্টের ব্যবসা এখানকার মানুষের অর্থ উপার্জনের বড় জায়গা। তুরতুকে থাকার পাশাপাশি ট্যুরিস্টদের জন্য আছে কিছু খাবার হোটেলও। যেখানে বেশ সহনীয় মূল্যে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকম পছন্দের খাবার, ভ্রমণকারীদের ফরমাশের ভিত্তিতে।
তুরতুকে যাওয়া-আসা ও থাকা–খাওয়া
তুরতুকে যেতে হলে এই গ্রামের প্রকৃতি, নীরবতা, ব্যতিক্রমী জীবনযাত্রা, একেবারে সাধারণ মানুষের গ্রামীণ জীবনের সান্নিধ্য পেতে হলে আপনাকে বেশ রোমাঞ্চপ্রিয় হতে হবে। সেখানে সরাসরি প্লেনে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই পরিবেশগত কারণে। তবুও মোটামুটি কম কষ্টে একটু বেশি খরচে আর একদম কম খরচে কিন্তু দারুণ রোমাঞ্চকরভাবে তুরতুকে যাওয়ার উপায় বলে দিচ্ছি।
ঢাকা থেকে প্লেনে যেতে পারেন দিল্লি। দিল্লি থেকে লেহ্ প্লেনে। এ ছাড়া যেতে পারেন ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে কলকাতা। কলকাতা থেকে ট্রেনে দিল্লি। সেখান থেকে শ্রীনগর বা মানালি হয়ে বাসে বা রিজার্ভ জিপে (দলগত ভ্রমণ হলে) করে লেহ্ শহরে। দিল্লি থেকে সড়ক পথে লেহ্ যেতে সময় লাগবে অন্তত তিন দিন! দুই জায়গায় রাতে থাকতে হবে, শ্রীনগর বা মানালিতে এক রাত আর লেহ্ যেতে পথে আর এক রাত। রাতে মানালি বা শ্রীনগরে থাকা ও খাওয়ার খরচ নির্ভর করবে আপনার রুচি আর মানসিকতার ওপর। তবে এই রাস্তায় যেতে হলে বেশ কিছু ঝুঁকির ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। যেমন অধিক উচ্চতাজনিত সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, ঘুমহীনতা, মাথাব্যথা, বমি ভাব, ক্ষুধা কমে যাওয়া, বিষণ্ন লাগা, এমন বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সে জন্য দরকারি ওষুধ সঙ্গে রাখা জরুরি। তবে হ্যাঁ, এই পথে যদি লেহ্ শহর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারেন, সেটা হবে সারা জীবনের এক সেরা অর্জন সবার জন্য। শুধু গেলেই বুঝতে পারবেন। পৃথিবী কত ভয়ানক সুন্দর! এ পথে যাত্রা আমার জীবনের স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে আছে এবং থাকবে।
লেহ্ শহরে পৌঁছে এক দিন অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে লম্বা জার্নির ধকল সামলে নিতে, আমরাও যেমন নিয়েছিলাম। এরপর নিতে হবে নুব্রা ভ্যালি হয়ে তুরতুক যাওয়ার বিশেষ অনুমোদন। সঙ্গে দিতে হবে মূল পাসপোর্ট। এরপর গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে। নুব্রা ভ্যালি হয়ে তুরতুক ২০৫ কিলোমিটার, সময় লাগবে ৮–৯ ঘণ্টা। ভয়ানক, পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যেতে হবে অনেক অনেক, সঙ্গে খরস্রোতা নদী পেরোতে হবে অনেক বার। নুব্রাতে গিয়ে পুলিশ স্টেশনে অনুমোদন দেখিয়ে নতুন অনুমোদনর জন্য দিতে হবে পাসপোর্টের ফটোকপি, জানাতে হবে কোথায় থাকছেন রাতে। এরপর যেতে পারবেন তুরতুক।
তুরতুকে থাকার খরচ খুব বেশি নয়, সাধ্যের মধ্যেই পাবেন সবকিছু।
লেহ্ যাওয়ার আদর্শ সময় মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস। এরপর তুষারপাতের কারণে বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় লেহ্। সে কারণে সেপ্টেম্বরের পর লেহ্ যাওয়ার অনুমতি দেয় না ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। যাঁরা যেতে চান এই ভয়ংকর সুন্দর প্রকৃতি দেখতে, তাঁরা সামনের ঈদের দীর্ঘ ছুটিকে কাজে লাগাতে পারেন।