তাজমহল: শ্বেতপাথরে লুকিয়ে থাকা অশ্রু

যমুনা নদী থেকে দেখা তাজমহল। ছবি: উইলিয়াম বাটলার, দ্য ল্যান্ড অব ডিভা, নিউইয়র্ক, ১৮৯৫।
যমুনা নদী থেকে দেখা তাজমহল। ছবি: উইলিয়াম বাটলার, দ্য ল্যান্ড অব ডিভা, নিউইয়র্ক, ১৮৯৫।

জুন মাসের ১৭ তারিখ, সন্তান প্রসবের পর তরতাজা রক্তের বন্যায় ভেসে যেতে যেতে একটু আগেই মারা গেলেন মাত্র ৩৮ বছর বয়সী রাজমহিষী আরজুমান্দ বানু বেগম। কদিন থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। আগ্রা থেকে হাতির পিঠে দুর্গম পথে যাত্রা করে প্রায় ৫০০ মাইল অতিক্রম করে অতিমাত্রায় শ্রান্ত, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুর আগে ৩০ ঘণ্টা প্রসববেদনার নিদারুণ যন্ত্রণায় প্রতিটি মুহূর্তকে অসম্ভব দীর্ঘ মনে হচ্ছিল তাঁর। অবশেষে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু এসে তাঁকে চিরদিনের জন্য মুক্তি দিল। মৃত্যুর খানেক আগে সম্রাটকে উপহার দিয়ে গেলেন চতুর্দশ সন্তান। ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে ৩৮৯ বছর আগে, ১৬৩১ সালের ১৭ জুন।

সম্রাট শাহজাহানের প্রধান উজির আবু হাসান আসফ খানের রূপসী কন্যা আরজুমান্দ বানু বেগম জন্মেছিলেন ১৫৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল, আগ্রায়। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন ইরান থেকে। আরবি ও ফারসিতে চমৎকার দখল ছিল তাঁর। সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র, বাদশা আকবরের পৌত্র যুবরাজ খুররম প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়েন এই বিদুষী কিশোরীর। দুজনার মধ্যে বাগদান সম্পন্ন হয় ১৬০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। যুবরাজ খুররমের বয়স ছিল তখন ১৫। আর আরজুমান্দ বানুর ১৪। তখনো যুবরাজ খুররমের নাম শাহবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহজাহান হয়নি। আর আরজুমান্দের নাম হয়নি মুমতাজ মহল। বাগদানের পর বিয়ের জন্য দুজনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও পাঁচটি বছর। যুবরাজ খুররমের জন্য স্ত্রীবিহীন এত দীর্ঘ সময় কাটানো সম্ভব নয়। তাই তিনি এর মধ্যে বিয়ে করেন কান্দাহারি বেগমকে। কান্দাহারি বেগম যুবরাজের প্রথম স্ত্রী।

আরজুমান্দ বানু বেগম ওরফে মুমতাজ মহল (২৭ এপ্রিল ১৫৯৩-১৭ জুন ১৬৩১)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

এদিকে আরজুমান্দ ও যুবরাজ খুররমের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে দরবারে সব খ্যাতিমান রাজজ্যোতিষীকে তলব করা হয়েছে। তাঁদের ঠিক করা দিনে, ১৬১২ সালের ১০ মে আরজুমান্দ বানু বেগমের সঙ্গে বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ অধিপতির দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয়। আরজুমান্দ বানু বেগমের বিয়ের পর তাঁকে অভিষিক্ত করা হয় মুমতাজ মহল নামে। মুমতাজ মহল ছিলেন যুবরাজ খুররমের দ্বিতীয় স্ত্রী, প্রথম এবং শেষ নন। দ্বিতীয় বিয়ের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হতেই মুমতাজ মহলের বর্তমানে পুনরায় বিয়ে করেন যুবরাজ। খুররমের তৃতীয় জায়ার নাম ইজ-উন-নিসা বেগম।

১৯ বছর বয়সে বিয়ের পর ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে মোট ১৪ সন্তানের মা হন আরজুমান্দ ওরফে মুমতাজ মহল। আট পুত্র ও ছয় কন্যার মধ্যে সাত সন্তানেরই মৃত্যু হয় শিশু বয়েসে। ১৪তম সন্তান ছিল কন্যাসন্তান, তাঁর নাম রাখা হয় গৌহর বেগম। জন্মের সময় তাঁর মা মারা গেলেও গৌহর বেগম বেঁচেছিলেন দীর্ঘ ৭৫ বছর। মুমতাজ মহলের মৃত্যু হয় মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুরে, আগ্রা থেকে প্রায় ৫০০ মাইল দূরে। সম্রাট শাহজাহান এমন দীর্ঘ ও দুর্গম পথে আসন্নপ্রসবা মুমতাজকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। সে বছর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁকে অস্থায়ীভাবে জয়নবাদের বাগানে সমাধিস্থ করা হয়।

মুমতাজ মহলের গর্ভজাত জীবিত চার পুত্রসন্তানের মধ্যে দিল্লির মসনদ এবং ময়ূরসিংহাসনের দখল নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহে একে একে খুন হন দারা শিকো, শাহ সুজা ও মুরাদ বক্স, এই তিন সহোদর। সে এক রক্তাক্ত নির্মম ইতিহাস। ক্ষমতার লড়াইয়ে জয়ী হন আওরঙ্গজেব, ষষ্ঠ মোগল সম্রাট। প্রায় অর্ধশতক দিল্লির মসনদের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন তিনি।

সম্রাট শাহজাহান ও মুমতাজ মহল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

প্রিয়তমা স্ত্রীর মর্মান্তিক অকালমৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান প্রবল প্রতাপশালী সম্রাট। তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে দ্বিতীয়বারের মতো সমাধিস্থ করেন তাজমহলের এক কামরায়। ভালোবাসাকে বন্দী করেন শ্বেতপাথরের বিশাল অট্টালিকার চার দেয়ালে। তার কিছুদিন পর সম্রাট নিজেই বন্দী হন তাঁরই ঔরসজাত পুত্র আওরঙ্গজেবের হুকুমে। বন্দী থাকাকালে ১৬৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন সম্রাট শাহজাহান, স্ত্রী মুমতাজ মহলের মৃত্যুর প্রায় ৩৫ বছর পর। তাজমহলের সৌন্দর্যের তোয়াক্কা না করে আওরঙ্গজেব প্রয়াত পিতাকে তাজমহলেই সমাহিত করেন।

পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং ষষ্ঠ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মা, মুমতাজ মহলের জন্য এতটুকু পরিচয়ই যথেষ্ট ছিল। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসার অনন্য এক নিদর্শন শ্বেতপাথরের বিশাল অট্টালিকা বুকে ধারণ করে এখনো বেঁচে আছেন মুমতাজ মহল লাখোকোটি প্রেমিক–প্রেমিকার অন্তরে, যাঁদের অনেকেই হয়তো জানেন না যে মুমতাজ মহলের ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটে গেছে শুধু সন্তান ধারণে এবং বেদনাদায়ক প্রসবের এক কষ্টকর জীবন নিয়ে। ঐশ্বর্যে মোড়া সে জীবনের কাহিনি লেখা আছে তাজমহলের প্রতিটি পাথরে। ভরা পূর্ণিমায় কান পাতলেই শোনা যাবে, শ্বেতপাথরে লুকিয়ে থাকা এক নারীর অশ্রুভরা চোখের গল্প।