বন্য প্রাণীর জন্য আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত এলাকা কেনিয়ার মাসাই মারা। সেখানেই গিয়েছিলেন রেজাউল বাহার ও শারমীন শাহরিয়াত দম্পতি। ঘুরেছেন বাঘ-সিংহের রাজ্যে। সেই অভিজ্ঞতা লিখলেন রেজাউল বাহার
ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে। বাসায় থাকলে ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়ার প্রয়োজন হতো। কিন্তু এখানে তার দরকার নেই। কারণ, জেনে গেছি জলহস্তীর ডাকেই ঘুম ভাঙবে।
আমরা আছি কেনিয়ার মাসাই মারা নদীর পাশে স্যাংচুয়ারি ওলনানা লজে। পৃথিবীর ভয়ংকর এক নদীর নাম এই মারা নদী, কেনিয়া-তানজানিয়ায় এর অবস্থান। প্রাণিকুলের সবচেয়ে বড় অভিবাসন হয় এখানে। যাতে অংশ নেয় লাখ লাখ প্রাণী। বর্ষা কিংবা খরায় খাবারের সন্ধানে এরা প্রতিবছর মাইগ্রেশন করে, পাড়ি দেয় মারা নদী। সেখানেই কুমিরের আহার হয় হাজারো প্রাণী। বলা হয় ‘সুইসাইড ক্রসিং’।
আমরা মারা নদীর যে অংশে আছি, সেখানে এখন কুমিরের আনাগোনা কম, আছে প্রচুর জলহস্তী। এরা রাতে বের হয় খাবারের জন্য, ভোর হওয়ার অনেক আগেই নদীর কূলে বা পানিতে চলে আসে। আমাদের সকালের ঘুম ভাঙানোর দায়িত্বও তাদের। আমাদের লজ নদীর ঠিক গাঘেঁষা, মাত্র কয়েক ফুটের মধ্যেই। লজ আর নদীর মধ্যে বৈদ্যুতিক বেড়া দেওয়া আছে, কাজেই নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।
ঠিক ঠিক ভোরে মারা নদীর পাশে জলহস্তীর ডাকাডাকিতে আমাদের ঘুম ভাঙল। মনে হচ্ছিল, এ যেন এক স্বপ্নপুরী। গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। সঙ্গে বাংলো থেকে দেওয়া হয়েছে দুপুরের খাবার। কোথাও ফাঁকা জায়গা খুঁজে খেয়ে নিতে হবে। কোথাও গাড়ি থামবে, চারদিকে জীবজন্তু, আমরা লাঞ্চ বা কফি ব্রেকে গাড়ি থেকে নেমে যাব, হয়ে যাব প্রকৃতির অংশ। খোলা জায়গা, চারদিকে বন্য প্রাণীরা ঘোরাফেরা করে। না, অযথা এরা এসে আমাদের আক্রমণের চেষ্টা করবে না। প্রকৃতির নিয়ম আছে। বন্য প্রাণীদের চলাফেরার নিয়ম আছে। বিনা কারণে কেউ কাউকে বিরক্ত করতে আসে না।
খোলা গাড়িতে এদিক–ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ ড্রাইভারের কাছে সংকেত এল। প্রতিটি গাড়িতে ড্রাইভারদের সঙ্গে থাকে রেডিও কমিউনিকেশন। কোনো বিরল প্রাণী দেখা গেলে তারা একে অন্যকে খবর দিয়ে সাহায্য করে। রেডিওতে খবর এল কোথাও চিতা বাঘ দেখা গেছে। চিতা আর লেপার্ড, এই দুই প্রাণী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। লুকিয়ে থাকে, বের হয় শুধু খাবারের সন্ধানে।
মাসাই মারাতে এখন বৃষ্টির মৌসুম শেষের দিকে। চারপাশে সীমাহীন তৃণভূমি। ঘাসগুলো ২ থেকে ৪ ফুট উঁচু। মাঝেমধ্যে মাথা তুলে জেগে আছে কিছু বড় গাছ। হাতির কারণে তেমন বড় গাছ এখানে হতে পারে না। জিরাফ আবার গলা উঁচু করে গাছের পাতা খেয়ে থাকে। একসময় গাছগুলো দেখতে ছাতার মতো হয়ে যায়।
গাড়ি নিয়ে দ্রুতগতিতে ড্রাইভার এগোচ্ছে। উঁচু ঘাসের ওপর দিয়ে এদিক-ওদিক গাড়ি চালানোর পর চিতার সন্ধান পাওয়া গেল। সে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে দিগন্তের দিকে। এই দেখা যায়, এই হারিয়ে যায়। আমাদের চালক কাম গাইড জানাল, এটা একটা মা চিতা, বাচ্চাদের কোথাও লুকিয়ে রেখে এখন শিকারে বের হয়েছে। এরপর অনেকটা সময় পার হয়েছে, চিতা আর দেখা যাচ্ছে না। আমরাও সরে গেলাম অন্য দিকটায়। কিছুক্ষণ পর আবার খবর এল, চিতা বের হয়েছে, উঁচু ঘাসের সীমানা ছেড়ে এখন সে ধীরে ধীরে খোলা প্রান্তরের দিকে যাচ্ছে।
আমাদের গাড়ি ঘটনাস্থলে চলে এল, চুপচাপ হাতে লম্বা ভারী ক্যামেরা নিয়ে দেখলাম খোলা জায়গায় চিতার শিকারের পূর্বপ্রস্তুতি। চিতা হরিণ শিকার করে। হরিণের বিভিন্ন প্রজাতি আছে, এর মধ্যে ইম্পালা আর গ্যাজেল চিতার প্রথম মেনু। আফ্রিকার এই খোলা তৃণভূমিতে অসংখ্য হরিণ। চিতা বহুদূর থেকে হরিণ দেখছে, আমরাও দেখছি। চিতার শিকারের পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের গাইড নেলসনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। খোলা দিগন্ত, উঁচু ঘাস, এরই মধ্যে উই ঢিবি। কিছুটা এগিয়ে ঢিবির ওপরে উঠে বসে চারপাশটা দেখে নেয় চিতা। প্রায় মাইল দূরে কিছু হরিণ, চিতা এখন থেকে তার লক্ষ্য ঠিক করে নেবে, বেছে নেবে কোন হরিণের পেছনে সে ছুটবে। আমরা এই চিতার পেছনে আছি দুই ঘণ্টা। সবকিছু ঘটছে ধীরগতিতে।
ক্যামেরার ৫০০ মিলিমিটার লেন্স হাতে ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা করে। ট্রাইপড নেই, বারবার হাত ওঠানামা করে ক্যামেরা ধরতে হয়। দুর্ভাগ্য, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই মুহূর্তে বুলেটের গতি নিয়ে নিল চিতা। ১০ সেকেন্ডের মতো, তারপর থেমে দাঁড়াল। চিতার হিসাব ভুল হয়েছে। শিকারের শুরুতেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে কি যাবে না, চিতা বুঝে থাকে।
দুপুর পার হয়ে গেছে অনেক আগে। আমাদেরও পেটে ক্ষুধা, খেতে হবে। এই চিতা আর একবার শিকারে যাবে কি যাবে না, বলা মুশকিল। চারদিক এখন হরিণশূন্য, শুধু চিতা ধীরগতিতে উল্টো পথে যাচ্ছে। ড্রাইভার নেলসনকে বললাম, ‘বাদ দাও, চলো ফিরে যাই, ক্ষুধা আছে পেটে।’ নেলসন একটু ধৈর্য ধরতে বলল। তার ধারণা, আবার ‘অ্যাকশন’ হবে। দুরবিন নিয়ে সে এদিক–ওদিক দেখতে থাকল। চিতা যে পথে এগোচ্ছে, সে বরাবর প্রায় মাইল দুয়েক দূরে কিছু হরিণ দেখা যাচ্ছে।
আমি মনে মনে ভাবছি, ধুর! চলে যাওয়া দরকার। ঘরে বসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে এক মিনিটের মাথায় কত অ্যাকশন দেখা যায়, স্লোমোশনে কত ডিটেলসসহ সব দেখা যায়, আর এখানে ঘণ্টা তিনেক হতে চলল।
মনে মনে একটু বিরক্তি লাগা শুরু হলো। নেলসন ছেলেটা কি বুঝতে পারছে না আমরা ক্লান্ত, দুপুরের খাওয়া দরকার। বেলা তিনটা পেরিয়ে যাচ্ছে। আমরা এসেছি প্রাইভেট ট্যুরে, শুধু আমরা দুজন গাড়িতে। আমরা যেভাবে চাইব, সেভাবেই ঘোরাঘুরি হবে। ৫০০ মিলিমিটার লেন্সসহ ক্যামেরা আবার হাতে নিলাম। চিতা এখন আমাদের থেকে মাইলখানেক সামনে। আমরা পিছু পিছু তাকে অনুসরণ করতে পারব না। মাসাই মারায় কিছু নিয়মকানুন আছে। প্রাণী অ্যাকটিভ শিকারে থাকলে তার পিছু নেওয়া যাবে না। শিকার ধরে ফেললে তার সামনে গাড়ি নিয়ে হাজির হওয়া যাবে, এতে শিকারির কোনো সমস্যা হয় না। তারা ভূরিভোজ করে, মানুষ অল্প দূরত্বে গাড়িতে বসে দেখে।
ক্যামেরার লেন্সে দেখলাম অনেক দূরে কিছু হরিণ। নেলসনের দৃষ্টি বেশ ভালো। নেলসনের মতো স্থানীয় লোকজন অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। আমাদের শহরের চোখগুলো এত তীক্ষ্ণ হয় না। আমার হাতে ৫০০ মিলিমিটার লেন্স, নেলসনের হাতে দুরবিন। সে আমাকে অনেকক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করছে যে দূরের হরিণগুলোর মধ্যে একটা অল্প বয়সী হরিণ আছে, এবং চিতা তার দিকেই এগোবে। চিতা আর হরিণের দূরত্ব তখনো মাইলখানেক। নেলসন এত তাড়াতাড়ি এই ধারণা করল, মনে হয় না ঠিক হবে!
আজ সারা দিন আকাশে ঝলমলে রোদ। মাসাই মারায় সকাল থেকে ঘুরছি। কী সুন্দর অভয়ারণ্য। চারদিকে বন্য প্রাণী-পাখি। যে যার যার জায়গায় খাচ্ছে, বিশ্রাম নিচ্ছে। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। প্রকৃতি ছবির মতো সুন্দর। হঠাৎ ক্যামেরার লেন্সে বহু দূরে দেখলাম জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টায় শরীরের প্রতিটি পেশির শতভাগ চেষ্টায় ছুটছে হরিণ, সঙ্গে অন্য প্রাণীরা। প্রকৃতির দ্রুততম ‘মেশিন’ চিতা হাই-ভোল্টেজে চালু করেছে তার শরীর। শিকার তার করতেই হবে। ক্ষুধার্ত বাচ্চা সে–ও ফেলে এসেছে। চিতার সেই কী ভয়ংকর গতি, মাত্র ২২ সেকেন্ডে সে ধরে ফেলল শিকার।
মাইলখানেক দূর থেকেই ক্যামেরার লেন্সে দেখলাম সফল এক শিকার মুহূর্ত। নেলসন গাড়ি চালু দিয়ে ছুটল, মনে হলো তৃণভূমির ওপর দিয়ে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কী ভীষণ ঝাঁকুনি, এবড়োখেবড়ো ঘাস-মাটি পাড়ি দিয়ে আমাদের নিয়ে এগোচ্ছে। মুহূর্তেই চিতার পাশে এসে গাড়ি থামল। গাড়ি থামিয়ে খালি চোখে দেখছি, হরিণটা তখনো জীবিত, কান দুটো নড়ছে। গলার পাশটা কামড়ে ধরে আছে চিতা। মাটিতে শুয়ে আছে দুজনই। চিতা ক্লান্ত, বুক-পেট বেলুনের মতো ফুলে বড় হচ্ছে, আবার ছোট হচ্ছে।
চিতার শিকার দেখতে পারা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের সেই সৌভাগ্য হলো।