গল্পটার শুরু সেই ছোটবেলায়। রংপুর জেলার ছোট্ট গ্রাম মহেশপুরের নাম রাখা হয়েছিল মহেশ চন্দ্র রায়ের নামে। এই মহেশবাবুর বড় ছেলে পতিত পাবন তাঁর যৌবনে রংপুর কালেক্টরেট মাঠে কোচবিহারের যুবরাজের সঙ্গে ফুটবল খেলেছিলেন কোনো এক কালে! সে গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি ছোটবেলা থেকে। একজন রাজার ছেলের সঙ্গে আমার ঠাকুরদাদা ফুটবল খেলেছিলেন—এ গল্প আমার মস্তিষ্কে কোচবিহার নিয়ে একটা কল্পনার রাজ্য তৈরি করে দিয়েছিল ছোটবেলায়।
অবশেষে সত্যি সত্যি যখন কোচবিহার গেলাম, তখন আমার বয়স ৪০ ছুঁই ছুঁই। আর তত দিনে রাজ্য হিসেবে একদার স্বাধীন কোচবিহার, ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশদের করদ রাজ্য কোচবিহার স্বাধীন ভারতের একটি জেলায় পরিণত হয়ে গেছে; ঠিক যেভাবে ভারতের আরও প্রায় সাড়ে পাঁচ শ দেশীয় রাজ্য দেশটির জেলা হিসেবে গণ্য হয়েছে। স্বাধীন একটি রাজ্যের এই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি শুধু ভূখণ্ড হিসেবে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে গলা টিপেই মারেনি, সেই সঙ্গে নিঃশেষ করেছে এক বিশাল সাংস্কৃতিক প্রবাহের—সবকিছু মিলিয়ে ফল্গুধারার মতো যা প্রবাহিত ছিল এক স্বাধীন রাজ্যের মানুষের মধ্যে। বিশাল বপু কুস্তিগিরের কঙ্কালসার দেহ দেখে যেমন মন হু হু করে ওঠে, এখনকার কোচবিহার দেখে আমার মন ঠিক তেমনি খাঁ খাঁ করে উঠল।
খুব অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, রংপুর শহর থেকে ঠিক উত্তর দিকে শখানেক কিলোমিটার গেলে রংপুরের মতোই আরেকটি পুরোনো শহর কোচবিহার। এখানকার মানুষের ভাষা, খাদ্য, চেহারা—সবই প্রায় রংপুর অঞ্চলের মানুষের মতো। সমতল ভূমিকেন্দ্রিক বাংলাদেশের যে উত্তরবঙ্গ, তা কোচবিহারের সমভূমির মতোই। কিংবা বলা চলে তারই ধারাবাহিকতা। নদী-নালাবিধৌত বিশাল সমভূমি অঞ্চলে অনেক আগে গড়ে উঠেছিল কোচবিহার রাজ্য। জানা যায়, ১৫২৩ সালে এই রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল রাজা বিশু বা বিশ্ব সিংহের হাত ধরে। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৪০০ বছর পর ১৮৬৩ সালে রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের আমলে আজকের রূপ পায় কোচবিহার। সে জন্যই রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণকে আধুনিক কোচবিহারের জনক বলা হয়। বর্তমান কোচবিহারকে আমরা যা দেখি, সেই ধ্রুপদি ইউরোপীয় নির্মাণশৈলির বিশাল রাজপ্রাসাদ, তার সামনে ইউরোপীয় নকশার কোচবিহার শহর, সাগরদিঘি নামের বিশাল পুকুর ও পুকুরের চারদিকে বিভিন্ন দপ্তরের সুদৃশ্য অট্টালিকা, মদনমোহন বাড়ি, এ বি এন শীল কলেজ (ভিক্টরিয়া কলেজ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল), সুনীতি একাডেমিসহ আরও অনেক কিছু গড়ে উঠেছিল।
কোচবিহারের মারকাটারি গরমে ঘামে ভিজতে ভিজতে যখন খয়েরি রঙের বিশাল রাজবাড়ির সিংহদরজায় উপস্থিত হলাম, তখন দুপুর। ভেতরে ঢোকার সব জোগাড়যন্ত্র শেষে বিশাল মাঠ পেরিয়ে রাজবাড়ির সদর দরজায় গিয়ে উঠলাম। সে এক ঘটনাই বটে! এত বড় রাজবাড়ি দেখিনি আগে। রংপুরের তাজহাট, নাটোরের রাজবাড়ি কিংবা দিনাজপুরের রাজবাড়ি দেখেছি। সেগুলো কলেবরে কোচবিহারের রাজবাড়ির সমান নয়। এ রাজবাড়িতে রাজা থাকেন না। এটি এখন রাজাদের স্মৃতিবাহী একটি দর্শনীয় বাড়ি মাত্র।
যেকোনো রাজপ্রাসাদে ঢুকলেই নিজেকে রাজা মনে হয়। এখানে ঢুকেও নিজেকে রাজাই মনে হলো। কিন্তু যখন রাজবাড়ির দায়িত্বে থাকা লোকজন গর্জে উঠলেন, ভেতরে ছবি তোলা যাবে না বলে আমি তখন প্রমাদ গুনলাম।
রাজবাড়ি এখন জাদুঘর, যেমনটা হয়ে থাকে আরকি। রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি, কলকাতার ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল—এ রকম সবই প্রায় জাদুঘর এখন। যা হোক, রাজপ্রাসাদ যত বড়, জাদুঘর ততই ছোট। বিশাল রাজবাড়ির শুধু ডান দিকের কিছু অংশ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাদুঘরের চিত্তাকর্ষক অংশ হলো প্রাচীন মূর্তি আর রাজবাড়ির অস্ত্রের সংগ্রহ।
অল্প কিছু পাথরের মূর্তি রয়েছে এখানকার গ্যালারিতে। বেশির ভাগই নবম-দশম শতকের। সিংহবাহিনী এবং মহিষমর্দিনীর দুটি মূর্তি দেখলাম যথাক্রমে নবম ও দশম শতকের। বাকি যা আছে—সূর্য, প্রসূতি, বিষ্ণু, হরপার্বতী, ব্রহ্মা (প্রভৃতি)—সেগুলোর চেয়ে পুরোনো মূর্তি দেখেছি রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে। কিন্তু সিংহবাহিনী ও মহিষমর্দিনীর মূর্তি বরেন্দ্র মিউজিয়ামে নেই।
রাজবাড়ির অস্ত্রের সংগ্রহ বেশ সমৃদ্ধই মনে হলো। বিভিন্ন মডেলের পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেল রয়েছে গ্যালারিতে। সঙ্গে বুলেট। পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেলের সংগ্রহ দেখে মনে হলো, রাজবাড়ির অস্ত্রের সংগ্রহ বেশ সমৃদ্ধ। এর একটা কারণ আছে বলে মনে হয়। কোচবিহাররাজকে অনেকবার যুদ্ধ করতে হয়েছে প্রতিবেশী ভুটানরাজের সঙ্গে। এ রকম এক যুদ্ধে ভুটানরাজের পাঠানো সেনাপতি জিম্পি রাজা নরেন্দ্র নারায়ণ ও রাজমাতাকে বন্দী করে ভুটান নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও সে চেষ্টা সফল হয়নি। এরপর নাজিরদেব খগেন্দ্র নারায়ণের চেষ্টায় কোচবিহারের রাজপরিবারের সঙ্গে ইংরেজদের একটি সন্ধি হয়। ১৭৭৩ সালের এই সন্ধির মাধ্যমেই কোচবিহার প্রথমবার করদ রাজ্যে পরিণত হয়। এরপর থেকে ইংরেজেরা কোচবিহার রাজ্যকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে শুরু করে বার্ষিক কর ধার্য করে। সম্ভবত ইংরেজদের পরামর্শে কোচবিহারের রাজারা আধুনিক ইউরোপীয় সমরাস্ত্রের দিকে ঝোঁকেন এবং বিভিন্ন সময় প্রচুর অস্ত্র সংগ্রহ করেন, যার নিদর্শন দেখা যায় রাজবাড়ির জাদুঘরে। যাঁরা অস্ত্রশস্ত্র ভালোবাসেন, তাঁরা এসব দেখে মুগ্ধ হবেন নিশ্চিত। এখানে বেশ পুরোনো মডেলের রিভলবার, রাইফেল, গাদাবন্দুক ইত্যাদি দেখা যাবে।
লুকিয়ে একবার ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাকিয়ে দেখি, চারদিকে সিসি ক্যামেরা। ছবি তোলা হলো না। কে আবার কী বলবে, থাক। বেরিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলাম রাজবাড়ির। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম প্রাসাদের পেছন দিকে। পুলিশ ক্যাম্প আর আর্কিওলজি বিভাগের অফিস সেদিকে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজবাড়ির রান্নাঘরটা কোথায়? দুপুরের ঠা ঠা রোদে বেচারা শীতল চোখে তাকাল আমার দিকে। সম্ভবত আমার সাদা হয়ে যাওয়া দাড়ি দেখে কিছু বললেন না, হনহনিয়ে হেঁটে গেলেন। আমিও গরমে খানিক শীতল হয়ে গেলাম। দুপুরবেলা কে আবার শীতল চাহনি দেয়, সে ভয়ে আর রান্নাঘরের কথা কাউকে জিজ্ঞেস করলাম না। এ রকম হয়েছিল জোড়াসাঁকোতে। রবিঠাকুরের খাবার ঘর আর মৃণালিনী দেবীর ছোট্ট রান্নাঘর দেখে যখন উত্তেজিত হয়ে মোবাইল ক্যামেরা অন করলাম, একজন শীতল কণ্ঠে বলে উঠল, দাদা, ছবি তোলা যাবে না। এবার এই তপ্ত দুপুরে আর অতখানি অপমানিত হতে চাইলাম না। তাই কাউকে নৃপেন্দ্র নারায়ণের রান্নাঘরের কথা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস না করে প্রাসাদের উদ্যানে বাটিছাঁট দেওয়া গাছের গোড়ায় ঘন হয়ে বসে থাকা তরুণ-তরুণীদের দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। তারা হাওয়া খাচ্ছে, দুপুরের তপ্ত অভিমানী হাওয়া। আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখতে দেখতে যখন সিংহদরজার দিকে এগিয়ে চলেছি বেরিয়ে যাব বলে, তখন মনটা হু হু করে উঠল। আহা, আমার জীবনে ঘন হয়ে বসে থাকার কোনো স্মৃতি কেন নেই?
দুটি ঘুঘু উড়ে গিয়ে বসল একজোড়া তরুণ-তরুণীর সামনে। আমি হাঁটছি বিরাট এক খয়েরি রঙের রাজবাড়িকে পেছনে রেখে। মনে পড়ল, ইংরেজদের করদ রাজ্য কোচবিহারকে সেই রাজ্যেরই রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ১৯৪৯ সালের ২৮ আগস্ট ভারতীয় অধিরাজ্যের হাতে ছেড়ে দেন। সেই সূত্রেই কোচবিহার স্বাধীন ভারতের একটি জেলায় পরিণত হয়। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হয় সিংহ ও হাতির রাজপ্রতীকযুক্ত স্বাধীন একটি রাজ্যের অস্তিত্ব। আরও মনে পড়ল, এই রাজপরিবারেরই কোনো এক সদস্যের সঙ্গে আমার এক ঠাকুরদাদা কোনো এক কালে রঙ্গপুর কালেক্টরেট মাঠে ফুটবল খেলেছিলেন!