ভারতের অসম ভূমির আসাম রাজ্য গিয়েছিলাম বন ও বন্য প্রাণী সম্পর্কে জানতে। এটাই আমার প্রথম ভিনদেশে যাত্রা। যাওয়ার কথা ছিল কাজিরাঙা ও মানাস ন্যাশনাল পার্ক, সেই সঙ্গে বামনশূকর প্রজননকেন্দ্রে। এই ভ্রমণের শুরু থেকেই আমার একটাই স্বপ্ন নিজ চোখে বুনো পরিবেশে একনজর হলেও গন্ডার দেখার। আসামের গুয়াহাটি যাওয়ার পর জানলাম গন্ডারের বন কাজিরাঙা সাম্প্রতিক বৃষ্টির কারণে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। শুনেই প্রচণ্ডভাবে হতাশ হলাম। যা হোক, পরে ভুটানসংলগ্ন আসামের মানাস ন্যাশনাল পার্কে রওনা হলাম। মানাসে গিয়ে গন্ডার দেখার সাধ পূরণ হয়েছিল। সেই দুর্লভ মুহূর্ত ও অভিজ্ঞতার গল্প না হয় আরেক দিন হবে। মানাস থেকে ফেরার পথে বোনাস হিসেবে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কিংবদন্তির কামাখ্যামন্দির। আজ সেই কামাখ্যার কথাই হোক।
আসামে ঘুরতে যাওয়ার পর থেকেই সবার মনে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল, যদি সুযোগ হয় কামরূপ কামাখ্যা দেখার। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি রহস্যময় কামরূপ কামাখ্যার কথা। সেই জাদুর নগরীতে কেউ গেলে সে আর ফিরে আসে না। সেখানকার জাদুকরেরা তাকে বন্দী করে বিভিন্ন কাজ করায়, নয়তো গরু–ছাগল বানিয়ে রাখে। কেউ বলে কামরূপে নাকি কোনো পুরুষ নেই। সবাই নারী। দুনিয়ার তাবৎ জাদুকরেরা সেই কামরূপ কামাখ্যা থেকে জাদু শিখেছে। কিংবদন্তির সেই কামরূপ কামাখ্যা দেখতে যাচ্ছি আমি!
ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের নীলাচল পর্বতে অবস্থিত কামাখ্যার মন্দির। নীলাচলের পাদদেশে গিয়ে দেখলাম পাহাড়ের গায়ে সারি সারি ঘরবাড়ি, দোকানপাট। শুধু জাদুকর বা নারীরা নয়, সব ধরনের মানুষের বসতি এ অঞ্চলের পাহাড়ে। ছোটবেলার সেই জাদুকরেরা কোথায়? কোথায় তোমার সেই জাদুর রাজ্য!
নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়ায় অবস্থিত কিংবদন্তির কামাখ্যামন্দির পর্যন্ত পিচঢালা পথ। একধারে পাহাড়ের দেয়াল। সেই দেয়ালের মাঝে মাঝে আধুনিক টেরাকোটায় দৃশ্যমান করা হয়েছে কামাখ্যার সত্য যুগের কিংবদন্তি ও আসামের ঐতিহ্য। আরেক ধারে অন্য পাহাড়ের গা ঘেঁষে রংবেরঙের ঘরবাড়ির দৃশ্য। গাড়িতে করে পাহাড়চূড়ায় যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ছোটবেলার সেই জাদুকরের মুখে শোনা কিংবদন্তির কথা। ড্রাইভার জানালেন, এই জাদুর রাজ্য এখানে নয়, সে অন্য অঞ্চল। তবে এখানেও নাকি বহু আগে মহাশক্তিধর তান্ত্রিক ছিলেন। তাঁরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন। এখন আর নেই। তবে উৎসবের সময় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তান্ত্রিকসাধুরা জমায়েত হন কামাখ্যায়। নিজেদের শক্তি–ক্ষমতা বাড়াতে। বিশেষ দিনের একটু লালপানি সংগ্রহের আশায়। যে তান্ত্রিকের কাছে এই পানি আছে, তিনি মহাশক্তির অধিকারী। প্রাচীনকাল থেকেই সাধু, সন্ন্যাসী আর তান্ত্রিকদের সাধনালয়ের জন্যই হয়তো কামাখ্যার এত কিংবদন্তি।
যেতে যেতে ড্রাইভারের কাছে শুনলাম কামাখ্যামন্দিরের প্রাচীন কাহিনি, সঙ্গে ইতিহাস। কিংবদন্তি অনুসারে, সত্য যুগে দক্ষ রাজার কন্যা সতীদেবী দক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ‘যোগী’ মহাদেবকে বিবাহ করায় দক্ষ ক্ষুব্ধ হন। মহাদেবের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। দক্ষ মহাদেব ও সতীদেবী ছাড়া প্রায় সব দেব-দেবীকে নিমন্ত্রণ করেন। এদিকে বাবার বাড়িতে যজ্ঞের আয়োজন, মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতীদেবী মহাদেবের অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু দক্ষের প্রতিশোধ ও সতীদেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায় তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেন না দক্ষ। তার ওপর দক্ষ মহাদেবকে অপমান করেন। অভিমানী সতীদেবী তাঁর স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন। শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষর যজ্ঞ ভন্ডুল করেন এবং সতীদেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। ফলে বিশ্বময় প্রলয় শুরু হয়। দেবতারা অনুরোধ করেন মহাদেবকে এই নৃত্য থামানোর জন্য। কিন্তু মহাদেবের নৃত্য না থামালে বিষ্ণু দেব তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীদেবীর মৃতদেহ ছেদন করে মহাদেবকে নিরস্ত্র করেন। এতে সতীদেবীর দেহখণ্ডগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে। যা পরবর্তী সময়ে হিন্দু পবিত্র পীঠস্থান (শক্তিপীঠ) হিসেবে পরিচিতি পায় ও পূজিত হয়। শিবের তরুণী স্ত্রী ও মোক্ষদাত্রীশক্তিই কামাখ্যা নামে পরিচিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নীলাচল পর্বতে মঙ্গল আক্রমণে প্রথম তান্ত্রিক কামাখ্যামন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল। এরপরও অনেকবার আক্রমণ হয়েছে। আবার নির্মাণ হয়েছে কামাখ্যামন্দির। মন্দিরের চারপাশ ও দেয়ালে অবস্থিত বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তির গড়ন দেখেই তা বোঝা যায়। বর্তমান মন্দিরভবনটি অহম রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত।
আমরা যখন মন্দিরে পৌঁছালাম তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। মন্দিরে প্রচণ্ড ভিড়। মন্দির ঘুরে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ছোটবেলার সেই জাদুময় কামাখ্যার কথা! মন্দির কয়েক স্তরে রঙিন ফুলে সাজানো। পাথুরে দেয়ালে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, ফুল–নকশায় ভরা। কিছু মূর্তি কাচে বাঁধাই করা, কিছু মন্দির চত্বরে ছড়িয়ে আছে। কামাখ্যামন্দিরের মূল অংশটি মন্দিরের মধ্যে পাহাড়ের গুহায় অবস্থিত। সেখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর ও ভূগর্ভস্থ প্রস্রবণটি আছে। তবে আমার মন্দিরের ভেতরের মূল অংশে যাওয়া হয়নি।
কালিকাপুরান অনুসারে, কামাখ্যায় পূজা করলে সব ইচ্ছা পূর্ণ হয়। তা ছাড়াও প্রচলিত কিংবদন্তির জন্য কামাখ্যা তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীর ভিড়ে পরিপূর্ণ থাকে। কেউ মানত নিয়ে এসে ছাগল বা কবুতর বলি দিচ্ছে, কেউ মন্দির চত্বরের গাছে হলুদ–লাল মন্ত্রপূত দাগা বাঁধছে, কেউ প্রদীপ জ্বালাচ্ছে আবার কেউ ধাপে ধাপে সাজানো পাথুরে সিঁড়িতে বসে সাধুর কাছে দিশা খুঁজে নিচ্ছে। তবে মন্দিরে সাধু–সন্ন্যাসীদের আধিক্য তেমন চোখে পড়ল না।
কামাখ্যা ১৮টি মহাশক্তি পিঠের একটি। এই মন্দিরে দুর্গাপূজাসহ বেশ কিছু বড় উৎসব পালিত হয়। তার মধ্যে অম্বুবাচী মেলা উল্লেখযোগ্য। লোকবিশ্বাসমতে, আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুময়ী হয়। এই সময়টিতে কামাখ্যাদেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদ্যাপন করা হয়। এই সময় মূল গর্ভগৃহের প্রস্রবণের জল (বিজ্ঞানমতে, আয়রন অক্সাইডের প্রভাবে) লাল হয়ে থাকে। শুনলাম, দুদিন আগেই নাকি এখানে বড় উৎসব অম্বুবাচী মেলা হয়ে গেছে। তখন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু তীর্থযাত্রী ও সাধু–সন্ন্যাসী জমায়েত হয়েছিলেন। কেউ ইচ্ছা পূরণে, কেউ নিজের তান্ত্রিকশক্তি বৃদ্ধির আশায়। দিনরাত যজ্ঞ হয়েছেন তখন।
লোকবিশ্বাস অনুসারে, শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত তীর্থগুলোতে সতীদেবীর দেহের নানান অঙ্গ, অলংকার রক্ষিত আছে। ফলে শক্তিপীঠ মন্দিরের পূজিত মূল ভিত্তিগুলো পূর্ণাঙ্গ মানুষ আকৃতির মূর্তি হয় না। ভারতীয় উপমহাদেশের নানান স্থানে এই শক্তিপীঠগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। কামাখ্যামন্দির ও শক্তিপীঠ নিয়ে জানতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের যশোরেশ্বরী মন্দিরের কথা। সুন্দরবনে মানববসতির প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গবেষণার জন্য আমাকে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান অনুসন্ধান করতে হয়েছিল। তখন কলকাতার ‘বাংলার পুরাতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র’–এর পেজে আলোচনা হয় যশোরেশ্বরীর মন্দির নিয়ে। সতীদেবীর হাতের তালু ও পায়ের পাতা পতিত হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুরে। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, যশোরেশ্বরী ভীষণামূর্তির রূপ সত্যযুগের পরিচয় বহন করছে। যশোরেশ্বরী ভীষণামূর্তিও কামাখ্যার যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথরের মতো একটি বড় পাথরের খণ্ড। যশোরেশ্বরীর মুখ ছাড়া অন্য অংশগুলো নেই। মাটির নিচে নিরেট পাথরখণ্ড প্রোথিত আছে। বাংলাদেশে সতীদেবীর অঙ্গ ও গয়না পড়েছে এমন শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত বগুড়ার ভবানীপুর, সিলেটের শ্রীশৈল, কালাজোড় গ্রাম ও জয়ন্তিয়া, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথমন্দির এবং বরিশালের সুগন্ধা। তবে সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী বাংলার অন্যতম শক্তিপীঠগুলোর একটি। ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি প্রত্নতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তরীভূত শক্তিপীঠ আমাদের অঞ্চলের প্রাচীন মানববসতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এগুলো আমাদের ভূখণ্ডের মানব ইতিহাস অনুসন্ধানে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।