এথেন্সের সেন্ট্রাল রেলওেয়ে স্টেশনে আমাকে নিতে আসেন খন্দকার জুয়েল নামের আমার এক পূর্বপরিচিত। তিনি আমার এক দুলাভাইয়ের মামা। তাই আমিও তাঁকে মামা বলি। তিনি প্রায় ২২ বছর ধরে গ্রিসে বসবাস করেন। তাই তিনি দেশটির নাড়ি–নক্ষত্র জানেন। এথেন্সের সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন থেকে তাঁর বাসা কিছুটা দূরে। গাড়ি ড্রাইভ করে পৌঁছাতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগে। এথেন্সে দুদিন ছিলাম তাঁর বাসাতে। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম গ্রিসের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার আর সে দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্পর্কে।
খন্দকার জুয়েল জানালেন, তাঁরা যে সময় গ্রিসে এসেছিলেন, অর্থাৎ ১৯৯৮ কিংবা ১৯৯৯ সালের দিকে তখন গ্রিস ছিল ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ আয়ের দেশগুলোর একটি। গড় আয় হিসাব করলে সে সময় ইতালি কিংবা স্পেন অথবা ফ্রান্সের সঙ্গে সে সময় গ্রিসের তেমন একটা পার্থক্য ছিল না। তখন গ্রিস সরকার সে দেশের নাগরিক, এমনকি সে দেশে বসবাস করা অভিবাসীদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা বরাদ্দ করেছিল, যেটা আমাদের অনেকের কাছে শুনলে অদ্ভুত লাগতে পারে।
এসব সুবিধার মধ্যে ছিল নির্ধারিত সময়ে কাজে উপস্থিত থাকতে পারলে অতিরিক্ত বোনাস কিংবা কেউ যদি ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে দেওয়ার মতো কিছু সুবিধা সে সময় গ্রিসের সরকার প্রবর্তন করেছিল। ব্যাংকগুলো সে সময় অনেক ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্যও গ্রহীতাদের ঋণ দিতে শুরু করে। এমনকি সে সময় ছুটি কাটানোর জন্যও ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
দেশটির আপামর জনসাধারণ তখন এতটা ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল যে পরবর্তী সময়ে অনেকে সেসব ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হন। ফলে একদিকে যেমন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো প্রচুর পরিমাণে বন্ড বিক্রি বাড়িয়ে দেয়, যা দেশটির ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চরমভাবে। এ ছাড়া গ্রিসের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আরও একটি কারণ হচ্ছে ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত এথেন্স অলিম্পিক। এ প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।
২০০৮ সাল থেকে সবকিছু উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা গ্রিসকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। পাশাপাশি গ্রিস সরকারের ঘোষিত বেশ কিছু পদক্ষেপকে তিনি দায়ী করেন গ্রিসের এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণ হিসেবে। অর্থনৈতিক মন্দা ও দেশটির ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীলতার কারণে ২০১১ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে অনেকবার দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে আরও যুক্ত হয়েছে শরণার্থী সমস্যা। সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে গ্রিস একমাত্র শেংঘেনের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ছাড়াও এশিয়ার অনেক দেশ থেকে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিবাসনপ্রত্যাশী গ্রিসে প্রবেশ করেন; তাঁদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ বৈধ উপায়ে গ্রিসে আসেন।
প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক, মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া কারও সঙ্গে গ্রিসের সম্পর্ক তেমন একটা উষ্ণ নয়। তুরস্কের সঙ্গে গ্রিসের মৌখিক যুদ্ধ সব সময় লেগে থাকে। তাই উত্তেজনার মুহূর্তে তুরস্ক কিংবা মেসিডোনিয়া অথবা আলবেনিয়া থেকেও অনেক শরণার্থীকে গ্রিসে ঠেলে পাঠানো হয় দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য, এমন দাবি দেশটির সাধারণ মানুষের।
গ্রিস থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশে পৌঁছানো তেমন সহজ নয়। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে গ্রিসে আটকা পড়ে যান। ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ গ্রিসের জন্য এসব অনিয়মিত অভিবাসী অনেক বড় একটা ধাক্কা আর এ কারণে দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে রক্ষণশীল ও অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেটা ১০ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না, এমন অভিমত খন্দকার জুয়েলের।
গ্রিসের সাধারণ মানুষ বরাবর অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত, অথচ এখন গ্রিকরা তাদের সে মূল্যবোধ থেকে সরে আসছে বলে খন্দকার জুয়েল মন্তব্য করেন। দেশটির বর্তমান প্রজন্মের অনেকে গ্রিস ছেড়ে উন্নত জীবনের আশায় নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন।
গ্রিসে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্পর্কে খন্দকার জুয়েল জানালেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় গ্রিসের আইন অনেকটা অদ্ভুত। বিশেষ করে অভিবাসীদের জন্য দেশটির আইন তেমন একটা বন্ধুসুলভ নয়। তাই অনেক বাংলাদেশি সেখানে দুই দশক বসবাস করার পরও স্থায়ীভাবে সে দেশের পাসপোর্টের অধিকারী হতে পারেন না। গ্রিক পাসপোর্ট পেয়েছেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা তাই হাতে গোনা যাবে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনে অনেকে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে পারেন, কিন্তু গ্রিসে সে সুযোগ তেমন একটা নেই। গ্রিসের অধিবাসীরা সহজে বাইরের দেশের মানুষের সঙ্গে মিশতে চান না। এমনকি রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে গ্রিকরা সহজে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে সহজে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
গ্রিসে বাংলাদেশিরা তেমন একটা সুসংগঠিত নয়। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তাই অনেক বাংলাদেশি প্রায়শই পাকিস্তানি, আফগান অথবা আরব শরণার্থীদের হামলার শিকার হন।
গ্রিসের জাতীয় রাজনীতিতে অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উপস্থিতি তেমন একটা তাই চোখে পড়ে না। গ্রিস এবং সাইপ্রাসের বাইরে অন্য কোনো দেশে গ্রিক ভাষার তেমন একটা চর্চা হয় না। দেশটির জনগণ যে খুব ভালো ইংরেজি বোঝে, তেমনটিও নয়। ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়ার সুযোগ গ্রিসে তেমন একটা নেই; এ ছাড়া যেসব স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা যায়, সেগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল। তাই সন্তানদের ভবিষ্যৎ বিকাশের সুযোগ দেশটিতে অপর্যাপ্ত বলা চলে।
খন্দকার জুয়েল আরও জানালেন, গ্রিসে বর্তমানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশ অবৈধ উপায়ে গ্রিসে এসেছে। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগাল—এসব দেশের আইন তুলনামূলকভাবে অভিবাসনবান্ধব হওয়ায় অনেকে সেসব দেশে সহজে স্থায়ী হতে পারেন। এমনকি এসব দেশের সরকারও মাঝেমধ্যে অনিয়মিত অভিবাসীদের বৈধ করার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ করে থাকে; কিন্তু গ্রিসের ক্ষেত্রে এ রকম কোনো কিছু আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অনেকে পাঁচ থেকে দশ বছর থাকার পরও সে দেশে বৈধ হতে পারেন না।
অতীতে অবৈধ অভিবাসীরা গ্রিসে কাজ করার সুযোগ পেলেও বর্তমান সরকারের সময় সেটি কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্রিসের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস সম্পূর্ণ ডানপন্থী এবং অভিবাসনবিরোধী। হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট এ প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত বেশ কিছু পদক্ষেপ দেশটিতে বসবাসরত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সব আশার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে বলেই অভিমত খন্দকার জুয়েলের। তাঁর মতে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য—এসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যতটা সুসংগঠিত, গ্রিসের বাংলাদেশ কমিউনিটি তেমন একটা সুসংগঠিত নয়। সে জন্য নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ দেশটিতে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তাই অনেক বাংলাদেশি প্রায়শই পাকিস্তানি, আফগান বা আরব শরণার্থীদের হামলার শিকার হন।
ইউরোপে যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও স্পেনের পর সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির বসবাস গ্রিসে। নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না হলেও অন্তত ২৫ হাজার বাংলাদেশির বসবাস সেখানে। এথেন্সেরর মধ্যে ওমানিয়া ও আখারনুন—এ দুটি এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির বসবাস। এদের মধ্যে কারও নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে, কেউ আবার বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট কিংবা দোকানে কাজ করেন। অনেকে আবার মৌসুমভিত্তিকভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, কেউ আবার দ্বীপগুলোতে ছুটে যান কাজের জন্য।
তবে একটি দিক থেকে গ্রিস অন্যান্য দেশের তুলনায় আলাদা। দেশটিতে জীবনযাত্রার খরচ এবং ট্যাক্সের হার তুলনামূলকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। স্লোভেনিয়াতে প্রত্যেককে আলাদাভাবে তাঁর নিজের বেতনের থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ সরকারকে দিতে হয় ট্যাক্স হিসেবে। গ্রিসে ট্যাক্স পরিশোধ করা হয় চাকরিদাতার পক্ষ থেকে। স্লোভেনিয়াতে যদি মাসিক বেতন এক হাজার ইউরোর কথা বলা হয়, তাহলে সব ধরনের ট্যাক্স ও পেনশনের টাকা পরিশোধ করার পর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে ৬৫০ ইউরোর মতো, কিন্তু গ্রিসের ক্ষেত্রে এক হাজার ইউরোর পুরোটাই চাকরিজীবীর লাভ। মোটামুটি নাকি ৩০০ ইউরো হলে গ্রিসের যেকোনো জায়গায় থাকা-খাওয়া সব মিলিয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের এক মাস দিব্যি কেটে যায়, যেটা ইউরোপের অন্যান্য দেশে কল্পনা করা যায় না।
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।