হুট করেই ব্রেক কষল আমাদের বহনকারী সিএনজি অটোরিকশা। থামল একটি সেতুর গোড়ায়। চালক ইতিউতি করতেই দুজন এগিয়ে এলেন। অটোরিকশার পাশে এসে মাথা নামিয়ে বললেন, ‘চাঁদ নৌকা ভ্রমণে আপনাদের স্বাগত।’
চাঁদ নৌকা! থতমত খেয়ে আমরা নেমে পড়লাম। থতমত না বলে চমক বলাই ভালো। কয়েকজন বন্ধু আমাদের চমক দিতে চেয়েছেন। তাঁরা বলেছিলেন, আমরা যেন তাঁদের ‘পথনির্দেশনা’ মানি। আমরা তাঁদের নির্দেশনা মেনেই কক্সবাজার থেকে সিএনজি অটোরিকশায় উঠেছিলাম।
শহর পেরিয়ে অটোরিকশা যখন মেরিন ড্রাইভ সড়কে, তখনই মৃদু উপস্থিতি জানান দিল ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ। এদিকে ভ্রমণসঙ্গী (জীবনেরও) নুসরাত জাহান অটোরিকশাচালকের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর রহস্যের কূলকিনারা করার চেষ্টা করলেন—কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি ইত্যাদি। কিন্তু চালক বেচারা এমনিতেই স্বল্পভাষী, তার ওপর পেয়েছেন কথা না বলার নির্দেশনা। তাই সব প্রশ্নের উত্তরে সীমাবদ্ধ থাকল দুটি শব্দে—‘হ্যাঁ’, ‘না’।
মেরিন ড্রাইভ সড়কে প্যাঁচার দ্বীপ এলাকার এই সেতুর গোড়ায় এসে রহস্যের জট খুলতে শুরু করল। সোহেল ও শাখী নামের যে দুজন আমাদের স্বাগত জানালেন, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। দুজনই ‘চাঁদ নৌকা ভ্রমণ’ নামে এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত। সেসব কথা আমরা সড়ক থেকে নেমে খালের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনছিলাম।
এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন মিথুন ও মনীষা নামে ঢাকা থেকে আসা আরেক দম্পতি। আমরা এগিয়ে চললাম। অনতিদূরেই দেখা যাচ্ছে সাগর। পাশে সৈকতঘেঁষা বৃক্ষশোভিত একটি বাড়ি। বৃক্ষরাজির মধ্যে নারকেলগাছ তার উচ্চতার উপস্থিতি বিশেষভাবে জানান দিল।
বাড়ির কাছে আসতেই মালা পরিয়ে বরণ করা হলো। হাতে তুলে দেওয়া হলো ডাব। ওয়েলকাম ড্রিংয়ের চেয়ে দৃষ্টি কাড়ল গলায় পরা মালাটা। সৈকতে জন্মানো একপ্রকার লতার মাথায় জবা ফুল বাঁধা। নৌকায় উঠে পড়লাম আমরা।
মূলত কক্সবাজারে ঘুরতে আসা পরিবারের কথা বিবেচনা করে এক বেলা নৌকাভ্রমণের আয়োজন করেন সোহেল-শাখী দম্পতি। নৌকাভ্রমণের সঙ্গে মিনি বান্দরবান আর প্যাঁচার দ্বীপের সৈকতে নামিয়ে কিছুটা সময় ঘোরানো হয়। থাকে দুপুরের খাবারের আয়োজন। জনপ্রতি ৭০০ ও ১২০০ টাকার প্যাকেজ। চাইলে নিজেদের মতো করেও প্যাকেজ সাজানো যায়।
চাঁদের মতো দেখতে সে নৌকা। কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী নৌকায় ভ্রমণ বলেই নাম—চাঁদ নৌকায় ভ্রমণ। প্যাঁচার দ্বীপের লাল ব্রিজ পেরিয়ে রেজু খাল ধরে নৌকা ছুটল মিনি বান্দরবানের উদ্দেশে।
রেজু খালে দুবার নৌকা আটকাল। মাঝি বললেন, ‘ভাটার টান।’ পাশ দিয়ে কয়েকজন পর্যটক কায়াক চালিয়ে চলে গেলেন। আমাদের মনোযোগ অবশ্য কায়াকিংয়ে নয়, খোশগল্পে। মাঝিসহ নৌকায় জনা দশেক মানুষ আমরা। আড্ডা জমে উঠল। একেকজনের একেক গল্পে নৌকা চলতে থাকল। চাঁদের মতো সে নৌকা!