গড় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে—মাইনাস ৬০ থেকে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাটি বলে এখানে কিছু নেই। আছে পাথরের ওপর বরফের স্তর।
‘সিলভার সি ক্রুজ’ শিপের ছয়তলার পেছন দিকে রেস্তোরাঁ। চারদিক কাচঘেরা। সারা দিনের দীর্ঘ যাত্রার পর বিকেলে চিলির পুন্তা এরিনা বন্দর থেকে জাহাজে উঠেছি। এখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। দুপুরে তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। হঠাৎ কিছু মানুষ খাবারের টেবিল ছেড়ে বাইরের ডেকের দিকে যাচ্ছে। একটু মাথা ঘোরাতেই টের পেলাম, জাহাজ বন্দর ছেড়েছে। পেটে খিদে নিয়ে টেবিল ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, সত্যিই ছেড়েছে। ছেড়ে যাওয়া বন্দর ধীরে ধীরে দিগন্তের দিকে সরে যাচ্ছে। আমরা যাচ্ছি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে, সেখানে আছে জনমানবহীন এক মহাদেশ, সাদা মহাদেশ, শেষ মহাদেশ, অ্যান্টার্কটিকা। আহা...
২০০৫ সাল থেকে একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আছি আমি আর শারমীন। আমাদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ১৯৯৯ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি, ২০০৫ সালে আসে শারমীন। একসঙ্গে প্রথম ঘুরতে যাই ক্যারিবিয়ানের বাহামাস দ্বীপপুঞ্জে, সেটা ২০০৮ সালে। গত ১৩ বছরে আমরা একসঙ্গে ৮৩টি দেশ ভ্রমণ করেছি।
প্রথম প্রথম ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটা ছিল অবকাশযাপন, একসময় তা রক্তে মিশে যায়। এখন জীবনের প্রথম অগ্রাধিকার—ভ্রমণ।
অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু বছর পাঁচেক আগে। কোনো এক সন্ধ্যায় শারমীন টিভিতে ডকুমেন্টারি দেখতে দেখতেই বলল, অ্যান্টার্কটিকা যেতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, যাওয়া যায় বটে, তবে খরচ অনেক। এমনিতেই প্রতিবছর নানা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি, তার ওপর এত খরচের ধাক্কা সামলানো কঠিন। কিন্তু যেতেও তো মন চায়!
তখন দুজনে মিলে অভিযানের অর্থসংস্থান নিয়ে ভাবতে বসলাম। শারমীন জানাল, সে আলাদা করে জমাবে। বছর তিনেকের মধ্যে যা জমল, তা দিয়ে দুজনে আরামে পাঁচ থেকে ছয়টি দেশ ভ্রমণ করতে পারতাম। কিন্তু জমানো সে টাকাও অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণব্যয়ের অর্ধেক। তবে সে সমস্যারও সমাধান হলো।
ভ্রমণ খরচের অর্ধেকটা ঋণ নিয়ে পুরোটা জমা দিয়ে দিলাম। যাত্রার সময় বাকি তখনো দেড় বছর। এত সময় আগেই সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের মূল কারণ, ছাড় আর বাড়তি সুযোগ-সুবিধা। আমরা যেতে চাই সিলভার সি ক্রুজ লাইনের সঙ্গে। সার্ভিস, এক্সপেডিশন, লাক্সারি আর অতীতের গেস্ট রিভিউ থেকেই বুঝলাম, সিলভার সির র্যাঙ্কিং বেশ ওপরে।
২০২০ সালের নভেম্বরে ক্রুজ ছাড়ার সময়। বছরটা পৃথিবীর জন্য অস্থিরতার এক সময়। করোনা মহামারি শুরু হলো। চারদিক বন্ধ হতে থাকল সব যাতায়াত।
বছরের মাঝামাঝি খবর এল আমার মায়ের অসুখ। চিকিৎসক জানান, সময় হয়তো বেশি বাকি নেই। অ্যান্টার্কটিকা ট্রিপ বাতিল করে ২০২১ সালে নিয়ে এলাম।
যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি অনেক। কোভিড টেস্ট, গভর্নমেন্ট রেগুলেশন—বেশ লম্বা তালিকা। প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে যেতে হবে। কখনো বিদেশ ভ্রমণে এতটা চাপ অনুভব করিনি। ভয় বাড়ছে, যদি কোথাও আটকে যাই। জাহাজে ওঠার আগে শুধু কোভিড টেস্ট করতে হলো তিনবার—উড়োজাহাজে ওঠার আগে, চিলির বিমানবন্দরে নামার পর, জাহাজে ওঠার আগে। দুজনের একজনের শুধু একবার পজিটিভ এলেই যাত্রা শেষ। বেশ সাবধানেই ছিলাম, পরিকল্পনার কোনো কিছুই বাদ রাখিনি। এত ঝক্কি–ঝামেলার কারণেই বিশ্বাস হচ্ছিল না আদৌ যাওয়া হবে কি না। পুন্তা এরিনাতে জাহাজ যখন বন্দর ছেড়ে যায়, সেই প্রথম বুঝলাম, আমরা সত্যিই যাচ্ছি অ্যান্টার্কটিকায়।
সমুদ্রপথে পুন্তা এরিনা থেকে অ্যান্টার্কটিকা উপদ্বীপে যেতে সময় লাগবে দুই দিনের বেশি। সমুদ্রের এই অংশের নাম ড্রেক প্যাসেজ। পৃথিবীর সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকেরা অবগত আছেন ড্রেক প্যাসেজ নিয়ে। সমুদ্রের ভয়ংকর এক অংশের নাম ড্রেক। অ্যান্টার্কটিকার শীতল আর প্যাসিফিক থেকে আসা উষ্ণ জল মিলিত হয়ে যেন একই বোতলের মুখ থেকে বের হয়ে আসে। ইউটিউবের কল্যাণে ড্রেক পাড়ি দেওয়া সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা ছিল। শারমীনের সি-সিকনেস আছে, ড্রেকের ঢেউ ভেঙে জাহাজের ওঠানামা সে হয়তো নিতে পারবে না। তাই শারমীন তো বটেই, আমিও সি-সিকনেস মেডিকেশন নিচ্ছিলাম। প্রথম রাত শান্ত থাকলেও দ্বিতীয় রাতে ড্রেকের সত্যিকার রূপ দেখলাম। সমুদ্রগামী জাহাজে চেয়ার–টেবিল শিকল দিয়ে মেঝের সঙ্গে বাঁধা থাকে। সারাটা রাত এপাশ-ওপাশ করল জাহাজ, মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে শূন্য থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে ধাক্কা দিচ্ছে সমুদ্রজল। একটু আগেই বমি করেছে শারমীন। এখন হাত–পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে, বিছানা ছেড়ে ওঠার অবস্থা নেই। সারা রাত জেগে আমি ভাবছি, ভুল করলাম না তো, না এলেই ভালো ছিল। আচ্ছা এই লোহার টুকরা জাহাজ যদি এখন ডুবে যায়, কী হবে? আমি জানি ভয়টা অমূলক, আমরা আছি একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এক জাহাজে। টেকনোলজি, কমিউনিকেশন, অভিজ্ঞ নাবিকের হাতেই জাহাজের নিয়ন্ত্রণ। তবু ভয় কাটে না।
সকালে ড্রেক আবার শান্ত। দিনটা কেটে গেল বিভিন্ন বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ওপর। অ্যান্টার্কটিকায় যাচ্ছি, নামতে হবে বিভিন্ন জায়গায়। অ্যান্টার্কটিকা মনুষ্যবাসের উপযোগী নয়। প্রয়োজনীয় পোশাক, পায়ের বিশেষ বুট, হাতের গ্লাভস পরার নিয়ম থেকে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই জানার আছে। জাহাজ ছেড়ে নামতে হবে জোডিয়াক বোটে (ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকা)। প্রতি জোডিয়াকে থাকবে সাত কি আটজন। অ্যান্টার্কটিকা জনবসতিহীন মহাদেশ। কখন কোথায় নামা যাবে, তা নির্ভর করে চারটি পরিস্থিতির ওপর—বাইরের তাপমাত্রা, বাতাসের গতিবেগ, সমুদ্রের পরিস্থিতি, উপকূলে বরফের অবস্থা।
আগে থেকে আনুমানিক কিছু ভ্রমণসূচি থাকলেও প্রতিদিন সেটা বদল হতে থাকে। জাহাজ থেকে ওঠানামার সময় পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কঠিন কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। বরফে তো কোনো ধুলাবালু নেই, তাহলে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা কেন? প্রতিবার জাহাজ ছেড়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার সময় সবাইকে স্যানিটেশন স্টেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পায়ের বুট কেমিক্যাল ও পানি দিয়ে ধুতে হয়, মেশিনে ব্রাশ করে যেকোনো ছোট কণা দূর করা হয়। এসবের মূল কারণ অ্যান্টার্কটিকাকে রক্ষা করা। পৃথিবীর অন্য কোনো অংশের কোনো জৈবিক কণা যেন এখানে প্রবেশ না করে; শুধু তা–ই নয়, অ্যান্টার্কটিকার এক অংশের কোনো কিছু যাতে অন্য অংশে যেতে না পারে। অ্যান্টার্কটিকার কোনো অংশে একই সঙ্গে দুটি জাহাজ ভ্রমণ করতে পারবে না, একই অংশে ১০০ জনের বেশি মানুষ নামতে পারবে না। সবকিছুই করা হয় অ্যান্টার্কটিকার প্রাণিকুল যেন নিজস্ব আবাসে সুস্থ থাকতে পারে, মানুষের উপস্থিতি যাতে কোনো প্রভাব না ফেলে। এগুলো নিয়মাবলির ছোট অংশ মাত্র। পৃথিবীর এই প্রান্তে ভ্রমণ করতে হলে অনেক নিয়মের মধ্য দিয়েই করতে হয়।
আজ ড্রেক বেশ শান্ত, রাতে ঘুমও হলো ভালো। সকালে ঘুমের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ঘোষণা ভেসে এল—শুভ সকাল, আমরা অ্যান্টার্কটিকা উপদ্বীপে পৌঁছে গেছি, জাহাজ এখন সাউথ শেটল্যান্ড আইল্যান্ডে আছে।
যখন বাসায় থাকি, প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় ফোনের অ্যালার্ম বাজতেই থাকে, ঘুম আর ভাঙে না। আজ ঘোষণা শুনতেই শুয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠল। বিছানা ছেড়ে চটজলদি গায়ে কয়েক স্তর পোশাক পরে নিলাম, বাইরে নিশ্চয়ই অনেক ঠান্ডা। শারমীন ঘুমাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় বেচারির ওপর অনেক ধকল গেছে।
আমাদের রুম লাগোয়া ব্যালকনিতে গেলাম। ভারী পর্দা লাগানো কাচের স্লাইডিং দরজা, পর্দা সরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। না–ধোয়া ঘুমচোখে আমি কি স্বপ্ন দেখছি! জাহাজ খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, শব্দহীন চারপাশ। এসব কুয়াশা না মেঘ, বুঝতে পারছি না। পানিতে ভেসে যাচ্ছে জাহাজের চেয়ে বড় আকৃতির আইসবার্গ, অসংখ্য, ছোট–মাঝারি। কাছেই তো উপকূল, মেঘের চাদরে ঢেকে আছে সাদা পাহাড়ের গা। কোনোটা উঁকি দিচ্ছে। উপকূল থেকে দূরেই আছি, তবু মনে হচ্ছে কাছঘেঁষা। বিশালত্বের অন্য এক রূপ। দূরে থাকলেও মনে হয় এই তো ছোঁয়া যাবে। স্বপ্ন নয়, আমি এসে গেছি, আমি আছি অ্যান্টার্কটিকায়।