প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘নদী দিবস’। দেশে দিবসটি পালন শুরু করেছিল ‘রিভারাইন পিপল’। নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠনটির নানা উদ্যোগ সম্পর্কে জেনেছেন সজীব মিয়া
প্রতি পূর্ণিমার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে নদীর পাড়ে চলে যেতেন তাঁরা। নৌকায় করে ভেসে বেড়াতেন রাতভর। নদীপাগল এই বন্ধুরা নিজেদের পরিচয় দিতেন ‘রিভার লাভিং পিপল’। নৌকায় ভাসতে ভাসতেই দেখতেন নদীপারের মানুষের জীবন। আর দেখতেন নদীদূষণ, দখলে হারিয়ে যাওয়া নদীপাড়। কিন্তু কী করা যায়, ভাবতেন তাঁরা। এই কিছু করার সংকল্প থেকেই দলটির শেখ রোকনের উদ্যোগে ‘রিভার লাভিং পিপল’ একসময় হয়ে যায় ‘রিভারাইন পিপল’। সেটা ২০০৪ সালের কথা।
পেশায় সাংবাদিক শেখ রোকন এখন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব। তাঁর কাছেই সংগঠনটির যাত্রার গল্প শুনছিলাম, ‘২০০৯ সালের দিকের কথা। তখনো ফেসবুকের একটি গ্রুপকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছিল রিভারাইন পিপল। গ্রুপটিতে সক্রিয় অনেককেই তখনো আমি সামনাসামনি দেখিনি। ফেসবুকে, ই–মেইলে, ফোনেই কথাবার্তা, যোগাযোগ। অনলাইন গ্রুপটিকে কীভাবে অফলাইনে সক্রিয় করা যায়, সেই প্রচেষ্টা চলছে। সবাই একমত হলাম, একদিন অফলাইনে বসা দরকার।’
কিন্তু কোন দিন? সেই দিনটি খুঁজতে গিয়েই নদী দিবসের সন্ধান পান শেখ রোকন। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার (এখন চতুর্থ রোববার) বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া (বিসি) ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। দেশটির নদীবিষয়ক খ্যাতনামা আইনজীবী মার্ক অ্যাঞ্জেলো দিনটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মার্ক অ্যাঞ্জেলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন রোকন। তাঁর পরামর্শেই বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নদী দিবস পালন শুরু করে রিভারাইন পিপল। সেদিনই প্রথমবারের মতো রিভারাইন পিপলের সদস্যদের সামনাসামনি দেখা।
সেই শুরু। বর্তমানে সারা দেশে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির শতাধিক শাখা আছে। এই শাখাগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কোনো না কোনো নদীকে কেন্দ্র করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে কার্যক্রমগুলোকে এখন রিভার কনজারভেশন ক্লাব (নদী সুরক্ষা ক্লাব) নামে পরিচালনা করা হচ্ছে। রিভারাইন পিপল নদী নিয়ে সচেতনতার পাশাপাশি গবেষণা, নদী নিয়ে সাময়িকী প্রকাশসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে নদী অলিম্পিয়াডেরও আয়োজন করে চলেছে। নদী দিবসে রিভারাইন পিপলের সদস্যরা নিচ্ছেন নদী রক্ষার শপথ।
দেওনাইপাড়ে উৎসব
নীলফামারীর একটি নদী দেওনাই। এই নদীর একটি শাখা ডোমার উপজেলার হরিণচড়া ও সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। এই শাখা নদীটিও দেওনাই নামেই পরিচিত। ২০১৭ সালে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মানুষ নদীটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাঁরা সমিতি গঠন করে সামান্য কিছু মাছ নদীতে ছেড়ে দিয়ে সাধারণ জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ করে দেন। শুধু মাছ ধরা বন্ধ করেই চুপ ছিলেন না তাঁরা, বাঁশের বেড়া দিয়ে নিজেদের সীমানা চিহ্নিত করারও চেষ্টা করেন। যে নদীর পারে যুগ যুগ ধরে বাস করে আসছেন গ্রামবাসী, যে নদীর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁদের দৈনন্দিন জীবন, সেই নদীতেই যখন তাঁদের নামতে দেওয়া হচ্ছিল না, তখন ফুঁসে উঠলেন তাঁরা, হলেন ঐক্যবদ্ধ। এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করলে সংঘর্ষ বাধল। গ্রামবাসীর নামে থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেন প্রভাবশালীরা। নদীতে সর্বসাধারণের মাছ ধরা বন্ধ করে দিল প্রশাসন। ঠিক সেই সময় এগিয়ে আসে রিভারাইন পিপল। দেওনাই রক্ষায় স্থানীয় লোকজনদের যুক্ত করে গঠন করে ‘দেওনাই সুরক্ষা কমিটি’। এই কমিটির তৎপরতায় এগিয়ে আসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
২০১৯ সালে দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পায় দেওনাই। অন্যায়ভাবে যাঁরা মাছ ছেড়ে দিয়ে নদীর দখল নিতে চেয়েছিলেন, তাঁরা পিছু হটেন। নদীতে আবার মাছ শিকার শুরু করেন সাধারণ জেলেরা। এই নদী রক্ষায় যুক্ত ছিলেন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ। তিনি বলছিলেন, ‘নদী উদ্ধারের এ রকম ঘটনা খুব কম। দেওনাই উদ্ধারের পর এলাকাবাসী নিজেরা চাঁদা দিয়ে উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। নদী রক্ষা কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি চাঁদার ব্যাপারটি জেনে কমিশন থেকেই পরে উৎসবের খরচ বহন করেছিলেন। নদী–কর্মীদের জন্য সে এক আনন্দের দিন ছিল।’
শুধু দেওনাই নয়, রংপুর বিভাগের আরও কিছু নদী রক্ষায় কাজ করেছে রিভারাইন পিপল। কোনোটা উদ্ধারে সফল হয়েছে, কোনোটার প্রবাহ ফেরাতে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে রিভারাইন পিপল।