নর্থ সাউথের উপাচার্য: একটি বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ করছি

‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ (টিএইচই) প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং ২০২৩’ অনুযায়ী ৬০১-৮০০ ক্রমের মধ্যে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। এ নিয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আতিকুল ইসলাম–এর সঙ্গে কথা বলেন মোছাব্বের হোসেন

আতিকুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

র‍্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানের জন্য আপনাকে অভিনন্দন। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় নর্থ সাউথ কেন আলাদা?

ভালো অবস্থান বা রেপুটেশন নির্ভর করে ভালো শিক্ষকের ওপর, ভালো রিসার্চ বা গবেষণার ওপর। আমরা সেটিতে গুরুত্ব দিয়েছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরি পায়। কারণ, আমরা তাদের ভালো প্রশিক্ষণ দিই। মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। নর্থ সাউথের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে ন্যূনতম একটি ভালো মানের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হয়। দুই বছর বিদেশে পড়লেই যে তাঁরা ভালো শিক্ষক হবেন, বিষয়টা তা নয়। দেশের বাইরে থাকলে চিন্তা-চেতনা বদলে যায়। তাঁরা নতুন নতুন বিষয় শেখেন। ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন, যে অভিজ্ঞতা তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিনিময় করতে পারেন।

শিক্ষক হিসেবে যাঁরা এখানে যোগদান করেন, তাঁদের কিন্তু আমরা প্রথমেই ক্লাস নিতে পাঠাই না। প্রথমে খুব ভালো প্রশিক্ষণ দিই। এমনকি যদি কেউ সরাসরি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন, তাঁকেও আমরা প্রশিক্ষণ ছাড়া ক্লাস নিতে দিই না। প্রতিটি সেমিস্টারের আগে ভালো প্রশিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অনেকে মনে করতে পারেন, এটা তেমন কিছু নয়। কিন্তু এটা করার কারণে অনেক পরিবর্তন আসে। একজন ভালো ফল করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছেন বলেই তিনি ভালো শিক্ষক হবেন, আমরা সেটা মনে করি না। এ জন্য সময়ে সময়ে আমরা শিক্ষকদের দক্ষতা হালনাগাদ (স্কিল আপগ্রেড) করি। এটাই আমাদের শক্তি। পড়াশোনা শেষে একটা ভালো চাকরি পাবে—এ প্রত্যাশা নিয়েই একজন শিক্ষার্থী আমাদের কাছে আসে। আমরা সেটা বুঝি এবং সেটা মাথায় রেখেই শিক্ষকদের গড়ে তুলি।

শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য আপনাদের কি কোনো বিশেষ নীতি আছে?

টেবিল–চেয়ারে বসে একটা চিন্তার জগৎ থেকে কেউ গবেষণা করবেন—সেটা আমরা চাই না বা হতে দিই না। আমরা চাই মাঠপর্যায় থেকে জ্ঞান নিয়ে ভালো একটি গবেষণা হবে, যা মানুষের কাজে লাগবে। সে জন্য শিক্ষকদের নানাভাবে সহায়তা করা হয়। সরকার থেকে শুরু করে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, এমনকি আন্তর্জাতিক বড় প্রতিষ্ঠানও গবেষণার জন্য আমাদের সহযোগিতা দেয়। নাসা থেকে শুরু করে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় বা জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের গবেষকদের গবেষণার ওপর আস্থা রাখে। বড় বড় জার্নালে আমাদের শিক্ষকদের প্রকাশনা আছে। শিক্ষকেরা খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে যে বড় বড় গবেষণা অনুদান পাচ্ছেন, তা আমাদের মানের কারণেই। আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছি। ভালো আর্থিক পুরস্কারের ব্যবস্থাও আছে। এ ছাড়া যাঁরা ভালো গবেষণা করছেন, ক্লাসের জন্য তাঁদের ওপর চাপ না দিয়ে বরং ক্লাসে কমিয়ে গবেষণার সুযোগ করে দিই। এতে তিনি যেমন লাভবান হন, তেমনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের শিক্ষার্থীরাও লাভবান হচ্ছে।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

গবেষণার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খোলা রেখেছি। আমাদের ক্যাম্পাসের বাইরের যে কেউও গবেষণার প্রস্তাব দিতে পারেন। প্রস্তাব ভালো হলে যত প্রয়োজন, আমরা ব্যয় করব। অনেক সময় প্রশ্ন উঠেছে, আমরা গবেষণায় কত খরচ করেছি। আসলে খরচ দিয়ে গবেষণার মূল্যায়ন করা যাবে না। কম খরচেও ভালো গবেষণা করছি কি না, সেটাই আসল কথা এবং আমরা সেটি করেছি। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিকে একটি বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করছি।

র‌্যাঙ্কিংয়ে এগোনোর ক্ষেত্রে কি কোনো বিশেষ পরিকল্পনা ছিল?

এটা এক দিনে হয়নি। আমরা ধীরে ধীরে নিজেদের তৈরি করেছি। ২০১৬ সালে এখানে যোগদান করে দেখি, র‌্যাঙ্কিংয়ের ওপর এখানে গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। বিভিন্ন র‌্যাঙ্কিং পর্যালোচনা করে দেখলাম, কোথাও নর্থ সাউথের অবস্থান নেই। ভালো কোনো জার্নালেও নর্থ সাউথ নেই। তখন শিক্ষক ও বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে কাজ শুরু করলাম। টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রসঙ্গে বলব, এখানে স্থান পাওয়া কিন্তু সহজ নয়। কিউএস ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং সামনে রেখে প্রথমে কিউএস এশিয়া র‌্যাঙ্কিংয়ে থাকার চেষ্টা করলাম। এশিয়াতে আমরা তখন ৫৫০ র‌্যাঙ্কিং পেলাম। পরের বছর একই র‌্যাঙ্কিংয়ে থাকলাম। এভাবে একটা পর্যায়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম। টাইমস হায়ার এডুকেশনে আমাদের যেতেই হবে—এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। বেশ কিছু লক্ষ্য ঠিক করা হলো। শিক্ষকদের ডেকে গবেষণায় মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেওয়া হলো। একপর্যায়ে আমরা টাইমস হায়ার এডুকেশনকে আমন্ত্রণ জানালে ২০১৯ সালে তারা এখানে এসে ঘুরে গেল। তারা বলল, অনেক পরিশ্রম করলেও ২০২৫ সালের আগে আমরা টাইমস হায়ার এডুকেশনের তালিকায় ঢুকতে পারব না। তারা এ-ও বলল, আমাদের যোগ্যতা আছে, কিন্তু আরও অনেক কাজ বাকি। তখন আমরা আরও বেশি ভালো কাজে মনোযোগ দিলাম। ২০২১ সালের টাইমস হায়ার এডুকেশন কর্তৃপক্ষ আমাদের কাজ আবার মূল্যায়ন করে। পরের বছর আমরা সারা বিশ্বের ৬০১ থেকে ৮০০ র‍্যাঙ্কিংয়ে উন্নীত হই। সারা বিশ্বে টাইমস হায়ার এডুকেশন ৫১টি দেশ থেকে সেরা ১ হাজার ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করে। এ বছরও ১ হাজার ৭৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করেছে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিংশতম সমাবর্তন

নর্থ সাউথের পুরোনো শিক্ষার্থীদের অনেকেই ভালো অবস্থানে আছেন। কে কোথায় আছেন, কী করছেন...সেসব কি আপনারা জানেন?

অনেক তথ্য আমাদের কাছে আছে। অস্ট্রেলিয়া বা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় আমাদের অ্যালামনাইদের সদস্যরা আছে। সেখানে নতুন কেউ গেলে অ্যালামনাইরা সহায়তা করে। এটা এখনো ওয়েবসাইটে আসেনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেন্ট্রাল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন করার পরিকল্পনা আছে। এখান থেকে অনুমোদন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অ্যালামনাই শাখা করার ব্যবস্থা করা হবে। দেশের বাইরেও নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীদের সুনাম আছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, পড়াচ্ছে। নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিও পাচ্ছে।

নর্থ সাউথে শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকটি ক্লাব সক্রিয়। ক্লাবগুলোকে আরও এগিয়ে নিতে কোনো পরিকল্পনা আছে?

ক্লাবগুলো বেশ ভালো কাজ করছে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ক্লাব বেছে নিতে পারে। কেউ শিল্পী হতে চায়, কেউ অভিনেতা হতে চায়, আবার কেউ পড়াশোনাকেন্দ্রিক সংগঠন পছন্দ করে। এ জন্য নানা ধরনের ক্লাব আছে। ক্যারিয়ার কিংবা সৃজনশীলতা—দুটির চর্চা করারই সুযোগ আছে। আমাদের ক্যাম্পাসে ২২টা ক্লাব আছে। এসব ক্লাবকে আমরা সব সময় সমর্থন দিই। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। এগুলোয় শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারে।

পয়লা বৈশাখে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজন

অনেকে বলেন, আপনাদের ক্যাম্পাসে ধারণক্ষমতার তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। এটা কি ঠিক?

এ কথা ঠিক যে বর্তমানে আমাদের শিক্ষার্থী কিছু বেশি। তবে আমরা এখন আর বেশি শিক্ষার্থী নেব না। এ বছর আমাদের এখানে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। পড়ার সুযোগ পেয়েছে মাত্র ১ হাজার ৮০০ জন। এই যে ৫ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিল, সবাইকেই নিয়ে নিতে পারতাম। কারণ, ভর্তির যোগ্যতা আছে বলেই তারা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে, তারা প্রতিবছর ২০০ চীনা শিক্ষার্থী পাঠাতে চায়। আমরা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করিনি। কারণ, আমরা এখন মানের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ধারণা থেকে সরে এসেছি।

সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।