চোখ না থাকলে দুনিয়া অন্ধকার। কারণ, চোখ দুটি দিয়েই তো আমরা পৃথিবীটা দেখি। তাহলে এই প্রশ্ন উঠল কেন? কথাটা শুনতে কেমন যেন লাগছে, তাই না?
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, আসল সত্য হলো আমরা চোখ দিয়ে দেখি না। চোখ আমাদের দেখতে সাহায্য করে। ব্যাপারটা খুলেই বলি। আমাদের চোখের কাজ হলো ডানে, বাঁয়ে, ওপর, নিচে ঘুরিয়ে যাবতীয় বস্তু থেকে বিকিরিত আলো ধারণ করে তার প্রতিচ্ছবি মস্তিষ্কের দৃষ্টিকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া।
বিষয়টি বোঝার আগে চোখকে কল্পনায় দুটি বস্তুর সঙ্গে তুলনা করতে হবে। ১. ছবি তোলার ক্যামেরার সঙ্গে। ২. টিভি অ্যান্টেনা এবং ঘরের টেলিভিশন সেটের সঙ্গে। প্রাত্যহিক জীবনে সবকিছু দেখার সঙ্গে এই দুটি জিনিসের তুলনা করা চলে।
ক্যামেরা সামনের দৃশ্যমান বস্তুর আলোকরশ্মিকে ধারণ করে বিভিন্ন লেন্সের মাধ্যমে ফিল্মের ওপর ফেলা। তারপর ফিল্মের রাসায়নিক বস্তুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে একটা ছবি ধারণের অবস্থা তৈরি হয়। সেই ফিল্ম ল্যাবে নেওয়ার পর বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিস্ফুটন করে ছবিটা কাগজে ফুটে ওঠে। এই উদাহরণ পুরোনো আমলের লেন্স ক্যামেরার বেলায় প্রযোজ্য। এখনকার স্মার্টফোন বা ডিজিটাল ক্যামেরার বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। তাই এই উদাহরণের বেলায় একটু অবাক হওয়ার বিষয় আছে। বিশেষ করে যাঁরা এই প্রজন্মের।
টেলিভিশনের অ্যান্টেনা যুক্ত থাকে উপগ্রহের সঙ্গে। এই উপগ্রহের পাঠানো তরঙ্গের মাধ্যমে গৃহীত ছবি তারের সাহায্যে টিভি সেটে প্রবেশ করে। বিভিন্ন সার্কিটের মাধ্যমে ছবির তরঙ্গ পরিস্ফুটিত হয়ে ফুটে ওঠে পর্দায়। তাহলে বোঝা গেল ক্যামেরা ছবি ধারণ করে ও বিশেষ প্রক্রিয়ায় ল্যাবে পরিস্ফুটনের পর ছবি সৃষ্টি হয়। আর টিভি আকাশ থেকে তরঙ্গ গ্রহণ করে ও বিশেষ সার্কিটের সাহায্যে পরিস্ফুটিত হওয়ার পর ছবি দেখা যায়।
আমাদের চোখেও তেমন লেন্স আছে, যা সংকোচন–প্রসারণের মাধ্যমে চোখের পেছনের রেটিনা বা অক্ষিপটের ওপর পড়ে। রেটিনা ১০ পর্দাবিশিষ্ট বিশেষ ধরনের কোষের সমন্বয়ে গঠিত। যেখানে আলো রাসায়নিক (ফনোকেমিক্যাল) বিক্রিয়ায় প্রাথমিক ছবি তৈরি হয়। তারপর ক্যামেরার ফিল্মের মতো অপটিক স্নায়ু মারফত মাথার মগজে প্রবেশ করে এবং মাথার পেছনে যেতে থাকে। শেষমেশ মাথার পেছনে দৃশ্যমান এলাকায় (ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স) পৌঁছে অজানা প্রক্রিয়ায় পরিস্ফুটন হলেই আমরা সেই দৃশ্য দেখতে পাই।
তাহলে সংক্ষেপে বলা যায়, চোখ ক্যামেরার মতো ছবি ধারণ করে আর মস্তিষ্ক টেলিভিশনের মতো ধারণ করা ছবিকে দৃশ্যমান করে তোলে। তাই মাথার পেছনে আঘাত বা মগজের পেছন দিকে যেকোনো রোগ হলে চোখ ভালো থাকলেও অন্ধত্বের মতো ঘটনা ঘটে।
মগজে আরও একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে। ক্যামেরার ফিল্মে লেন্সের কারণে যেমন যাবতীয় ছবি উল্টাভাবে ধারণ হয়, তেমনি চোখের রেটিনাতেও সমস্ত ছবি উল্টাভাবে ধারণ হয়। মজার বিষয় হলো, এই উল্টা করে ধারণকৃত ছবি মগজে প্রবেশের পর এক অজানা কারণে সোজা হয়। এ জন্য আমরা সবকিছু সোজা ও স্বাভাবিক দেখি।
তার মানে হলো, আমরা আদতে চোখ দিয়ে দেখি না। চোখ আমাদের দেখতে সাহায্য করে। আমরা মূলত মস্তিষ্ক দিয়েই দেখি।
ডা. আহসান কবির: চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও ফেকো সার্জন, কনসালট্যান্ট, যশোর চক্ষু ক্লিনিক ও ফেকো সেন্টার, যশোর