বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ১৮ আগস্ট থেকেই ক্লাস শুরু করেছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ১৮ আগস্ট থেকেই ক্লাস শুরু করেছে।

নতুন শুরুর প্রত্যয়ে ক্যাম্পাসে ফিরছেন শিক্ষার্থীরা

এবারের ফেরাটা অন্য রকম।

দীর্ঘ বন্ধের পর ক্যাম্পাসে ফেরার অভিজ্ঞতা তো শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন নয়। প্রায় দেড় বছর ক্লাসে পা না রাখতে পারলে কেমন লাগে, সেই অভিজ্ঞতাও তো দিয়ে গিয়েছিল করোনাকাল। তবে হ্যাঁ, এবারের ফেরাটা সত্যিই অন্য রকম। জুলাইজুড়ে দেশে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। মাস দুই আগেও হয়তো ক্যাম্পাসের আনাচকানাচে রাজনৈতিক আলাপ খুব একটা চোখে পড়ত না। এখন যেকোনো আড্ডায় কান পাতলেই বুঝবেন, ছেলেমেয়েরা বেশ রাজনীতিসচেতন। অনেক ভয়-শঙ্কা-রোমাঞ্চ পেরিয়ে, অনেকগুলো তাজা প্রাণ হারিয়ে নতুন করে ক্যাম্পাসে ফিরেছেন শিক্ষার্থীরা। নতুন শুরুর প্রত্যয়ে।

গান, নীরবতা, স্মৃতিচারণা

এখনো সব বিশ্ববিদ্যালয় পুরোদমে ক্লাস শুরু করতে পারেনি। কোথাও কোথাও প্রশাসনিক অবস্থা এখনো টালমাটাল। কোথাও–বা অনলাইনে চলছে ক্লাস।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ১৮ আগস্ট থেকেই ক্লাস শুরু করেছে। সেদিন পতাকা উত্তোলন, সম্মিলিত কণ্ঠে গান আর শপথ পাঠের আয়োজন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য শামস্‌ রহমানসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা গেয়েছেন, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে/কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে।’ বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সমাজ গড়ে তোলার বার্তাই উঠে এসেছে এ আয়োজনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী পুনম শাহরিয়ার। বললেন, ‘এই আন্দোলনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। আমরা এ আয়োজনে পতাকা উত্তোলনের পর সবাই শপথ গ্রহণ করেছি, যেন সততার সঙ্গে দেশের সেবা করতে পারি। ন্যায় ও সাম্যের মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে, যেকোনো ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারি।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ক্লাস শুরু হয়নি। তবে কয়েকটি বিভাগ নিজেদের উদ্যোগে ক্লাস নিচ্ছে। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেমন ক্লাসের শুরুতেই নীরবতা পালনের পর কবিতা ও গানে শহীদদের স্মরণ করেছেন। প্রথম ক্লাসের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বিভাগের শিক্ষার্থী শামীমা জান্নাত বলেন, ‘প্রায় তিন মাস পর আমাদের ক্লাস শুরু হলো। তবে এ ক্লাসটি অন্য দিনের ক্লাসগুলোর মতো ছিল না। শুরুতে আমরা আমাদের শহীদ ভাইবোনদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছি। এরপর সবাই মিলে গেয়েছি মুক্তির মন্দির সোপানতলে, ধনধান্য পুষ্প ভরা ইত্যাদি। এই গানগুলো গাওয়ার সময় অন্য রকম একটা অনুভূতি কাজ করে। যে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নে শহীদেরা তাঁদের জীবন ত্যাগ করেছেন, আমরা যেন তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সারথি হই।’

আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই নিহত হন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন এবং যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মো. রাকিবুল হোসেন। তাঁদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত মিলনায়তন ও মুক্তমঞ্চের নামকরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এমআইএসটির কেন্দ্রীয় পাঠাগারে স্থাপন করা হয়েছে শহীদ ইয়ামিন-শহীদ রাকিবুল কর্নার। ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির শ্রেণি কার্যক্রম। ক্লাস শুরুর দিনে সহপাঠীদের স্মৃতিচারণা করেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তড়িৎ, ইলেকট্রনিকস ও যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী রাইসুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অনেকে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছি। শহীদ ভাইদের নিয়েও কথা হয়েছে।’

৫ সেপ্টেম্বর ছবিটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তোলা

শিক্ষকেরা পাশে আছেন

আন্দোলনটা শিক্ষার্থীদের হাত ধরে শুরু হলেও পরে শিক্ষকদের সংহতি একে আরও বেগবান করেছে। ফলে নতুন করে ফেরার পর ছাত্র–শিক্ষক সম্পর্কও একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ আমরাও তাঁকে ক্লাসে স্মরণ করেছি। তবে লম্বা সময় পরে ক্লাসে ঢুকে আমি শিক্ষার্থীদের নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। দেশ সংস্কারে তাদের মধ্যে যে উদ্দীপনা দেখেছি, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমি বিশ্বাস করি, জেনারেশন জি–র হাতেই আগামীর বাংলাদেশ। নিজেদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত বৈষম্যবিরোধী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ তাদের হয়েছে। সবচেয়ে ইতিবাচক বিষয় হলো, ক্লাসে প্রায় সব শিক্ষার্থীই নতুন দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বেশ উজ্জীবিত। আমরা এই শক্তিরই ইতিবাচক প্রতিফলন দেখতে চাই।’