নদী মানেই তো শীতল জলের অবিশ্রান্ত প্রবাহ। তীব্র শীতের দেশে জলাশয়ের পানি জমে বরফ হয়ে যায়, সে কথাও আমরা জানি। কিন্তু ফুটন্ত পানির প্রাকৃতিক স্রোত! সে আবার হয় নাকি?
পৃথিবীর ‘একমাত্র ফুটন্ত পানির নদী’র নাম শানায়-তিমপিশকা। ‘সূর্যের তাপে ফুটন্ত’ বোঝাতেই এমন নামকরণ। ‘লা বম্বা’ নামেও ডাকা হয় চার মাইল লম্বা এই নদীকে। দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত নদী আমাজনের এই শাখানদীটি চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য সবার হয় না।
নদীটি বয়ে চলেছে মূলত পেরুর বুক চিরে। আর অঞ্চলটি শামান জাতির নিয়ন্ত্রণে। প্রাকৃতিকভাবেই শানায়–তিমপিশকা নদীটি ৬০ ফুট লম্বা উদ্ভিদের বিস্তীর্ণ সবুজ অরণ্যের মধ্যে সংরক্ষিত। রয়েছে পাথরের বেষ্টনীও।
তবে নানা কিছু দিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বনের প্রাণীদের তো আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাই নদীটিতে দুর্ভাগা প্রাণীদের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায় কখনো–সখনো। কারণ, কোনোক্রমে পিছলে গিয়ে শানায়-তিমপিশকায় পড়ে গেলে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফুটন্ত পানিতে দেহ মারাত্মকভাবে পুড়ে যায় ১ সেকেন্ডেরও কম সময়ে। শিউরে ওঠার মতো ব্যাপারই বটে।
স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, এই নদীর নিরাময় ক্ষমতা আছে। তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে এই নদীর পানি পরীক্ষা করেছিলেন আন্দ্রেস রুযো। যুক্তরাষ্ট্র, পেরু ও নিকারাগুয়া—এই তিন দেশের নাগরিক রুযো মূলত ভূপদার্থবিদ। ২০০২ সালে বিখ্যাত ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ ম্যাগাজিন তাঁকে ভূষিত করেছে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ইয়াং এক্সপ্লোরার গ্রান্টি’ হিসেবে।
রুযো ছোটবেলায় দাদার মুখে শুনেছিলেন ফুটন্ত নদী শানায়–তিমপিশকার কথা। রূপকথার মতো শোনা গল্পের সত্যতা যাচাই করতেই পাড়ি জমিয়েছিলেন ওই এলাকায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি দেখেন, নদীটির পানির তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি থেকে প্রায় ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে! নদীর তীরের মাটি এতই তেতে থাকে যে সেখানে পা ফেলার জো থাকে না!
শানায়–তিমপিশকার আশপাশে কোনো সক্রিয় আগ্নেয়গিরি নেই। কোনো ভূতাপীয় ফাটলও খুঁজে পাননি আন্দ্রেস রুয়ো। ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’–এর হয়েই তিনি চালিয়েছিলেন গবেষণাটি। সব দেখেশুনে রুযো একে বলেছে, ‘সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নদী।’ আর এই তাপের উৎস সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ বলেছে, এর পেছনে কাজ করছে পৃথিবীর ভূতাপীয় গ্রেডিয়েন্ট। পৃথিবীর অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান গভীরতার সাপেক্ষে তাপমাত্রার পরিবর্তনের হারকে বলে ভূতাপীয় গ্রেডিয়েন্ট।
গবেষকেরা বলছেন, আমাজন বনের ওপর যে বৃষ্টি ঝরে পড়ে, সেই বৃষ্টির পানি বনটির গাছপালার গভীর মূল দিয়ে পৌঁছে যায় পৃথিবীর ‘ক্রাস্ট’ বা বহিরাবরণের তলদেশে। আর ওই ভূতাপীয় গ্রেডিয়েন্টের প্রভাবে তা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ধারণা করা হয়, এই উত্তাপের কারণেই শানায়–তিমপিশকার পানি ফুটছে টগবগ করে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া