‘বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে চাও?’
প্রশ্ন শুনে অনেকেই বুঝে কিংবা না বুঝে চট করে উত্তর দিয়ে ফেলে, ‘বিবিএ’।
কেউ হয়তো বড় ভাই বা বোনকে বিবিএ পড়তে দেখে মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারও উচ্চমাধ্যমিকের বিভাগ ব্যবসায় শিক্ষা বলে তিনি মনে মনে ধরেই নিয়েছেন, বিবিএ ছাড়া আর পথ নেই। আবার ব্যাংকার, করপোরেট চাকরিজীবী কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়েও অনেকে বিবিএ পড়তে চান। আদতে বিবিএ কাদের জন্য? বিবিএ পড়ার আগে কী কী জেনে রাখা দরকার। শিক্ষক, সদ্য স্নাতক, উদ্যোক্তা, করপোরেট ব্যক্তিত্বদের কাছে তা-ই জানতে চেয়েছিলাম আমরা।
উত্তরটা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহযোগী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এটা সত্যি, বাংলাদেশের অভিভাবকদের একটা বড় অংশই নিজেদের সন্তানকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চান। এটা চাওয়াও স্বাভাবিক। কারণ তাঁরা এই দুই পেশার মানুষকে বেশি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেন। কিন্তু আমাদের সব পেশার মানুষই দরকার। ধরুন, একজন প্রকৌশলী কিছু উদ্ভাবন করল বা একটা পণ্য তৈরি করলেন, কিন্তু এই পণ্যের দাম কত হবে, কীভাবে বাজারজাত করতে হবে, কোথায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে একজন বিবিএ গ্র্যাজুয়েট ভালো জানেন। তিনি তো এসব নিয়েই পড়ালেখা করেছেন। ফলে আমাদের যেমন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার দরকার, একই সঙ্গে এমন অনেক মানুষ দরকার, যাঁরা ব্যবসা প্রশাসন ভালো বুঝবেন। তাঁরা নিজেরা ব্যবসা করবেন, অন্যদের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করবেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার দিকটা পরিচালনা করবেন।’
মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে খারাপ করে অনেকেই ভাবেন, ব্যবসায় শিক্ষাই হয়তো আমার জন্য জুতসই। কারণ, এখানে গণিত কম। গণিতকে দুশমন গণ্য করে কি সামনে এগোনো যায়?
অনেকের ধারণা, বিবিএ করতে গেলে হয়তো বিজ্ঞান বা গণিতের তেমন দরকার হয় না। এই ভাবনা সঠিক নয়। যে যেই বিষয়েই পড়ুক, গণিতের মৌলিক জ্ঞানে ভালো হওয়ার বিকল্প নেই। কেন? কারণ, মৌলিক গণিতে দক্ষতা আমাদের বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা করতে সাহায্য করে। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এই বিশ্লেষণ ক্ষমতা দরকার—এমনটাই মনে করেন ঢাবির সহযোগী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ।
তাই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ব্যবসা ও মানবিকের শিক্ষার্থীদেরও মৌলিক গণিতটা ভালো করে শিখে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি। ‘এখন অর্থনৈতিক প্রকৌশল, ফিন্যান্স, বাজার বিশ্লেষণ, সাপ্লাই চেইন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু গণিতের জায়গা আছে। তাই যন্ত্রনির্ভর এই সময়ে গণিত বা তথ্যপ্রযুক্তিতে কিছু জ্ঞান না থাকলে বেশি দূর এগোনো মুশকিল।
বিবিএতে অনেক প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। কথা বলার দক্ষতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইনট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী শিক্ষার্থীরা তাই একটু ভাবনায় পড়ে যান। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রভাষক আফনান ইউসুফ আশ্বস্ত করলেন, ভয়ের কিছু নেই; বরং এটাই নিজেকে তৈরি করার একটা সুযোগ। আফনান বলেন, ‘বিবিএ পড়তে এসে কেউ যদি লুকিয়েও থাকতে চান, তিনি আসলে পারবেন না। কারণ, আমাদের পাঠ্যক্রমই ওভাবে সাজানো। এখানে প্রেজেন্টেশনে একটা বড় নম্বর থাকে। ফলে সে হয়তো শুরুতে ভয় পাবেন, হাত–পা কাঁপবে, কিন্তু একসময় এটা কেটে যাবে। জড়তা কেটে গেলে সেটা দিন শেষে তাঁর জন্যই সুফল বয়ে আনবে।’
একজন বিবিএর শিক্ষার্থীকে প্রতিনিয়ত কেস স্টাডি সমাধান করতে হয়। এটি তাঁকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে, সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি নিজের ভাবনা উপস্থাপনে আত্মবিশ্বাসী হন।
অলাভজনক সংস্থা দ্য আর্থ এবং বিজি–বির প্রতিষ্ঠাতা শাকিলা সাত্তার। এই উদ্যোক্তা এনএসইউ থেকে বিবিএ শেষ করে জার্মানিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন ‘ইনোভেশন, স্ট্র্যাটেজি এবং এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ’ বিষয়ে।
উদ্যোক্তা হতে হলে বিবিএ পড়তেই হবে, শাকিলা সাত্তার এমনটা মনে করেন না। তাঁর ভাষ্য, ‘যে–কেউ উদ্যোক্তা হতে পারেন। অনেকে বিবিএ না পড়েও ভালো কাজ করছেন। তবে উদ্যোক্তা হতে হলে যেসব বিষয়ে অবশ্যই জানতে হয়, সেগুলো বিবিএতে পড়ানো হয়। বিনিয়োগকারীকে নিজেদের পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা, আয় বিবরণী ইত্যাদি দেখিয়ে ফান্ড আনা পর্যন্ত কাজগুলো একজন বিবিএর স্নাতকেরই ভালো জানার কথা।’
এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে লোকবল নিয়োগ দিতে হয়, প্রশিক্ষণ দিতে হয়, সে ক্ষেত্রে মানবসম্পদ বিভাগ লাগে। বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে অপারেশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগ লাগে। পণ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে মার্কেটিং দল লাগে ৷ অর্থাৎ, উদ্যোক্তা হতে চাইলে যা যা জানা জরুরি, প্রায় সবকিছুই বিবিএর পাঠ্যক্রমে পড়ানো হয়।
এই উদ্যোক্তা তাঁর কিছু অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যবসায় একটা পণ্য নিয়ে যখন কাজ করা হয়, এর পেছনে সাপ্লাই চেইনের একটা বড় কাজ থাকে। আমি যখন বিবিএ পড়েছি, সেই সময়ে সাপ্লাই চেইনের বিষয়ে তেমন কিছু পড়ানো হতো না। ফলে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি এবং শিখেছি। তাই উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে যদি কেউ বিবিএতে “এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ” এ মেজর করে, তাহলে তাঁর তাত্ত্বিক জ্ঞান অবশ্যই অন্যদের থেকে তাঁকে এগিয়ে রাখবে।’
বিদেশে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থেকে শাকিলা জানালেন, দেশের বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে সরাসরি বাজারের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মোড়কে কোম্পানিরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের প্রজেক্ট করতে দেয়। এতে কোম্পানি যেমন অনেক আইডিয়া পায়, শিক্ষার্থীরাও বাজারের সত্যিকার পরিস্থিতি জানতে পারেন, ট্রেন্ড বুঝতে পারেন। এর মাধ্যমে লেখাপড়া শেষে তাঁরা বাজারে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এই ধারা চালু করলে শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হবে বলে তিনি মনে করেন।
বিবিএর শিক্ষার্থীর জন্য যোগাযোগের দক্ষতা যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, মনে করিয়ে দিলেন সহযোগী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘শুধু কথা বলতে পারলে হয়তো সেটাকে যোগাযোগ বলা যায়। কিন্তু যিনি আমাকে দেখছেন বা শুনছেন, তাঁকে সহজবোধ্য ভাষায় বোঝানোর মতো উপস্থাপনই হলো যোগাযোগের দক্ষতা। এই দক্ষতা বিবিএর শিক্ষার্থীর জন্য বেশি জরুরি।’
এ বিষয়ে প্রভাষক আফনান ইউসুফ আরও বলেন, ‘যোগাযোগ দক্ষতার সঙ্গে শিষ্টাচার, বিনয়, ভদ্রতা, কথা বলার ভঙ্গির মতো ছোট ছোট বিষয় সম্পর্কিত। একজন শিক্ষক বা একজন সিনিয়রের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে সুসংবাদ বা দুঃসংবাদ জানাতে হয়, একজন বিবিএ শিক্ষার্থীকে আমরা এসব শেখাই। তবে তা বাস্তবায়ন করে যোগাযোগ দক্ষতা তাকেই বাড়াতে হবে। এর বিকল্প নেই।’
ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের টেরিটরি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন মো. মুহতাসিম আল মোরছালিন। করপোরেট নবীন এই বিবিএ স্নাতক জানালেন, ভালো করপোরেট সুযোগ পেতে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই। তিনি বললেন, ‘বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীর সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ক্লাবের সঙ্গে জড়িত থাকা, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, বিতর্কে অংশগ্রহণ ইত্যাদি। মাইক্রোসফট অফিস, জি-সুইট–এর মতো খুঁটিনাটি প্রযুক্তিগত দক্ষতা জানার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাজীবন শেষের আগেই অনেক ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ থাকে। এসব সুযোগ লুফে নিতে হবে।’
ভাষার ওপর দখল থাকতে হবে। বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে ভালো হতেই হবে। পাশাপাশি বাংলাতেও ভালো বলতে ও লিখতে জানতে হবে। কারণ, আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠানকেই সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে শুদ্ধ বাংলা জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রোগ্রামিং জ্ঞান, সফটওয়্যার দক্ষতা বা আইটি–সংক্রান্ত দক্ষতা একজন বিবিএ শিক্ষার্থীকে অনেকখানি এগিয়ে রাখতে পারে।