পূজা চেরী, বুবলীদের সাজান তিনি, কে এই সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট?  

সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট মাহফুজ কাদরী
ছবি: সংগৃহীত

চাঁদপুরের মতলবে ‘অগণিত’ সদস্যের যৌথ পরিবারে কেটেছে ছেলেবেলা। দুই ভাই–বোনের ভেতর বড় মাহফুজ কাদরী। মা–বাবা দুজনেই কাজ করেন আইসিডিডিআরবিতে (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ)। বাবারা ১০ ভাই আর ৪ বোন, ফলে বাড়িতে চাচাতো ভাইবোনদের অভাব ছিল না। দাদি, নানি যাঁকেই পেতেন, জলরং দিয়ে চোখের ওপরে এঁকে দিতেন নকশা। চাচাতো বোনদের সাজিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সুখ্যাতি ছিল।

হাতের কাছে যাঁকেই পেতেন, তাঁকেই জোর করে স্টাইলিং করা, সাজানোর বাইরে আরেকটা জিনিস মাহফুজকে টানত। সেটা হলো নাচ। আর এ সবের কিছুই ভালো লাগত না তাঁর মা–বাবা বা অন্যদের। মাহফুজের ভাষায়, ‘আমাকে যতই বাধা দেওয়া হয়েছে, ততই আমি (ওগুলোতে) আগ্রহী হয়েছি। আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়েছি। আমি আমার মনের কথাই শুনেছি। আর এ কারণেই এখন সেই জীবনটাই যাপন করছি, যেটা একসময় স্বপ্ন দেখতাম।’

পূজা চেরীর সঙ্গে মাহফুজ কাদরী

মহামারিকালে বদলে গেল জীবন

২০১৫ সালে কলেজে পড়ার সুবাদে প্রথম ঢাকা। প্রথম সুযোগেই শিবলী মোহম্মদের কাছে নাচের তালিম নেওয়া শুরু করেন। একই সঙ্গে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেছে বিএসসি আর নাচের কোরিওগ্রাফার হিসেবে পেশাজীবন। ২০১৮ সালে খোলেন ‘কাদরী ড্যান্স গ্রুপ’ আর ব্যাপক সাড়া পান। মহামারিকালে হঠাৎ করেই একটা বিউটি সেলুনে মাহিয়া মাহি ও পূজা চেরীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মাহফুজ কাদরীর ‘সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট’ হিসেবে পথচলার সেখান থেকেই শুরু।

প্রথম ‘অ্যাসাইনমেন্ট’–ই ছিল বিয়েতে মাহিয়া মাহির স্টাইলিং। পূজা চেরীর দুটি লুকে ব্রাইডাল ফটোশুটে স্টাইলিং আর কোরিওগ্রাফির দায়িত্ব নেন। একটি ম্যাগাজিনের জন্য শবনম বুবলীর তিনটি লুকের স্টাইলিং করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানোর কথা নয়, তাকাতে হয়নিও। মাহফুজ বলেন, ‘আসলে মেধা, পরিশ্রমের সঙ্গে মানুষের ভাগ্যটাও লাগে। আমার সেটা ছিল। বড় তারকাদের সঙ্গে শুরু করলাম। এরপর কাজ আসতেই থাকল। এই চার বছরে ব্যস্ততা কেবল বেড়েছে।’

মাহপুজ ও বুবলী

ব্যস্ততা দেয় না অবসর

মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) দুপুরে যখন হোয়্যাটসঅ্যাপে কথা হচ্ছে, তখনো তিনি কাজের ভেতরেই ছিলেন। গুলশান শুটিং ক্লাবের বিলবোর্ডের শুটিং চলছে। দেশের টপ মডেলদের ফটোশুট। তাঁদের স্টাইলিং আর কোরিওগ্রাফি দুটোই দেখছেন মাহফুজ। আগের দিনই সাফা কবিরের একটা ক্যাম্পেইনের শুটের স্টাইলিং আর কোরিওগ্রাফি করলেন। দেশের প্রথম সারির প্রায় সব তারকা, মডেল, ফ্যাশন, বিউটি আর জুয়েলারি ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে কাজ করছেন মাহফুজ।

অবসর খুব একটা মেলে না মাহফুজের। যেটুকু যা মেলে, বিশ্বের বড় বড় তারকাদের ইনস্টাগ্রাম, উৎসবের লাল গালিচায় ফ্যাশন মুহূর্ত আর ম্যাগাজিন ঘেটেই কেটে যায়। সেসব জায়গা থেকে নতুন নতুন অনুপ্রেরণা নেন। দেখে, শিখে, পড়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্টিতে এখনো সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট ধারণাটা নতুন। মাহফুজ বললেন, ‘কোন আয়োজনে একজন তারকা কেমন সাজপোশাকে যাবেন, কোন ইভেন্টে চুলের সাজ কেমন হবে, কোন পোশাকের সঙ্গে কোন জুতা, কেমন চোখের সাজ, অমুক সহশিল্পীর সঙ্গে লুকটা কেমন হবে—এসব ঠিক করে দেওয়াই মূলত আমার কাজ।’

সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট মাহফুজ কাদরী

কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে খুলনা

সুখে, দুঃখে, বিপদে, আপদে তারকারা মাহফুজের পাশে থাকেন, একইভাবে মাহফুজকেও পাশে পান তাঁরা। একটা উদাহরণ দিই।

দিনটি ছিল ২৪ মার্চ। পেশাগত কাজে মাহফুজ ছিলেন ভারতের কলকাতায়। সেখান থেকেই শুনতে পান নায়িকা পূজা চেরীর মা আর নেই। আরও ৩ দিন সেখানে থাকার কথা ছিল। তবে এই খবর শোনার পর প্রথম ফ্লাইট ধরে ঢাকা চলে আসেন মাহফুজ। ঢাকা এসে শুনতে পান, পূজা চেরীরা দেশের বাড়ি খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন। মাহফুজও সেই পথে রওনা হয়ে যান। অংশ নেন পূজার মায়ের শেষকৃত্যে। মাহফুজের ভাষায়, ‘আমি মনে করি, আমরা সবাই মিলে একটা পরিবার। পরিবারের সদস্যদের পাশে সবাই যে রকম থাকে, এখানেও বিষয়টা তা–ই।’

শাকির খানের সঙ্গে মাহফুজ কাদরী

কেমন আয় করেন এই সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট 

বাংলাদেশে ‘সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট’ পেশা হিসেবে নতুন। তবে তারকাদের স্টাইলিং করে ‘যথেষ্ট’ আয় করেন এই স্টাইলিস্ট। বললেন, ‘কয়েকটি ফ্যাশন আর জুয়েলারি ব্র্যান্ড আছে, যাঁদের সব ফটোশুটে আমি কাজ করি। ওদের কাছ থেকে মাসিক বেতন পাই।’ এ ছাড়া পূজা চেরী আর শবনম বুবলীর ব্যক্তিগত স্টাইলিস্ট হিসেবে কাজ করছেন মাহফুজ। এর মধ্যেই বিভিন্ন ফ্যাশন ফটোশুটে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। বিভিন্ন সময়ে বড় বড় ব্র্যান্ড থেকে উপহারও চলে যায় মাহফুজ কাদরীর মিরপুরের বাসার ঠিকানায়। তাঁর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ‘হ্যাপিলি সিঙ্গেল’।

মাহফুজ বললেন, ‘আমি একা মানুষ। চাহিদা কম, যা উপার্জন করি, যথেষ্ট। অর্থনৈতিক চাহিদার চেয়ে আমার আরও ভালো কাজ করার চাহিদা বেশি। মুম্বাইয়ে একেকজন সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট নিজেরাই তারকা। আমার সে রকম কোনো চাওয়া নেই। কেবল কাজের ভেতর দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চাই। কতজন মানুষ নিজের পছন্দের কাজকে পেশায় বদলে ফেলতে পারে? আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন।’