মাত্র দেড় হাজার টাকা যেভাবে ফয়সালের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল

বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে শুধু পড়ালেখায়ই মনোযোগী হোক। কিন্তু আবরার ফয়সালের কৃষিকাজেও আগ্রহ ছিল। উচ্চমাধ্যমিকের পর আমের চারা বিক্রি শুরু করেন তিনি। দেখতে দেখতে বড় হয়েছে ব্যবসার পরিসর। রাজশাহীর নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের এই শিক্ষার্থী বাবার কথাও রেখেছেন। পড়ালেখায়ও ভালো করছেন তিনি।

আবরার ফয়সাল

মাত্র দেড় হাজার টাকার বিনিয়োগ আবরার ফয়সালের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই নিজের একটা কিছু করার ইচ্ছা ছিল। বড় হতে হতে নানা রকম শখ জেগেছে মনে। কখনো ভেবেছেন, একটা ক্যামেরা কিনে সুন্দর ছবি তুলবেন। কখনো একটা মুঠোফোন কেনার ইচ্ছা হয়েছে। কিন্তু সাধ্য কিংবা সায়, পরিবারের কোনোটাই ছিল না।

উচ্চমাধ্যমিক পেরোনোর পর শুরু করেন নিজের ব্যবসা। নওগাঁর ছেলে, আমের ব্যবসাটাই তাঁর জন্য সবচেয়ে সহজ ছিল। দেড় হাজার টাকায় আমের বীজ কিনে চারা বিক্রি শুরু করেন। প্রথম বছরই ১ হাজার চারা গাছ বিক্রি করে প্রায় ৭০ হাজার টাকা আয় হয়। উৎসাহ পান ফয়সাল। বড় হতে থাকে তাঁর ব্যবসার পরিসর। পড়ালেখায়ও এগোতে থাকেন তিনি। এখন রাজশাহীর নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন এই তরুণ। নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলার চাঁটাইবাড়িতে তাঁর গ্রাম।

সাথি ফসল

প্রথম বছরের আয় থেকে তিন বিঘা জমি ইজারা নিয়ে নিজের বাগান গড়েছিলেন ফয়সাল। কিন্তু আমের বাগান থেকে প্রথম বছরেই তো আম পাওয়া যায় না। পরিচর্যার খরচ, ইজারার টাকা পরিশোধ করবেন কোত্থেকে?

এদিকে পরিবারের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার উপায় ছিল না। ফয়সালের বাবা মোজাহারুল ইসলাম একজন শিক্ষক। তিনি সব সময় চেয়েছেন, ছেলে পড়ালেখায় মনোযোগী হোক। ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে একরকম বাধাই পেয়েছেন ফয়সাল।

কিন্তু ফয়সালের মাথায় তত দিনে ব্যবসার ভূত চেপেছে। টাকা নেই তাতে কী, হাল ছাড়তে নারাজ ফয়সাল। আমবাগানের ভেতরই সাথি ফসল হিসেবে মরিচ, বেগুন আর কলাই চাষ শুরু করেন। বাগানের আমগাছগুলো ছোট থাকায় সব কটি সাথি ফসলেরই ফলন ভালো হয়। ফলে এখান থেকেই বেশ ভালো অঙ্কের একটা লাভ পেয়ে যান ফয়সাল। পরিশোধ করে ফেলেন ইজারার টাকা।

সহযোদ্ধা যখন দুই বন্ধু

আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে নানা রকম কটু কথা শুনতে হয়েছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন ফয়সাল। এই কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন দুই বন্ধু ওবাইদুল ইসলাম ও আবদুর রহমান। পড়াশোনার কারণে জমিতে পুরোপুরি সময় দেওয়া হয় না। দুই বন্ধুই মূলত সব কাজ দেখাশোনা করেন। কখন সার দিতে হবে, কখন ডাল ছেঁটে দিতে হবে—কোনো কিছু নিয়েই ফয়সালকে আর ভাবতে হয় না।

তিন বন্ধু মিলে করেন চাষাবাদের কাজ

ফয়সালের বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। দুই বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আজ আমি যে জায়গায় এসেছি, তার পেছনে আমার যতটা অবদান, আমার দুই বন্ধুর তার চেয়ে কম নয়।’

দুই বন্ধু তো আছেনই, আমের মৌসুমে ফয়সালের বাগানে আরও ১৫-২০ জনের কর্মসংস্থান হয়।

বড় হচ্ছে পরিসর

এখন প্রায় ২৩ বিঘা জায়গাজুড়ে ফয়সালের আমের বাগান। পুরোটাই ইজারা নেওয়া। ৫টি বাগানে ৪ হাজার আমগাছ। এর বাইরে ২ বিঘা জায়গাজুড়ে কলাবাগান আর তিন বিঘায় পেয়ারাবাগানও করেছেন তিনি। ছোট পরিসরে করছেন চীনাবাদাম ও মাল্টার চাষ। সাথি ফসলসহ বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা।

ফয়সালের বাগানে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গেও কথা হলো। ওবাইদুল ইসলাম বলেন, ‘কারও কথায় কান না দিয়ে ফয়সাল নিজের কাজ করে গেছে বলেই এত দূর আসতে পেরেছে। আশা করি তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ও এলাকার বড় আম ব্যবসায়ীদের একজন হবে।’

অবশ্য ফয়সালকে এখনই বড় কৃষক বলে মনে করেন স্থানীয় দোকানদার সিরাজুল ইসলাম। ফয়সালের সব কটি বাগান ঘুরে এসে তাঁর দোকানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম আমরা। কথা প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় আমি ছিলাম এই এলাকার নামকরা কৃষক। অনেকগুলো ফসল উৎপাদন করতাম। আমার ছোট ভাই ফয়সাল আমার চেয়ে বড় কৃষক। আমি কখনো চীনাবাদাম চাষ করার সাহসও করিনি। ও সেটাও করে দেখিয়েছে।’

শুধু এলাকার নয়, পরিবারের লোকজনের ধ্যানধারণাও এখন পাল্টেছে। ফয়সালের কাজ নিয়ে তাঁর বাবা, শহীদ পিংকু বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘সত্যি বলতে আমি শুরুতে চাইনি, আমার ছেলে এসব কাজ করুক। আমি চাইতাম পড়াশোনা করে সে ভালো কিছু করুক। কিন্তু সে নাছোড়বান্দার মতো তার কাজ ঠিকই করে গেছে। পড়াশোনায়ও ও ওর বিভাগে প্রথম। তাই এখন আর ওর কাজে বাধা দিই না।’